Advertisement
০৬ মে ২০২৪
হিংসার অপ্রতিহত স্রোত
Rampurhat

রাজনৈতিক দখল রাখার এই প্রক্রিয়া তা হলে চলতে থাকবে?

প্রাথমিক তদন্তের তথ্য বলছে, অন্তত আট জন নিরীহ মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারার আগে নৃশংস ভাবে নিগ্রহ করা হয়েছিল।

বারণাবত: রামপুরহাটের বগটুই গ্রামে অগ্নিদগ্ধ বাড়ির ধ্বংসাবশেষ।

বারণাবত: রামপুরহাটের বগটুই গ্রামে অগ্নিদগ্ধ বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। পিটিআই

তাপস সিংহ
শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২২ ০৬:০৭
Share: Save:

বধ্যভূমির চেহারাটা মোটামুটি একই থাকে— তা সে ইউক্রেনেই হোক, বা রামপুরহাটে। তফাত স্রেফ মাত্রার। ইউক্রেনে বোমার পর বোমা মেরে একের পর এক শহর ধূলিসাৎ করে দেওয়া হচ্ছে! শুধু সামরিক লক্ষ্যই নয়, বেছে বেছে নারী ও শিশুদেরও আক্রমণের লক্ষ্য করা হচ্ছে। কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে সার সার বাড়ি— বোমা ও মিসাইলে অগ্নিশুদ্ধি হচ্ছে অসংখ্য প্রাণের। রামপুরহাটের বগটুইয়েও কি কার্যত তা-ই হচ্ছে না? পুড়ে খাক নারী-পুরুষ-শিশুর দেহ। জ্বলন্ত অঙ্গার যেন। প্রাণহীন বাড়ি সাক্ষ্য দিচ্ছে ভয়াবহ প্রতিহিংসাপরায়ণতার!

প্রাথমিক তদন্তের তথ্য বলছে, অন্তত আট জন নিরীহ মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারার আগে নৃশংস ভাবে নিগ্রহ করা হয়েছিল। এই ‘তথ্য’ তদন্তের পর পাল্টে যাবে কি না, শেষ অবধি এই অগ্নিকাণ্ড নিতান্তই দুর্ঘটনা প্রমাণিত হবে কি না, প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়ার জন্য ভবিষ্যতের অপেক্ষায় থাকা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু, এখনও অবধি যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, তাতে এই আগুনে প্রতিহিংসার জ্বালানি প্রকট। বোমা মেরে যারা বরশাল গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধানকে খুন করেছিল, তাদের উপর প্রতিশোধ তো নিতেই হবে! এক হত্যার পাল্টা যদি একাধিক লাশ না-ই পড়ে, তা হলে দখল থাকে কী ভাবে?

সেই দখল প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন ভাদু শেখ। তিনি এবং তাঁরাই ক্রমে ‘সিস্টেম’ হয়ে ওঠেন। ভাদু শেখদের উপর হামলা আসলে ‘সিস্টেম’-এর উপরেই হামলা! সিস্টেম প্রতিশোধ নেবে, স্বাভাবিক। ভাদু শেখদের উত্থানের কাহিনিই তো সিনেমার চিত্রনাট্যের রসদ জোগায়! এই ভাদু নাকি এক কালে ভ্যানরিকশা চালাতেন। পরে গ্রামে ট্রাক্টর চালানো শুরু করেন। পুলিশের গাড়ি চালানোর সুবাদে পুলিশের সঙ্গে ওঠাবসাও শুরু হয়। এর পর যোগ দেন তৃণমূলে। পঞ্চায়েতের উপপ্রধান
হন। মুরগি, বাস, হার্ডওয়্যারের ব্যবসার সঙ্গেই আরও নানা পথে তাঁর রোজগার শুরু হয় বলে অভিযোগ।

এটাই ‘সিস্টেম’-এর মাহাত্ম্য! এলাকায় আধিপত্য বাড়াতে গেলে প্রয়োজন রাজনৈতিক আশ্রয়ের, ও অনিবার্য ভাবেই টাকার। কিন্তু, সে টাকা আসবে কোথা থেকে? অর্থবল আনুগত্য আদায় করে— ছোট-মাঝারি-বড়, সব স্তরের মানুষেরই! শোনা যাচ্ছে, ভাদু স্থানীয় বরশাল গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান হওয়ার পর থেকেই ঠিকাদারি ও দাদার অন্যান্য কারবার দেখতে শুরু করেন ভাদুর ভাই, তৃণমূল কর্মী বাবর শেখ। ধীরে ধীরে আধিপত্য কমতে শুরু করে ভাদুর দীর্ঘ দিনের সঙ্গীদের। গত বছর খুন হয়ে যান বাবর। খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হন ভাদুর এক সময়ের সঙ্গীরা। গ্রামবাসীরাই জানিয়েছেন, জামিন পেলেও তাঁরা গ্রামে ফিরতে পারেননি। তাঁরাই নাকি ভাদু শেখকে সরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।

এ সব দাবি-পাল্টা দাবির সত্যতা পুলিশি তদন্তসাপেক্ষ। যে কোনও ঘটনার পরেই শাসককুলকে বলতে হয়, পুলিশকে কোনও রং না দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; পুলিশ যেন নিরপেক্ষ তদন্ত করে। বগটুইয়ের নির্মম হত্যালীলার পরেও এ কথা শুনতে হয়েছে। কেন বার বার এ কথা বলতে হয়? বীরভূমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা অনুব্রত মণ্ডল যখন এই ঘটনায় ‘শর্ট সার্কিট’-এর কথা শুনিয়েছিলেন, তখনও যথাযথ পুলিশি তদন্তই শুরু হয়নি। রাজ্য পুলিশের ডিজি মনোজ মালবীয় আবার শুরুতেই ‘ব্যক্তিগত শত্রুতা’র তত্ত্বও শোনান। এরই পাশাপাশি শোনা গিয়েছে ‘বৃহত্তর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’-এর তত্ত্বও। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী দলগুলির দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে বলেছেন, “যারা সরকারে থাকে না, তারা সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করার জন্য এই চক্রান্তগুলো করে, যাতে আমাদের বদনাম হয়।”

ষড়যন্ত্র থাকুক বা না থাকুক, পুলিশের ভূমিকা নিয়ে কিন্তু ইতিমধ্যেই বড়সড় প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। বগটুইয়ের ঘটনায় উঠে এসেছে স্থানীয় তৃণমূল নেতা আনারুল হোসেনের নাম— অভিযোগ, তিনিই পুলিশকে বগটুই গ্রামে আক্রান্ত পরিবারগুলির কাছে যেতে নিষেধ করেছিলেন বলে তারা ঘটনাস্থলে যেতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীকে আদেশ দিতে হল আনারুলকে গ্রেফতার করার। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, কেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। বগটুইয়ের ঘটনায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিল কলকাতা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। হাই কোর্ট বলেছে, মানুষের মনে আস্থা ফেরাতে এই নির্দেশ। রাজ্য আর কোনও তদন্ত করবে না। কোর্টের তত্ত্বাবধানে তদন্ত হবে। মানুষের মনে এই বিশ্বাসহীনতার দায় কি স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীরও নয়? রাজধর্ম মেনেই তিনি ঘটনাস্থলে গিয়েছেন। স্বজনহারাদের নানা ভাবে ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন। দিয়েছেন আশ্বাসও। কিন্তু, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ভাদু শেখরা কী ভাবে অবিশ্বাস্য সাম্রাজ্যের মালিক হয়ে ওঠেন, কী ভাবে আনারুল হোসেন বা অনুব্রত মণ্ডলরা অনায়াস অঙ্গুলিহেলনে পরিচালনা করতে পারেন স্থানীয় থানাগুলিকে, সেই প্রশ্নের উত্তর মুখ্যমন্ত্রীও দেননি।

বগটুইয়ের ঘটনা শিহরন জাগালেও এই বঙ্গে রাজনৈতিক হত্যালীলা কিন্তু আজকের ঘটনা নয়। সাম্প্রতিক অতীতেই তাকানো যাক। পানিহাটিতে তৃণমূল কাউন্সিলরের হত্যা, পুরুলিয়ার ঝালদায় কংগ্রেসের কাউন্সিলর খুন, রামপুরহাট ও নদিয়ার হাঁসখালিতেও সশস্ত্র হামলা— রক্তগঙ্গা বয়েই চলেছে। শুধু উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটিতেই মাত্র তিন মাসে পাঁচটি খুন হয়ে গিয়েছে! বহু জায়গায় খুন-জখমের ক্ষেত্রে বা এলাকা দখলের ঘটনায় শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অভিযোগ উঠছে। রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বজায় রাখতে গেলে অবশ্য এলাকা দখলে রাখতেই হয়। বামফ্রন্টের আমলে যা হয়েছিল, এই আমলেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

এত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরেও এই ভয়াবহ হানাহানি কেন? কেন এ রকম জনকল্যাণমুখী সরকার প্রশ্নাতীত ভাবে তাদের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না? মনে রাখতে হবে যে, জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের সুফল পাওয়া মানেই কিন্তু সুশাসন পাওয়া নয়। সুশাসন বলতে আইনের শাসনেরও দ্বিধাহীন প্রতিষ্ঠাকে বোঝায়; ভয়হীন, নির্বিঘ্ন জীবনযাপন বোঝায়। তৃণমূল কংগ্রেস সর্বভারতীয় স্তরেও প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য বেশ কিছু দিন ধরেই নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে শুরু করে নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছে। এ সময়ে তাঁদের নিজেদের দুর্গেই বগটুইয়ের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেলে সর্বভারতীয় স্তরে তা ভাল বার্তা দেবে না।

এখানে কোবাড ঘান্দির একটা কথা মনে পড়ছে। সিপিআই (মাওবাদী) সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে ২০০৯-এর সেপ্টেম্বরে গ্রেফতার হন তিনি। প্রায় এক দশক বন্দি থাকার পরে মুক্তি পান ২০১৯-এর অক্টোবরে। তাঁর জেল ডায়েরির নাম ফ্র্যাকচার্ড ফ্রিডম। ভাষান্তর করেছেন সুপ্রিয় চৌধুরী। এটি নিছক বন্দিত্বের রোজনামচা নয়। কোবাড সন্ধান করেছেন এক ভিন্নতর দর্শনের। সেখানেই ‘খুশির প্রশ্ন’ শীর্ষক এক অনুচ্ছেদে তিনি বলছেন, “যদি কোনও সংগঠন ‘সুখ’-কে কেন্দ্রীয় লক্ষ্য হিসাবে রেখে বৈপ্লবিক পরিবর্তন চায়, তা হলে সেটা তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপের মধ্যে প্রতিফলিত হবে, কর্মীদের প্রতি নেতাদের ব্যবহারে, সাধারণ মানুষ, দলিত, মহিলাদের ক্ষেত্রে, সর্বত্র এর ছাপ পড়বে। এর সঙ্গে থাকবে স্বাধীনতা, সুখ আর সদর্থক মূল্যবোধের এক পশলা তাজা বাতাস।”

কোবাডের কথা কেউ মানতে পারেন, না-ও পারেন। কিন্তু আজকের বঙ্গদেশে নরমাংসের গন্ধে বাতাস ভারী! এখানে সুখজাগানিয়া তাজা বাতাসের আজ বড্ড প্রয়োজন! রাজ্য বিরোধীশূন্য হলেও যে হিংসার স্রোত থামে না, পশ্চিমবঙ্গ তা দিনে-রাতে বুঝছে। বাইরের শত্রু না থাকলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বই আগুন জ্বালবে। রাজ্য জুড়ে এই হিংসার বাতাবরণ চলতে থাকলে, কড়া হাতে তা দমাতে না পারলে আরও অনেক রক্তস্নান অপেক্ষা করে থাকবে। এই মৃত্যু-উপত্যকার উপর দখল কায়েম রেখেই বা কী লাভ হবে, এ কথা ভেবে দেখার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rampurhat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE