আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের তত্ত্ব নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা মোটের উপরে বিশ্বাস করেন যে, মুক্ত বাণিজ্য সর্বদাই লাভজনক। এর প্রাথমিক কারণ দক্ষতা বৃদ্ধি এবং শ্রমবিভাগ। তাই তাঁদের পরামর্শ হল, বাণিজ্যের ধরন ও প্রবণতা নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভাল, তাকে নিজের মতো চলতে দেওয়াই উচিত। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতি ওই রকম সরল পথে চলে না। আজকের ক্ষতি, কালকের লাভ, বাজারের আর্থিক ক্ষমতা, বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি এসে বাণিজ্য ও কল্যাণের মূল প্রতিপাদ্যটিকে খানিক ঘেঁটে দেয়। মানে, সেই স্বল্পমেয়াদি আর দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের চিরন্তন বিরোধ।
জেমস ব্র্যান্ডার ও বারবারা স্পেনসার গত শতকের আশির দশকে কয়েকটা অসাধারণ গবেষণাপত্র লিখেছিলেন। একটু বিশেষ ধরনের বাজারের পরিপ্রেক্ষিতে ওঁরা ব্যাখ্যা করেন যে, বাণিজ্যকে খানিক এ দিক-ও দিক বিব্রত করলে ভবিষ্যতে আজকের তুলনায় বেশি লাভ করা যেতে পারে। যে বাজারের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা পর্যালোচনা করেছিলেন, সেটি প্রতিযোগিতামূলক নয়— পরিভাষায় সেই বাজারের চরিত্রটির নাম অলিগোপলি, যেখানে বাণিজ্যে যোগ দেওয়া দেশগুলি আর্থিক ভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী, এবং বাজারকে প্রভাবিত করতে পারে।
বাস্তব দুনিয়ায় কিন্তু শক্তিধর দেশগুলিই বাণিজ্য নীতির খেলায় নানা কৌশল প্রয়োগ করে থাকে। এবং সেটা করে একে অন্যের বিরুদ্ধে। কখনও শুল্ক ,আবার কখনও ভর্তুকি ব্যবহার করে। মানে, রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ বা রেসিপ্রোক্যাল ডাম্পিং— আমেরিকা ও চিন যে দড়ি টানাটানির খেলায় নিয়োজিত রয়েছে বেশ কিছু বছর যাবৎ। কিন্তু সম্প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্প এই খেলায় একটি অন্য মাত্রা যোগ করেছেন— অন্য একটি দেশ। এখানে কৌশলী বাণিজ্য নীতির যুদ্ধে একে অপরের সঙ্গে লড়াই চলছে, কিন্তু তা চলছে তৃতীয় দেশের বাজার নিয়ে। এই তৃতীয় দেশটি হল ভারত।
এবং, এই লড়াইয়ে নেমেছে আমেরিকা ও রাশিয়া। আসলে এই দেশ দুটো বহু দশক ধরেই অর্থনৈতিক যুদ্ধে লিপ্ত। সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গোটা বিশ্ব আমেরিকা ও রাশিয়াকে কেন্দ্র করে দ্বিধাবিভক্ত থেকেছে। চলেছে ঠান্ডা যুদ্ধ। এমনকি সাম্প্রতিক রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের পটভূমিতেও তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। ব্র্যান্ডার ও স্পেনসারের গবেষণায় এই তৃতীয় দেশটির বাজার দখলের ক্ষেত্রেও নানা সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল সাময়িক ভর্তুকি দিয়ে আপাতত তৃতীয় দেশের বাজার থেকে প্রতিযোগী বিতাড়নের ব্যবস্থা করা। একে পরিভাষায় বলা হয় ‘প্রফিট শিফটিং’।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কিন্তু এ সব কিছুই করেননি। নিজের দেশের বিক্রেতাকে ভারতের বাজারে বিক্রির জন্য ভর্তুকি দেননি, প্রতিযোগী রাশিয়ার উপরে প্রতিশুল্কের চাপও প্রয়োগ করেননি। বরং একদম উল্টো পথে হেঁটে ভারতে উৎপাদিত এবং আমেরিকাতে রফতানিযোগ্য দ্রব্যের উপর আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছেন। প্রথমে স্থির হয়েছিল ২৫%, তার পর ট্রাম্পসাহেব ভীষণ রেগে বিষম খেয়ে সেটাকেও বাড়িয়ে করে দিলেন ৫০%। এ নীতি আর্থিক কৌশলের নয়— একদম চাপের নীতি, ভীতি প্রদর্শনের নীতি। ভারতের বাজার হারানোর সম্ভাবনায় ভারতকে আমেরিকার বাজার থেকে খানিক সরিয়ে দেওয়ার হুমকি।
একটু খুলে বলা যাক। ভারতের প্রতিরক্ষা ও সামরিক সরঞ্জামের চাহিদা পর্যাপ্ত। গোটা পৃথিবীতে যুদ্ধ-জিগির যত বাড়বে, তত বাড়বে চাহিদা। এতে সুবিধা তাদের, যারা সামরিক যন্ত্রপাতি বিক্রি করে। এরা হল আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, চিন এবং জার্মানি। অর্থাৎ ভারত যদি রাশিয়ার সরঞ্জাম আমদানি করে, ভারতের বাজার হারাবে আমেরিকা। অতএব সেটা বন্ধ করা প্রয়োজন। আমেরিকা তো আর রাশিয়াকে বিক্রি বন্ধ করতে বলতে পারে না— অতএব, চাহিদার রাস্তা আটকাও। কী ভাবে? ভারত যেন না কিনতে চায়। তাই ভারতের রফতানির উপরে আমেরিকার শুল্ক চাপানোর নীতি। আমেরিকার বাজার হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে ভারত যদি রাশিয়া থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনা বন্ধ করে, তা হলেই আমেরিকা ভারতের বাজার পুনর্দখল করতে পারবে।
ট্রাম্প এমন আশা করতেই পারেন। কারণ পারস্পরিক-শুল্ক ও শাস্তি-শুল্ক নিশ্চিত ভাবে ভারতের আর্থিক প্রগতিতে কিছুটা ধাক্কা দেবে। কিন্তু, ভুললে চলবে না যে, ভারতে অপরিশোধিত তেলের চাহিদাও প্রচুর। এই চাহিদার একটা বিরাট অংশ আসে রাশিয়া থেকে। ট্রাম্পের মূল রাগ এখানেই। আমেরিকার বাজার হারানোর চিন্তায় ভারত সস্তার তেল কেনার সুযোগটি ছাড়বে কি না, ট্রাম্প সে হিসাব কষেননি বলে ধরে নেওয়ার কারণ নেই— কিন্তু, তিনি আশাবাদী যে, আমেরিকার বাজারের দখল হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে ভারত তার নীতি পাল্টাবে। সংবাদমাধ্যমে প্রশ্ন ঘুরছে— ভারত কি তবে পিছু হটবে?
কিন্তু আজকের ধাক্কাই শেষ কথা নয়, দীর্ঘ কালের পথে অনেক চড়াইউতরাই থাকে। ভারতের পক্ষে আশাবাদী হওয়ার যে কারণগুলি আছে, তার মধ্য অন্যতম হল ‘ব্রিকস’ নামক বহুজাতিক সংগঠনটি। এর সদস্যসংখ্যা এগারো; যার মধ্যে প্রধান পাঁচটি দেশ হল ব্রাজ়িল, রাশিয়া, ভারত, চিন, ও দক্ষিণ আফ্রিকা। বাকি দেশগুলি হল সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, ইরান, সৌদি আরব, মিশর, ইথিয়োপিয়া, এবং ইন্দোনেশিয়া। এই দেশগুলি প্রতি বছর নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসে নানা ধরনের বহুজাতিক নীতি নিয়ে পরামর্শ করার জন্য। ব্রিকসের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছে কয়েক দিন আগে, ব্রাজ়িলে।
ব্রিকস আসলে পশ্চিমি অর্থনীতি আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি প্রতিস্পর্ধী স্বর— তাদের চাপিয়ে দেওয়া কৌশলের পাল্টা নীতি প্রণয়নের সম্ভাবনাক্ষেত্র। অতি সম্প্রতি ব্রিকসের সদস্য দেশগুলি নিজেদের মধ্যে একটি সাধারণ মুদ্রা প্রচলন করার ব্যাপারেও আলোচনা শুরু করেছে। এতে সদস্য দেশের মধ্যে বাণিজ্য, ভ্রমণ, শিক্ষা, সংস্কৃতির মেলবন্ধন যেমন সহজ হবে, ঠিক তেমনই অন্যান্য দেশের কাছে নিজেদের আরও ভরসাযোগ্য বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সঙ্গী হিসাবে তুলে ধরা যাবে। এর সঙ্গে রয়েছে আরও কয়েকটি বিষয়— চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ, আমেরিকা-চিনের বাণিজ্যযুদ্ধের কৌশল, বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থব্যবস্থা হিসাবে ভারতের উত্থান, আদি ও অকৃত্রিম রাশিয়ান প্রতিপত্তি, এবং মানব মূলধনের বাজারে ভারত ও চিনের যৌথ আধিপত্য। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আগামী কয়েক বছরে অর্থনৈতিক অক্ষ খানিক অদল-বদল হলে অবাক হব না।
অর্থনীতি বিভাগ, সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)