E-Paper

বন্ধুত্বের প্রমাণ কোথায়

শিল্প এবং পরিষেবা ক্ষেত্রে উচ্চ প্রযুক্তি-নির্ভর উৎপাদন পদ্ধতি বহু দেশেই কম দক্ষতার শ্রমের চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে অদক্ষ পরিযায়ী কর্মী সোজা পথে এই দেশগুলোতে প্রবেশ করতে পারেন না, স্থায়ী বসবাস তো দূরস্থান।

শৈবাল কর

শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২৫ ০৪:৪০

উন্নত এবং উন্নয়নশীল, দু’গোত্রের দেশের কাছেই অবৈধ অভিবাসন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে। বাংলাদেশ বা নেপাল থেকে ভারতে, আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায়— অবাঞ্ছিত অভিবাসন নিয়ে অশান্তি থামে না। তবে সংখ্যায় অনেক বেশি অভিবাসী স্বাভাবিক কারণেই ইউরোপের দেশগুলোতে আর উত্তর আমেরিকায় ঢুকতে চান। আইনকানুন যথেষ্ট কঠিন হওয়া সত্ত্বেও কিছু ফাঁকফোকর থাকে, যার সাহায্যে বেশ কিছু দিন নজর এড়িয়ে কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব। রোজগার এবং জীবনযাত্রার মানে বিপুল ফারাক বৈধ এবং অবৈধ অভিবাসীদের প্রলুব্ধ করে।

শিল্প এবং পরিষেবা ক্ষেত্রে উচ্চ প্রযুক্তি-নির্ভর উৎপাদন পদ্ধতি বহু দেশেই কম দক্ষতার শ্রমের চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে অদক্ষ পরিযায়ী কর্মী সোজা পথে এই দেশগুলোতে প্রবেশ করতে পারেন না, স্থায়ী বসবাস তো দূরস্থান। সাধারণ ভাবে এই কারণেই অবৈধ অনুপ্রবেশের বাড়াবাড়ি। এর সহায়তায় কিছু অবৈধ সংগঠন মানব পাচারের মতন গর্হিত ব্যবস্থা চালায় এশিয়া, আফ্রিকা আর দক্ষিণ আমেরিকাতে। আমেরিকা-মেক্সিকোর সীমান্ত অঞ্চলে দু’ধরনের ‘পরিষেবা’ দিয়ে থাকে এই অবৈধ সংগঠনগুলো। এক, ছোট পাচারকারী হলে অর্থের বিনিময়ে শুধু সীমানা পার করিয়ে দেবে; যাঁকে পাচার করা হচ্ছে, তার পর তিনি নিজের ব্যবস্থা করে নেবেন। এঁদের বেশির ভাগই টেক্সাস বা নিউ মেক্সিকো প্রদেশে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কিছু কাজ পেয়ে যান, এবং অবৈধ ভাবেই থেকে যান। এই পাচারকারীদের স্থানীয় নাম কায়োটি বা শিয়াল। দুই, বড় পাচারকারী হলে সীমানা পার হওয়ার পরে অবৈধ অভিবাসী তাদের ‘আশ্রয়’-এই থেকে যান। এই আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারটি আসলে প্রায় দাসপ্রথার শামিল— এর মধ্যে বাড়ির কাজ করানো থেকে অবৈধ বলে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে দেহ ব্যবসায় নামানো, সবই চলতে থাকে। এই দুইয়ের সংমিশ্রণেও অবৈধ অভিবাসন হয়। যেমন, কাউকে তাঁর পূর্ণ সম্মতিতে জাল নথির সাহায্যে অন্য দেশে ঢুকতে সাহায্য করলে তা হবে মানুষ ‘চালান’ করার বিষয়। আবার সেই ব্যক্তিকে দিয়েই যদি জোর করে প্রায় বিনা মাইনের কাজ করানো হয়, তা হবে মানব ‘পাচার’।

প্রথম বার ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প মূলত এঁদের আটকানোর জন্যেই পাঁচিল তুলতে চেয়েছিলেন। এ দফায় অনেক বেশি আগ্রাসী নীতি নিচ্ছে সরকার। আরও গুরুত্বপূর্ণ যে, এ-যাবৎ যাঁদের অভিবাসন আটকাতে সরকার বেশি সক্রিয় ছিল, তাঁরা প্রধানত মেক্সিকো আর মধ্য-আমেরিকার অধিবাসী— কারণ, তাঁরা সংখ্যায় এত বেশি যে, বেশি দিন দৃষ্টি এড়িয়ে থাকা অসম্ভব। এ বার কিন্তু ভারতীয়রাও এই তালিকার অন্তর্গত হয়েছেন। যে অমানবিক পদ্ধতিতে তাঁদের ফেরানো হয়েছে, তা নিশ্চিত ভাবে প্রমাণ করে যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ট্রাম্পের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব নিয়ে যা দাবি করে থাকেন, তার ছিটেফোঁটাও প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়াতে প্রভাব ফেলেনি।

বৈধ এবং অবৈধ অভিবাসনের বিষয়টি যে বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে আলাদা ভাবে বিচার করা হয়, তেমন উদাহরণ আমেরিকাতে অনেক আছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের তথ্য বলে যে, আমেরিকাতে সবচেয়ে বেশি অবৈধ অভিবাসী— যাঁরা প্রধানত অল্প দিনের জন্যে এসে অনেক দিন থেকে গিয়েছেন, ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও— কানাডার। তাঁদের এই ভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় যুদ্ধের জন্যে মাল পরিবহণকারী বিমানে ফেরত পাঠানো হয় কি?

এর আগে অনেক অবৈধ অভিবাসী কিন্তু বৈধতা পেয়েছেন আমেরিকা ও কানাডার মতো দেশে। এই দেশগুলোতে অভিবাসন-সহায়ক ও অভিবাসন-বিরোধী দু’ধরনের বক্তব্যই বেশ জোরদার। অভিবাসন-সহায়ক সরকার থাকলে তখন দশ বছর অন্তর আমেরিকায় ‘অ্যামনেস্টি’ নামে একটি পলিসি গৃহীত হত, যার সাহায্যে অবৈধ অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দেওয়া সম্ভব। এই ভরসাতেই অনেকে অবৈধ ভাবে ঢুকে পড়েন, বিশেষত মেক্সিকোর সীমানা দিয়ে। প্রেসিডেন্ট ওবামার আমলে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাতে আমেরিকা থেকে নির্বাসন দু’বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়। ২০১৩ সালেও একটি আইন গৃহীত হয়, যাতে ১.১ কোটি অবৈধ অভিবাসীকে বৈধতা দেওয়া হয়। পশ্চিম ইউরোপের রাজনৈতিক বাতাবরণ আরও অনেক বেশি গণতান্ত্রিক বলে সেখানে অবৈধ অভিবাসী এবং ‘শরণার্থী’ হতে আসা অন্য দেশের নাগরিকদের সঙ্গেও যথেষ্ট পরিশীলিত আচরণ করা হয়ে থাকে, অন্তত আইন অনুসারে। সে সব দেশেও পুলিশ-প্রশাসন যথেষ্টই কড়া। কিন্তু, আইন যেখানে সহায়ক, সেখানে অবৈধ অভিবাসীরাও তার পূর্ণ সাহায্য পেয়ে থাকেন এবং অভিবাসন নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে তাঁরা রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে পরিগণিত হন। এই দেশগুলোতে অতি দক্ষিণপন্থী সরকার এলে পরিস্থিতি বদলাতেই পারে।

এই পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে অবৈধ ভাবে যাওয়ার প্রচেষ্টা যেমন বন্ধ হওয়া প্রয়োজন ভারতের মতো দেশ থেকে, তেমনই কূটনৈতিক স্তরে আলোচনা প্রয়োজন অদক্ষ শ্রমিকদের কাজ পাওয়ার সুযোগ নিয়ে। এর সংস্থান কিন্তু রয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘মোড-৪’ নামের আইনে। তবে দুটোর কোনওটাতেই ভারত সরকার রাজ্যগুলিকে অভ্যন্তরীণ ভাবে সচেতন করেনি। ভারতের যে রাজ্যগুলো থেকে অবৈধ অধিবাসী গিয়েছেন, তার মধ্যে পঞ্জাব অগ্রগণ্য। জমি বাড়ি বিক্রি বা ধারের অর্থে অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল পথে গোপনে ইউরোপ আর আমেরিকায় পাড়ি দেওয়ার পিছনে সে দেশের জীবনযাপন আকর্ষণ করে নিশ্চয়ই, কিন্তু রাষ্ট্রের তরফেও উদাসীনতা দায়ী নয় কি? কেন্দ্র যে-হেতু সব বিষয়ের কেন্দ্রীকরণ চায়, বিশেষত তথ্য সংগ্রহ এবং তার ব্যবহারের ক্ষেত্রে, ফলে কোনও অঞ্চল থেকে এই ধরনের বিপথগামী আচরণের দায় শুধু রাজ্যের উপরে ঠেলে দেওয়া যায় না। এই বিষয়টি বিশেষ করে প্রাসঙ্গিক, কারণ আমেরিকা অভিবাসীদের ব্যবহার করতে চাইছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি দেশের সঙ্গে দর কষাকষির ঘুঁটি হিসাবে।

এ পদ্ধতি উন্নয়নশীল দেশও আগে ব্যবহার করেছে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি যখন মেক্সিকো থেকে লক্ষ লক্ষ অভিবাসী আমেরিকাতে যাচ্ছেন, তখন মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট আমেরিকার সরকারকে জানান যে, সে দেশের ব্যবসা যদি মেক্সিকোতে পুঁজি বিনিয়োগ করে, তা হলে অবৈধ লোকের যাওয়া বন্ধ করানো যাবে। সেই অনুযায়ী অনেক ব্যবসার কিছু অংশ যাতে মেক্সিকোতে উৎপাদিত হয়, সেই বন্দোবস্ত করা হয়। তাতে সাময়িক ভাবে অবৈধ সীমানা পার হওয়া লক্ষণীয় রকম কমে গেলেও পরে আবার তা বেড়ে যায়।

ভারতের ক্ষেত্রেও আমেরিকা এই ধরনের লগ্নিকে হাতিয়ার করতে পারে অদক্ষ শ্রমের অভিবাসন ঠেকাতে। উল্টো দিকে, অভিবাসন আটকাতে ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উচ্চ হারে আমদানি শুল্কও আরোপ করতে পারে ট্রাম্প সরকার। এই দুইয়ের প্রভাব কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা হবে। এই জাতীয় বিষয় নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে বা বিদেশনীতির অলিন্দে আলোচনা হতে বিশেষ দেখা যাচ্ছে না, যদিও সাম্প্রতিক ঘটনাক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট পথ নির্ধারণ অত্যন্ত জরুরি।

অর্থনীতি বিভাগ, সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Illegal Immigrants USA Developing Countries

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy