Advertisement
E-Paper

জীবনে হাল ছাড়া নেই, আমাদের ঝুলিতে একটা কোহলি আছে!

অভাবনীয়! অবিশ্বাস্য! যেখানে নায়ক বার বার ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়তে পড়তেও লড়াই ছাড়ছে না এবং শেষমুহূর্তে জিতে যাচ্ছে আর গোটা প্রেক্ষাগৃহের দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে। অবিকল ইচ্ছাপূরণের সিনেমার মতো।

অনিন্দ্য জানা

অনিন্দ্য জানা

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২৫ ০৮:৫৫
আপাত-অনন্ত তাড়না মঙ্গল-রাতে শেষ হল। বেদনামুক্তির কান্না। ছবি: গেটি ইমেজেস।

আপাত-অনন্ত তাড়না মঙ্গল-রাতে শেষ হল। বেদনামুক্তির কান্না। ছবি: গেটি ইমেজেস।

দৃশ্যটা কি স্বপ্নপূরণের গ্রহে বৈগ্রহিক হয়ে রয়ে গেল? ঘাসের উপর নতজানু বিরাট কোহলি। উদ্গত অশ্রু বিমোচনে দু’হাতের পাতায় মুখ ঢাকা। ধীরে ধীরে কোমর থেকে ভেঙে চেহারাটা নুয়ে পড়ল মাঠের উপর। আইপিএল ট্রফির উপাসক মাথা ঠেকালেন তাঁর মন্দিরের ভূমিতে।

ওই একটি দৃশ্যে মাখামাখি হয়ে রয়ে গেল ধৈর্য, আনুগত্য, চেষ্টা, অধ্যবসায়, পরিশ্রম, সংকল্প, বিশ্বাস এবং সততা।

ওই শব্দগুলোর উপর ভর করে মঙ্গলবার রাতে প্রায় সারা ভারতবর্ষ চাইছিল, আইপিএল ট্রফিটা এ বার জিতুন বিরাট কোহলি। বিশ্বকাপ স্তরের টুর্নামেন্ট ছাড়া অন্য কোনও প্রতিযোগিতায় কার্যত সারা দেশের আবেগ একই অভিমুখে ধাবিত হওয়ার এই উদাহরণ আগে দেখেছি কি? মনে তো পড়ছে না। মাত্র একটি লোকের সাফল্যের প্রার্থনায় জনতাকে এমন উদ্বেল দেখেছি কি? মনে তো পড়ছে না। বিরাট কোহলির চোখ ছলছল, দেখেছি কি? মনে তো পড়ছে না।

আঠেরো বছর। ১৮-কে ৩৬৫ দিয়ে গুণ করে দেখলাম। ৬,৫৭০ দিন! এর মধ্যে বিরাট কোহলির বয়স ১৮ বছর বেড়ে গিয়েছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে তাঁর পারিশ্রমিক, সম্পত্তি এবং গ্যারাজে গাড়ির সংখ্যা। স্বেচ্ছারোপিত কৃচ্ছ্রসাধনের কারণে চেহারায় লক্ষণীয় বদল ঘটেছে। যাপনে বদল এসেছে। জীবনে জীবনসঙ্গিনী যোগ হয়েছেন। কোহলি দিল্লি ছেড়ে মুম্বইয়ে থাকতে শুরু করেছেন। ভবিষ্যতে পাকাপাকি ভাবে ইংল্যান্ডে থাকার সিদ্ধান্তও নিয়েছেন। তাঁর জীবনে দুই সন্তানের আগমন ঘটেছে। এই সময়ের মধ্যে তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ার তুঙ্গ সাফল্য দেখেছে। অতলস্পর্শী ব্যর্থতাও দেখেছে। এরই মধ্যে তিনি তিন ফর্ম্যাটে দেশের অধিনায়কত্ব করেছেন। তিন ফর্ম্যাট থেকে অধিনায়কত্ব ছেড়েছেনও। এই ১৮ বছরের মধ্যে তিনি ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ জিতেছেন। একাধিক বার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছেন। জিতেছেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। আবার এই সময়ের মধ্যেই তিনি ৫০ ওভারের বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেও হেরেছেন। এই সময়কালের মধ্যে তিনি আন্তর্জাতিক স্তরের টি-টোয়েন্টি এবং টেস্ট ম্যাচ থেকে অবসর নিয়েছেন।

২০০৮ সালে যে শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, সে আঠেরো বছরে পৌঁছে ভোটাধিকার পেয়ে গিয়েছে। দেশে চারটি সাধারণ নির্বাচনে চারটি সরকার ক্ষমতায় এসেছে। ভারত দু’জন প্রধানমন্ত্রী দেখে ফেলেছে। অযোধ্যায় মহা ধুমধামে রামমন্দির তৈরি হয়েছে।

গত ১৮ বছরে দু’টি বিষয় অপরিবর্তিত থেকেছে। এক, বিরাট কোহলি রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুতে রয়ে গিয়েছেন। দুই, বিরাট কোহলি আইপিএল ট্রফি জিততে পারেননি।

বেঙ্গালুরু তিন বার ফাইনালে উঠেও হেরেছে। রান তাড়া করে ভারতকে জেতাতে জেতাতে ক্রিকেট দুনিয়ায় বিরাট কোহলির নাম হয়ে গিয়েছে ‘চেজ়মাস্টার’। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে আইপিএল জেতার স্বপ্নকে তাড়া করেও তিনি ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেননি। সেই ‘চেজ়’, সেই আপাত-অনন্ত তাড়না মঙ্গল-রাতে শেষ হল তাঁর।

ম্যাচের পর যখন গোটা দেশ আন্দোলিত, বিরাট বারংবার বলছিলেন, তিনি এই টিমকে তাঁর যৌবন দিয়েছেন। তাঁর সোনার সময় দিয়েছেন। তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়েছেন। কিন্তু এই ট্রফি তাঁর একার নয়। এই জয় আরসিবি-র অগণিত এবং অসংখ্য ভক্তের, দর্শকের। যাঁরা দুঃখের দিনেও টিমকে সমর্থন করা ছেড়ে দেননি। টানা ব্যর্থতার পরেও হাল ছাড়েননি। বছরের পর বছর টিমের সঙ্গে থেকেছেন। দেশের নানা শহরে পরের পর ম্যাচে এসে গ্যালারি ভরিয়েছেন। স্বপ্নভঙ্গ হলেও আশা ছেড়ে দেননি। বিরাট বলছিলেন, এই ট্রফি টিমের সাপোর্ট স্টাফদেরও। যাঁরা গত ১৮ বছর ধরে টিমের সঙ্গে জুড়ে থেকেছেন। পর্দার পিছনে নিরন্তর কাজ করেছেন।

টিমগেমে তুঙ্গ সাফল্যের অধিকারী যে কোনও পেশাদার তেমনই বলবেন। কৃতিত্বের আলোকবৃত্তে এগিয়ে দেবেন নেপথ্যচারীদের। যাঁরা এমনিতে জয়ের মহাকাব্যে উপেক্ষিত থেকে যান। কিন্তু বিরাট আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। মঙ্গলবার রাতের গভীরতম মুহূর্তটি সম্ভবত তখনই তৈরি হল, যখন সদ্য আইপিএল চ্যাম্পিয়ন বলে দিলেন, তাঁর দুই প্রাক্তন সতীর্থ এবি ডিভিলিয়ার্স এবং ক্রিস গেল তাঁদের সঙ্গেই পুরস্কারের মঞ্চে যাবেন ট্রফি নিতে। এ জিনিস আগে কখনও দেখিনি। শুনিনি।

ডিভিলিয়ার্স এবং গেল দু’জনের কেউই এখন আর পেশাদার ক্রিকেট সে ভাবে খেলেন না। দু’জনেই বিরাটের আরসিবি জীবনের দীর্ঘ দিনের সঙ্গী। ওয়েস্ট ইন্ডিজ় থেকে টানা ২১ ঘণ্টা উড়ে আইপিএল ফাইনালে এসেছিলেন গেল। ডিভিলিয়ার্স অবশ্য তার আগেই ভারতে এসেছিলেন সম্প্রচারকারী চ্যানেলে ধারাভাষ্য দিতে। তাঁর এমনিতেই ফাইনালে মাঠে থাকার কথা ছিল। কিন্তু তিনি আগে থেকে একটা আরসিবি-র জার্সি চেয়ে রেখেছিলেন। যাতে বিরাট ট্রফি জিতলে সেই জার্সি গায়ে চাপিয়েই তাঁর সঙ্গে জয়ের উদ্‌যাপনে যোগ দিতে পারেন। আরসিবি-র সাজঘরে ডিভিলিয়ার্সের সঙ্গে বিরাটের এক আশ্চর্য রসায়ন তৈরি হয়েছিল। যা ক্রিকেটমাঠের গণ্ডি পেরিয়ে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বে পর্যবসিত হয়। বিরাট আগে সে কথা একাধিক বার বলেছেন বটে। কিন্তু ফলিত স্তরে তা দেখা গেল মঙ্গলবার রাতে। ম্যাচের শেষ লগ্নে যখন প্রায় নিশ্চিত যে, বিরাটের ১৮ বছরের অপেক্ষা শেষ হতে চলেছে, কানে টক-ব্যাক নিয়েই কমেন্ট্রি বক্স থেকে দৌড়ে নীচে নেমে এসেছিলেন ডিভিলিয়ার্স। তখনও ম্যাচ শেষ হতে দু’ওভার বাকি। বাউন্ডারি লাইনের ধারে ফিল্ডিং করতে করতেই দর্শকদের মধ্যে দাঁড়িয়ে-থাকা প্রিয় বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বিরাট হাতের মুদ্রায় ইঙ্গিত করেন, তাঁর চোখ ইতিমধ্যেই ঝাপসা। ম্যাচ জিতলে তিনি নির্ঘাত কেঁদে ভাসাবেন।

তার পরেই তৈরি হল সেই দৃশ্য, যে দৃশ্যে রয়ে গেল ব্যক্তির ধৈর্য, আনুগত্য, চেষ্টা, অধ্যবসায়, পরিশ্রম, সংকল্প, বিশ্বাস এবং সততা।

মাঠ পেরিয়ে ছুটতে ছুটতে কোহলির কাছে এলেন ডিভিলিয়ার্স। দু’জনের যে আশ্লেষ আলিঙ্গন হল, কাছাকাছির তুলনা বলতে মনে করতে পারছি কুম্ভমেলায় ছোটবেলায় হারিয়ে-যাওয়া ভাইকে বড়বেলায় খুঁজে পাওয়ার মতো। মাথায় লাল টকটকে পাগড়ি পরিহিত (শেষবেলায় পঞ্জাবের হয়ে খেলেছিলেন বলে) গেল জড়িয়ে ধরলেন বিরাটকে। তার পরে ডিভিলিয়ার্স, গেল এবং কোহলি দাঁড়ালেন ক্যামেরার সামনে। সমবেত উদ্‌যাপনের জন্য।

দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, সত্যিই ১৮টা বছর ধরে এই লোকটা অপেক্ষা করেছে এই মুহূর্তটার জন্য! শুধু তা-ই নয়, নিজের অপূর্ণ ইচ্ছার সঙ্গে, নিজের অধরা স্বপ্নের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছে কোটি কোটি মানুষকে। তাঁদের মধ্যে যেমন তাঁর প্রাক্তন সতীর্থেরা আছেন, তেমনই আছেন অগণিত সাধারণ মানুষ। অভাবনীয়! অবিশ্বাস্য! যেখানে নায়ক বার বার ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়তে পড়তেও লড়াই ছাড়ছে না এবং শেষমুহূর্তে জিতে যাচ্ছে আর গোটা প্রেক্ষাগৃহের দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে। অবিকল ইচ্ছাপূরণের সিনেমার মতো।

ধৈর্য, আনুগত্য, চেষ্টা, অধ্যবসায়, পরিশ্রম, সংকল্প, বিশ্বাস এবং সততা।

সেই মুহূর্তে দীর্ঘ ১৮ বছরের যাত্রার বিভিন্ন মুহূর্ত নিশ্চয়ই ফ্ল্যাশব্যাকের মতো সরে সরে যাচ্ছিল বিরাট কোহলির মনের চোখে। তিনি বলছিলেন, ‘‘মনে হচ্ছে, গত ১৮টা বছর এত সংগ্রাম করেছি, এত লড়াই করেছি। এতদিন পরে ঈশ্বর এই মুহূর্তটা দিয়েছেন। ভিতরে একটা শান্তি তৈরি হয়েছে। মনে হচ্ছে, অনেক দিন ধরে এই জার্নিটা চলল। এ বার একটু নোঙর ফেলে থিতু হই। অনেকে এত দিন ধরে অনেক কথা বলেছে। প্রচুর ট্রোল করেছে। বলেছে, বছরের পর বছর চেষ্টা করেও ট্রফিটা জিততে পারেনি। কিন্তু এখন সে সব কিছুতেই আর কিছু যায়-আসে না। এখন সব শান্ত। সর্বত্র শান্তি।’’

বিরাট কোহলি আইপিএল জিতলেন। পেশাদার ক্রিকেটজীবনের বৃত্ত সম্পূর্ণ করলেন। কেরিয়ারের উপান্তে এসে ট্রফির ফ্রেম পূর্ণ হল তাঁর। ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ জিতেছিলেন। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছেন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছেন। টেস্টে বিশ্বের এক নম্বর দলের সদস্য হয়েছেন। কিন্তু আইপিএল ট্রফিটা ছিল না তাঁর। যে ট্রফি জেতার পর আবেগতাড়িত হয়েও নির্দ্বিধায় বলে দিলেন, টেস্ট ম্যাচের চেয়ে আইপিএল তাঁর কাছে অন্তত পাঁচ ধাপ নীচে থাকবে। কিন্তু তা-ও এই ট্রফি জেতা তাঁর কাছে ভয়াবহ রকমের কাম্য ছিল। এই দিনটা যে তাঁর জীবনে কখনও আসবে, তা তিনি ভাবতে পারেননি।

ভাবতে কি আমরাও পেরেছিলাম? চেয়েছিলাম ঠিকই। প্রতি বছর মনে হয়েছে, এই লোকটার এই ট্রফিটা প্রাপ্য। এই বছরে আরও বেশি করে মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ হওয়া দরকার। বিরাট কোহলি তাঁর পেশাদার ক্রিকেটজীবনের গোধূলিতে এসে দাঁড়িয়েছেন। নিজের হাতে বন্ধ করে দিচ্ছেন একের পর এক দরজা। এই অপ্রাপ্তিটা নিয়ে তাঁকে চলে যেতে হবে? এমনিতেই ব্যক্তির ধৈর্য, আনুগত্য, চেষ্টা, অধ্যবসায়, পরিশ্রম, সংকল্প, বিশ্বাস এবং সততার দাম এই সমাজে কমতে কমতে প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। বিরাট কোহলির আইপিএলে অসফল থেকে-যাওয়া সেই অসময়ের উপর যেন চিরকালীন সিলমোহরই মেরে দিয়ে যাচ্ছিল। বিশ্বাস হারাতে বসেছিল।

এই লেখার সঙ্গের বৈগ্রহিক ছবিটি সেই বিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়ে গেল। বলে দিয়ে গেল, ধৈর্য, আনুগত্য, চেষ্টা, অধ্যবসায়, পরিশ্রম, সংকল্প, বিশ্বাস এবং সততার দিন ফুরোয়নি। বলে গেল, লক্ষ্য তাড়া করতে করতে যৌবন চলে যাক। সোনার সময় চলে যাক। কিন্তু হাল ছেড়ো না। তোমার সামনে একটা কোহলি আছে। বলে গেল, তোমার সংকল্প আর তোমার সততার পাশে কিছু না কিছু লোক ঠিক জুটে যাবে। তারা তোমার স্বপ্নের সঙ্গে নিজেদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেবে। মিশিয়ে নেবে। তোমার প্রত্যয়ের ঝুলিতে একটা কোহলি আছে।

Virat Kohli Tata IPL 2025 Royal Challengers Bangalore
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy