২০২৫ সালেই পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর অন্তত চারটি বড় ঘটনা ঘটল— মহাকুম্ভে, তিরুমালায় ভেঙ্কটেশ্বর স্বামী মন্দিরে, বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে, এবং রথযাত্রা উপলক্ষে পুরীতে। এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার পূর্বশর্ত হিসাবে ধরা যেতে পারে কোনও ধরনের উন্মাদনাকে। চারটি ঘটনাতেই স্পষ্ট, উন্মাদনার মূলত দু’টি ক্ষেত্র, ধর্ম আর খেলা। পরিসংখ্যান বলছে, পদপিষ্ট হয়ে বা ভিড়ের চাপে মৃত্যুর দুর্ঘটনার সংখ্যায় এগিয়ে রয়েছে ধর্মস্থানগুলি।
ভিড়ের চাপে অথবা পদপিষ্ট হয়ে প্রাণহানির ইতিহাসে নথিভুক্ত সম্ভবত প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল ৮০ খ্রিস্টাব্দে, জেরুসালেমে— অসংখ্য ইহুদি পুণ্যার্থী ভিড়ের চাপে প্রাণ হারান। অষ্টাদশ শতক থেকে একবিংশ শতকে অতি উন্নত দেশ ফ্রান্স, আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া কেউ পিছিয়ে নেই এই ধরনের পরিসংখ্যানে। ধর্মীয় উৎসব ছাড়াও, কখনও রাজকীয় অনুষ্ঠানে বিশৃঙ্খলার মর্মান্তিক পরিণতি হয়েছে, কখনও রাজনৈতিক বিক্ষোভ মিছিল ছত্রভঙ্গ করতেই ভিড়ের মধ্যে প্রাণহানি।
স্বাধীনতার পর ভারতে প্রথম পূর্ণকুম্ভ হয় ১৯৫৪ সালে। মৌনী অমাবস্যা স্নানের দিন সমবেত প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ পুণ্যার্থীকে পুলিশ সামলাতে পারেনি। পরিণতিতে ভিড়ের চাপে, পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ যায় প্রায় ৮০০ মানুষের। অন্য দিকে, হজযাত্রাতেও পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বহু বার। ১৯৯০ সালে মারা যান ১৪২৬ জন; ২০১৫ সালে সৌদি আরবের সরকারি হিসাবে ১৪৭০ জন (বেসরকারি তথ্যানুসারে ২২৩৬ জন)।
ক্রীড়াঙ্গনে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও চমকে দেয়। ঘটনাক্রমে, অধিকাংশ দুর্ঘটনাই ঘটেছে ফুটবল মাঠে। লিমাতে (১৯৬৪) পেরু আর্জেন্টিনার ফুটবল ম্যাচে তিন শতাধিক, ইংল্যান্ডের হিলসবোরোতে (১৯৮৯) লিভারপুল নটিংহ্যাম ফরেস্ট ম্যাচে ৯৭ জন, ইন্দোনেশিয়ায় ফুটবল ম্যাচে (২০২২) শতাধিক মানুষের মৃত্যুর মতো অনেক ঘটনা পরিসংখ্যান বাড়িয়ে চলেছে। আমাদের দেশে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা এই কলকাতা শহরে। ১৯৮০ সালের ১৬ অগস্ট ইডেন গার্ডেনসে মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল ফুটবল ম্যাচে ঝরে যায় ১৬টি তাজা প্রাণ।
স্ট্যাম্পিড বা পদপিষ্ট হওয়া এবং ক্রাউড ক্রাশ বা ভিড়ের চাপে পড়া, দুটোই মারাত্মক— কিন্তু, বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্বিতীয়টি আরও মারাত্মক। পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটতে থাকলেও অন্তত কিছু মানুষের পক্ষে খোলা জায়গায় বেরিয়ে আসার সুযোগ থাকে; ক্রাউড ক্রাশে সে সুযোগটুকুও নেই। প্রধানত দুশ্চিন্তা ও আতঙ্ক গ্রাস করে স্বল্প পরিসরে ভিড়ে সমবেত মানুষের মনে। ভিড় নিয়ন্ত্রণ হারালেই মৃত্যু ভয় তখন অনিবার্য হয়ে ওঠে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, বহু ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, যে আতঙ্ক বা ত্রাসের কারণে মানুষ দিশেহারা হয়ে শেষ অবধি ভিড়ের চাপে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, সেই কারণটি যথেষ্ট গুরুতর ছিল না। নিজের প্রাণ বাঁচানোর অদম্য তাগিদই শেষ অবধি প্রাণহানির কারণ হয়ে ওঠে।
যথাযথ পরিকল্পনা ও বিধিনিষেধ আরোপ ও কার্যকর করার মাধ্যমে রোখা যায় ভিড়ের অভিঘাতজনিত মৃত্যু। ৯/১১-র দিন ভীত সন্ত্রস্ত আটকে পড়া মানুষের উদ্ধারকাজে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর কথা শোনা যায় না— কারণ, সেখানকার নির্গমনের সঠিক পরিকল্পনা ও সে দিনের নিয়ন্ত্রণের অসাধারণ ভূমিকা আজকের দিনেও অনুধাবনযোগ্য। ঘরের কাছের উদাহরণ যদি নিই, তবে বলতে হবে, রথযাত্রার ভিড় অপেক্ষাকৃত কম হলেও এ বছর দিঘা পুরীর চেয়ে এগিয়ে থেকেছে পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণে। এ ছাড়াও দরকার বিশ্বায়নের যুগে সঠিক আইনের প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনশাস্ত্রে স্ট্যাম্পিড ও ক্রাউড ক্রাশ শব্দগুলি আজও সঠিক পরিসরে সংজ্ঞায়িত হয়নি। ফলে আইনের ফাঁক থেকে যায়। আমাদের দেশে গণপরিসরে স্ট্যাম্পিড ও ক্রাউড ক্রাশে মৃত্যু রুখতে সরাসরি কোনও আইন তৈরি হয়নি। ২০০৫ সালের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনই একমাত্র ভরসা। তার ফলে, এই ধরনের দুর্ঘটনার জন্য যাঁরা দায়ী— অনুষ্ঠানের আয়োজকরাই হোন অথবা কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পরিচালকমণ্ডলী, অথবা পুলিশ-প্রশাসন— তাঁরা তুলনায় সহজে পার পান।
আপাতত এই ছবি পাল্টাচ্ছে দেশে দেশে। ইংল্যান্ডে স্টেডিয়াম-সহ ক্রীড়াঙ্গনে অবাঞ্ছিত ভিড় রুখতে আইন চালু হয়েছে ১৯৭১ সালে। ২০১৭ সালের ২২ মে ম্যানচেস্টারে এক ইনডোর স্টেডিয়ামে জনপ্রিয় আমেরিকান গায়িকা আরিয়ানা গ্রান্ডের অনুষ্ঠানে সমবেত হন বিপুল সংখ্যক মানুষ। সেখানে সালমান আবেদি নামে এক আইসিস জঙ্গির আত্মঘাতী বিস্ফোরণে বহু মানুষ হতাহত হন। এ বছরেই আইন এনেছে ব্রিটিশ আইনসভা, যাতে কোনও গণপরিসরে মানুষের নিরাপত্তা রক্ষার চূড়ান্ত দায়িত্ব সরকার বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিশ্চিত করতে হবে। তুলনীয় আইন ভারতেও নয় কেন?
পদার্থবিদ্যা বিভাগ, সেন্ট জ়েভিয়ার’স কলেজ, কলকাতা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)