E-Paper

পাশে থাকার মানে কী

ধর্ষণের জেরে শরীরে নানা ক্ষত, অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ প্রতিরোধ প্রভৃতির জন্য দ্রুত চিকিৎসা চাই।

সুব্রতা সরকার

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০২৫ ০৭:৫৮

নারী নির্যাতনের ঘটনা প্রায় প্রতি দিন চোখে পড়ে খবরে। তৈরি হয় উদ্বেগ, কেমন আছে মেয়েটি? কী করে তাকে সাহস, সান্ত্বনা জোগাচ্ছে পরিবার? নির্যাতিতার ঘনিষ্ঠ মানুষরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। তাঁরা মেয়েটির পাশে থাকতে চান, কিন্তু কী করা উচিত তার জন্য? চিকিৎসা বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান থেকে তার কিছু সূত্র পাওয়া যায়। সেগুলি জানা জরুরি, কারণ একটি নির্যাতিত মেয়ের শুশ্রূষাকারী বা ‘কেয়ারগিভার’-এর দায়িত্ব অনেক। যৌন আক্রমণ ঘটলে প্রায়ই আক্রান্ত মেয়েটি অবশ (ফ্রিজ) হয়ে যায়। অর্থাৎ শরীর সজাগ থাকলেও তার নড়াচড়ার শক্তি কাজ করে না। বুঝতে হবে যে, এই গুটিয়ে যাওয়া মানে ‘মেনে নেওয়া’ নয়, এ হল ‘ট্রমা’ মোকাবিলা করার অবস্থা। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে আতঙ্ক-যন্ত্রণার উদ্দীপনা যখন মানুষকে আঘাত করে, তখনকার মানসিক অবস্থাকে ‘ট্রমা’ বলা চলে। এই অবস্থা থেকে মেয়েটিকে বার করে আনতে হবে। পাশাপাশি, অন্যের কথায় বা আচরণে মেয়েটি যেন দ্বিতীয় বার ট্রমা-র সম্মুখীন না হয়, তা দেখতে হবে।

ধর্ষণের জেরে শরীরে নানা ক্ষত, অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ প্রতিরোধ প্রভৃতির জন্য দ্রুত চিকিৎসা চাই। তবে মেয়েটিকে পরীক্ষা ও চিকিৎসার বিষয়ে তথ্য জানিয়ে, তার সম্মতি নিয়ে তবেই আঘাতের পর্যবেক্ষণ, ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ, যৌনরোগ প্রতিরোধক চিকিৎসা প্রভৃতি করা যাবে। তবে যৌনহিংসার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। প্রায়ই দেখা যায় নানা লক্ষণ। যেমন, অজানা কারণে শরীরে ব্যথা, কয়েক মাস বা কয়েক বছর পরেও উদ্বেগ-জনিত অসুস্থতা, বিষণ্ণতা, ঘুমের সমস্যা, কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলা। স্বাস্থ্যকর্মীদের সতর্ক থাকা দরকার, ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে আক্রান্তকে যেন ফের ‘ট্রমা’ সইতে না হয়।

ধর্ষণের পরে প্রায় সব মেয়ের মধ্যে আতঙ্ক-পরবর্তী মানসিক অসুখের (‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ়অর্ডার’) লক্ষণ দেখা যায়। তারা আশেপাশের মানুষদের পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে না। সামান্য কারণেও তীব্র প্রতিক্রিয়া, খিটখিটে মেজাজ, ছটফটে ভাব দেখা যায়। আবার অনেকে একেবারে ভাবলেশহীন হয়ে যায়, প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারে না। এর জন্য বিশেষ ধরনের চিকিৎসা বা ‘থেরাপি’ প্রয়োজন। কথার মাধ্যমে ধীরে ধীরে আক্রান্তের মনের অবস্থার উন্নতি ও আচরণে পরিবর্তন আসে। অবসাদের ওষুধও দেওয়া হয়।

ধর্ষিত মেয়েটি যখন সে বিষয়ে কথা বলতে আসে, তখন তাকে কী বলা উচিত, তা স্থির করা সহজ হয় না। বিশেষ করে অভিযুক্ত যদি হয় পরিবারের সদস্য বা বন্ধু। এ সময়ে সংবেদনশীলতার সঙ্গে তাকে বলা যায় যে, তার সঙ্গে যা ঘটেছে তা অত্যন্ত নির্মম। এটা তার প্রাপ্য ছিল না। নিজের মতামত শোনানোর চাইতে নির্যাতিতার কথা শোনা জরুরি। ভাল-মন্দ, ঠিক-ভুল বিচারের চেষ্টা না করে শুধুমাত্র মেয়েটির কথা শুনে যাওয়াই আক্রান্তের কাছে খুব বড় সহায়তা হয়ে উঠতে পারে। মনে রাখতে হবে, দোষারোপের সময় এটা নয়।

আজও ধর্ষিত মেয়েদের নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি, ট্রোলিং চলে। অনেকে আবার ‘সব শেষ হয়ে গেল’ বলে খেদ করতে থাকেন। আপস করার জন্য চাপ, পাড়াছাড়া করা, বয়কট করার হুমকিও আসে। শুশ্রূষাকারীর কাজ হল এগুলি থেকে মেয়েটিকে নিরাপদে রাখা, তাকে ফের উঠে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে মদত দেওয়া। মেয়েটির মর্যাদা ও স্বীকৃতি নিশ্চিত করা ‘কেয়ারগিভার’-এর অন্যতম কাজ। যে সব মেয়েরা এমন নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে গিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে, সকলের কাছে সম্মানিত হয়েছে, সেই সব ঘটনা এবং প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা ভাল ফল দেয়, তা দেখা গিয়েছে।

ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসার কোনও নির্দিষ্ট ‘টাইম টেবিল’ থাকে না। তাই আক্রান্ত মেয়েটি মানসিক ভাবে প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত তাকে বাইরে বেরোনো, কাজকর্মে যুক্ত হওয়ার জন্য চাপ দেওয়াটা ঠিক নয়। বরং এই কঠিন সময়ে মেয়েটি কী ভাবে নিজের যত্ন নিজে নিতে পারে, সে ব্যাপারে সহায়তা দিতে হয়। দরকার হল যত শীঘ্র সম্ভব মেয়েটিকে মানসিক কাউন্সেলিং, আইনি ও অন্যান্য সহায়তার সম্পর্কে তথ্য দেওয়া, যোগাযোগের উপায় সম্পর্কে জানানো, প্রয়োজনে তার সঙ্গে যাওয়া। তবে মনে রাখতে হবে, সহায়তা গ্রহণ করা বা না করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার সম্পূর্ণ মেয়েটি ও তার পরিবারের। কোনও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়।

অনেকে ধর্ষণের পর মেয়েটিকে তার পাড়া থেকে সরিয়ে দেন। এটা ভুল। অপরাধের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত মেয়েটি যে সামাজিক-পারিবারিক পরিস্থিতিতে থাকত, তা থেকে বিচ্যুতি যাতে না ঘটে, সেটাই দেখা উচিত। নিয়মরক্ষার্থে মেয়েদের ‘হোম’-এ ঠেলে দেওয়া হয়। সেগুলিতে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, সহায়তা, পুনর্বাসনের পরিকাঠামো কতটুকু? বরং পশ্চিমের নানা দেশের মতো ভারতেও ‘রেপ কেয়ার সেন্টার’ তৈরি করা জরুরি। অন্য আক্রান্তদের সঙ্গে কথার মধ্যে দিয়ে একটি মেয়ে নিজেকে হীন মনে করার ঝোঁক কাটিয়ে উঠতে পারে।

অতএব ‘কেয়ারগিভার’ বা শুশ্রূষাকারীকে নজর রাখতে হবে— এক, শারীরিক চিকিৎসার সঙ্গে লাগাতার মানসিক জোর দিতে হবে। দুই, মেয়েটির চার পাশে এমন পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে যাতে সে সসম্মানে দাঁড়াতে পারে। তিন, সে যাতে ন্যায়বিচার পায়, সেই সহায়তা দিতে হবে। সারা জীবন যেন তাড়া করে না বেড়ায় একটি দুঃখজনক ঘটনা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Rape Victims Crime Against Women

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy