দীর্ঘ কাল ধরে মাতৃপুজোর যে বিষম ঘটা এই বঙ্গে চলছে, ভারতের আর কোথাও হয়তো তার তুলনা নেই। সম্প্রতি বঙ্গের দুর্গাপুজো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও আদায় করেছে। বাঙালির শ্লাঘার অন্ত নেই। অবোধ বালক যেমন যাবতীয় চাহিদার কথা মুখ্যত মায়ের কাছেই ঘ্যানঘ্যান করে, তেমনই দীর্ঘ দিন ধরে বাংলার মানুষ তার কাম্যবস্তুসমূহ প্রাপ্তির আশায় হাঁটু মুড়ে লোভী দুটো হাত বাড়িয়ে দিয়েছে মাতৃরূপী দেবীর সামনে।
সন্তানকামনায় গ্রাম মফস্সলের মানুষ ষষ্ঠীঠাকরুনের কাছে মাথা নত করেছে চিরকাল। বিদ্যার জন্য দ্বারস্থ সরস্বতীর। ধনের আকাঙ্ক্ষায় লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন করেছে, পাঁচালি পড়েছে দুলে দুলে। শক্তি ও নিরাপত্তার জন্যে নির্ভর করেছে দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রী ইত্যাকার শক্তিরূপিণীর কাছে। এমনকি মহামারি এড়াতেও যে সব লৌকিক দেব-দেবীর আবির্ভাব ঘটেছে গ্রামে গ্রামে, তাঁদেরও অধিকাংশ মাতৃমূর্তিই। স্বার্থপরের মতো, চিরভিক্ষুকের মতো, মহিলা দেবতাদের কাছে শুধু চেয়েই গিয়েছি চিরকাল, কিন্তু কখনও কি কিছু দিয়েছি তাঁদের? থালায় ভরে যে চাল, সন্দেশ, কলাটা মুলোটা দিয়েছি, তাও তো নিজেরাই ভোগ করব বলে। সত্যিই যা দিতে পারতাম, আমাদের ভক্তি, মায়ের প্রতি আমাদের ভালবাসা, তা আর দিতে পারলাম কই! যদি দিতাম, বাস্তবের রক্ত-মাংসে গড়া মাতৃমূর্তি যে নারীরা, তাঁদের ইচ্ছে করে, হাসতে হাসতে, চিরকাল আমরা অবদমিত করলাম কী ভাবে? তাঁদের কামের বস্তু, ভোগের বস্তু ছাড়া আর কী-ই বা ভাবতে পারলাম?
বাংলা ভাষার মধ্যে যত অপশব্দ, তার অধিকাংশই হয় নারীর যৌন অঙ্গের অথবা নারীসম্ভোগের ইঙ্গিতবাহী। যে প্রবণতা আরও মারাত্মক, গালাগালির অধিকাংশই যার উদ্দেশে প্রয়োগ করা, তার মা, বোন অথবা স্ত্রী-র সঙ্গে যৌন সম্পর্কস্থাপন সংক্রান্ত। অর্থাৎ, যে নারীকে আমাদের সংস্কার দেবী রূপে পুজো করতে শেখাল, যে নারীমূর্তির সামনে কাঙালের মতো রূপ, ঐশ্বর্য, যশ চাইছি বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম, সেই নারীকেই আসলে চেতনে বা অবচেতনে ভোগ্যবস্তুর বাইরে আর কিছুই ভেবে উঠতে পারছি না।
সম্প্রতি এক রাজনীতিবিদ পুলিশকর্মীর প্রতি বিদ্বেষবশত মধ্যরাতে স্খলিতকণ্ঠে তুমুল বিষোদ্গার করলেন। সমাজমাধ্যমে, সংবাদমাধ্যমে বিস্তর হইচই হল। রাজনীতিবিদ দায়সারা ক্ষমা চেয়ে নিলেন। পুলিশের পক্ষে কিছু ধারা-টারা দিয়ে মামলাও রুজু হল। এ ঘটনা চমকপ্রদ কিছু নয়। এমনটা আজকের বঙ্গে পেশিশক্তিসর্বস্ব রাজনীতিতে হয়েই থাকে। কিন্তু, রাজনৈতিক ব্যক্তিটির ক্ষোভ যে পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে, তাঁর বর্ষিত অপশব্দের মূল লক্ষ্য তিনি হলেন না। হলেন তাঁর মা, তাঁর স্ত্রী। ওই রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে এঁদের দু’জনের শত্রুতার প্রশ্নই ওঠে না। সম্ভবত তাঁদের দু’জনকে রাজনীতিবিদটি চেনেনই না। বিষয়টি আরও তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ যে সময়কালে ঘটনাটি ঘটল, তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নারী এবং তিনি পুলিশমন্ত্রীও বটে। যখন লেখাটি লিখছি, অন্তত সেই সময় পর্যন্ত তাঁর কোনও প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া আমরা পাইনি। বাংলার নারীসমাজ দলমতনির্বিশেষে প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন, এমন সংবাদও নেই। তা হলে আমরা কি এ বিষয়গুলিকে স্বাভাবিক বলেই মেনে নিতে শুরু করলাম আবার? যেমন মধ্যযুগে সতীদাহ মেনে নিয়েছিলাম! বাল্যবিধবা নারীদের উপর নেমে আসা সামাজিক ও পারিবারিক অভিশাপকেও তো মেনেই নিয়েছিলাম আমরা। মনে রাখতে হবে, সে কালে সমাজের এই কুৎসিত প্রথাগুলিকে মেনে নেওয়ার পক্ষেই কিন্তু অধিক জনসমর্থন ছিল, সংস্কারের পক্ষে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সংখ্যার বিচারে নগণ্য।
কিছু দিন আগে এক পড়ুয়া চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুন নিয়ে বাংলা উত্তাল হয়েছিল। অভূতপূর্ব জনজাগরণের সাক্ষী হয়েছিলাম। রাজনীতি-নিরপেক্ষ ভাবেই প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল মানুষ। তার পর রাজনীতির ঘোলাজলে সব হারিয়ে গেল। চ্যানেলে চ্যানেলে পরিসংখ্যান, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে অন্য রাজ্যে কত ধর্ষণ, কী পরিমাণ নারী-নির্যাতন! যেন অন্য রাজনৈতিক দল শাসিত কোনও রাজ্যে ঘটে যাওয়া নির্মমতা, সংঘটিত অপরাধ এ রাজ্যে ঘটলে তা আর নিন্দনীয় রইল না! একটি অপরাধের উদাহরণে অপর অপরাধ লঘু হয়ে গেল মুহূর্তে।
আসলে আমরা বিস্মরণপ্রিয়। কালকে ঘটে যাওয়া ঘটনা ভুলে গিয়েছি। আজকে ঘটতে থাকা ঘটনাও আগামী কাল ভুলে যাব নিশ্চিত। আসছে বছর দুর্গাপুজোর থিম কী হবে তাই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ব আর কিছু দিন পরই। মাটির তৈরি প্রতিমার সামনে আবারও হাঁটু মুড়ে বসে পড়ব হাতজোড় করে। আর পুজো প্যান্ডেলেই হয়তো আমাদের অসংযত বাক বিদ্ধ করবে কোনও নারীকে। নেতা থেকে জনতা, এই অসংযম ও দ্বিচারিতা আমাদের সমাজের মজ্জাগত হয়ে গিয়েছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)