সরকারি হিসাবে বর্তমানে প্রায় ২২ লক্ষ বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক বিভিন্ন রাজ্যে কাজ করছেন, যদিও প্রকৃত সংখ্যা ৫০ লক্ষেরও বেশি বলে অনুমান। রাজ্যের দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক দুর্বলতা, অ-লাভজনক কৃষি উৎপাদন এবং পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাবের কারণই এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য করেছে। তার উপরে রয়েছে মজুরি-বৈষম্য। পশ্চিমবঙ্গে যে শ্রমে দৈনিক ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা মেলে, সেই একই শ্রমের জন্য গুজরাত বা দিল্লিতে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পাওয়া যায়। শুধু অদক্ষ শ্রমিক নয়, বাংলার শিক্ষিত যুবকদের কাছেও উচ্চ ও মধ্যম মানের বেতনের চাকরির জন্য দিল্লি, কর্নাটক, তামিলনাড়ু, হরিয়ানা অধিক পছন্দের গন্তব্য।
নিজ ভূমি থেকে ‘স্বেচ্ছা’ বিচ্যুত পরিযায়ীদের ভিন রাজ্যে গিয়েও নানা মাত্রার শোষণ ও নিপীড়নের শিকার হতে হয়। স্থানীয় শ্রমিকরা তাঁদের বিবেচনা করেন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে, কারণ পরিযায়ীদের আগমনের ফলে তাঁদের মজুরি ও সামাজিক নিরাপত্তায় কোপ পড়ে। সুযোগ নেন স্থানীয় নিয়োগকর্তারাও। অধিক মুনাফার জন্য তাঁরা পরিযায়ীদের কম মজুরিতে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে বাধ্য করেন, নিরাপত্তাহীন পরিবেশে রাখেন এবং সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দেন না। সুযোগ বুঝে এই ক্ষোভ এবং টানাপড়েনকে কাজে লাগায় সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ ও রাজনৈতিক ক্ষমতাধর গোষ্ঠীগুলি।
এই প্রবণতা সর্বব্যাপী। ২০০০-এর দশকে মহারাষ্ট্রে ভিন রাজ্য বিরোধী আন্দোলনের সময় প্রথমে শিবসেনা ও পরে রাজ ঠাকরের নেতৃত্বাধীন মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা (এমএনএস) উত্তর ভারতীয় শ্রমিকদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক হয়ে ওঠে, যার শিকার হন দক্ষিণবঙ্গ থেকে যাওয়া শ্রমিকরাও। ২০১৮ সালে গুজরাতে একটি ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া হামলার জেরে উত্তর ভারতীয়দের সঙ্গে বাঙালি শ্রমিকদেরও উচ্ছেদ করা হয়। পূর্বেও, বিশেষত ১৯৮০-র দশকে অসম, ত্রিপুরা-সহ উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে বাঙালিরা বিদ্বেষের শিকার হয়েছিলেন। তবে তখনকার পরিস্থিতিতে বাঙালিরা ছিলেন তুলনামূলক ভাবে শক্ত আর্থ–সামাজিক অবস্থানে। অসমে শিক্ষক, চিকিৎসক, কেরানি থেকে শুরু করে প্রশাসনিক পদে কর্মরত ছিলেন। ত্রিপুরায় শরণার্থী বাঙালিরা জমি ও প্রশাসনিক কাঠামোয় দৃঢ় অবস্থান তৈরি করেন, যা জনজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়।
কিন্তু আজকের পরিযায়ী শ্রমিকরা মূলত গ্রাম-ভিত্তিক, অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল ও অসংগঠিত শ্রেণির মানুষ। নির্মাণ শিল্প, ইটভাটা, মাছ প্রক্রিয়াকরণ, নিরাপত্তারক্ষী, হোটেল-রেস্তরাঁ বা গৃহপরিচারিকার মতো কাজেই বেশি যুক্ত। শ্রেণি ও অর্থনৈতিক অবস্থান এত দুর্বল যে, তাঁদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানো সহজ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতার পরিচিতি, যা ভিন রাজ্যে শ্রমিকদেরও ‘দুর্বল রাজ্যের প্রতিনিধি’ হিসাবে গণ্য করে।
এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি। ভারতের বহু রাজ্যে আধিপত্য বিস্তার করলেও, বাংলায় এখনও তেমন দৃঢ় ঘাঁটি গড়ে তুলতে পারেনি তারা। এর প্রধান কারণ উদারপন্থী নাগরিক সমাজের সতর্ক ভূমিকা এবং মুসলমান সমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ। এই ব্যর্থতা হিন্দুত্ববাদীদের আরও উদ্ধত ও বেপরোয়া করে তুলেছে। ফলে তারা রাজনৈতিক আক্রমণের সহজ টার্গেট হিসেবে বেছে নিয়েছে গরিব বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের, যাঁদের ইচ্ছাকৃত ভাবে বাংলাদেশি, রোহিঙ্গা বা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। যার কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। এর লক্ষ্য এক দিকে মুসলমানদের রাজনৈতিক ভাবে দুর্বল করা, অন্য দিকে বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা এবং বাংলাভাষাকে ‘হিন্দুর বাংলা’ ও ‘মুসলমানের বাংলা’ হিসাবে দ্বিখণ্ডিত করা। এটি আসলে হিন্দুত্ববাদীদের পুরনো ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান’ প্রকল্পেরই বহিঃপ্রকাশ, যার মধ্যে দিয়ে ভাষা, সংস্কৃতি ও পরিচয়কে ধর্মীয় ছকে বন্দি করে রাজনৈতিক ক্ষমতা করায়ত্ত করার পরিকল্পনার দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়।
যখন পুলিশ, প্রশাসন বা ক্ষমতাধর রাজনৈতিক গোষ্ঠী কোনও বাংলাভাষী মানুষ বা গোষ্ঠীকে ‘বিদেশি’ বলে দাগিয়ে দেয়, তখন সেই আক্রমণটা কেবলমাত্র কিছু সংখ্যক মানুষের উপরে সীমাবদ্ধ থাকে না। সেটা হয় বাঙালি জাতিসত্তার রাজনৈতিক অস্তিত্বকেই খাটো ও দুর্বল করার প্রচেষ্টা। এর মধ্যে দিয়ে এমন একটা অবস্থা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যাতে করে মানুষ প্রকাশ্যে নিজের মাতৃভাষা উচ্চারণ করতেও সঙ্কোচ বোধ করেন। বিশেষ করে পরিযায়ী শ্রমিক বা বাংলার বাইরে বসবাসকারী বাঙালির ক্ষেত্রে এই আশঙ্কা প্রবল। পাশাপাশি ভাষা-সঙ্কোচ, শ্রমিক ঐক্যের পক্ষেও মৃত্যুঘণ্টা। এতে যৌথ শ্রমিক দাবি দুর্বল হয়ে পড়বে এবং ক্ষমতাসীনদের শোষণ করা সহজ হবে।
তাই একে কেবল পরিযায়ী শ্রমজীবীদের সমস্যা বলে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। এটি আসলে পুরো বাঙালি জাতিসত্তা— তার ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অস্তিত্বের উপরে আক্রমণ। এই পরিস্থিতিতে, এই আক্রমণকে সার্বিক ভাবে প্রতিরোধ করতে হলে বাঙালি জাতিসত্তার আন্দোলনকে শ্রমিক অধিকারের আন্দোলনের সঙ্গে একীভূত করা জরুরি। ভাষার মর্যাদা ও শ্রমিকের জীবন-জীবিকা— এ দুটোই এক সঙ্গে রক্ষা না করলে কোনওটিই টিকে থাকবে না। অর্থাৎ দরিদ্র ও নিপীড়িত পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য আইনি সুরক্ষা, ন্যায্য মজুরি, সামাজিক নিরাপত্তা ও সংগঠনের অধিকারকে অবিলম্বে রাজনৈতিক দাবিতে পরিণত করতে হবে। এবং এর মধ্যে দিয়েই বিভাজনভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)