আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২ এপ্রিল ঘোষণা করেছিলেন তাঁর শুল্কযুদ্ধের রূপরেখা। তার পর পাঁচ মাস কেটে গিয়েছে। এর মধ্যে আমেরিকার অর্থব্যবস্থায় কোনও গভীর বিপর্যয় ঘটেনি। ত্রৈমাসিক বৃদ্ধির হার ৩%। ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার ২.৭%। নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং জ্বালানি বাদ দিলে মূল্যবৃদ্ধির হার ৩.১%; যদিও তার পাশাপাশি ৪.২% বেকারত্বের হার কিছুটা চিন্তার কারণ। শেয়ার বাজার কিন্তু এখনও রমরমা।
অর্থশাস্ত্রে দু’রকমের নীতি আছে। এক, ভাল নীতি, যাতে সকলের কল্যাণ হয়; এবং দুই, মন্দের ভাল নীতি বা সেকেন্ড বেস্ট। পারস্পরিক শূন্য শুল্ক হল ভাল নীতি। এটি একটি স্বপ্নের পৃথিবীতে হওয়া সম্ভব, যেখানে প্রত্যেকে প্রত্যেকের শুভাকাঙ্ক্ষী। যেখানে বিভিন্ন রাষ্ট্র বাণিজ্য-সংঘর্ষে লিপ্ত, সেখানে মন্দের ভাল নীতি অনুযায়ী কিছু শুল্ক অনিবার্য। এই ধরনের ভূ-রাজনীতিক পরিবেশে প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ মুদ্রা এবং রাজকোষ নীতির কিছু সংস্কারের প্রয়োজন আছে। প্রথম প্রশ্ন হল, আমেরিকা এ বিষয়ে কী ভাবছে?
আমেরিকার শীর্ষ ব্যাঙ্ক ফেডারাল রিজ়ার্ভের দিকে তাকানো যাক। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ব্যাঙ্কের প্রধান জেরম পাওয়েলের দ্বন্দ্ব এখন সর্বজনবিদিত। ট্রাম্প চাইছেন শীর্ষ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমাক, যা এখনও পাওয়েল অগ্রাহ্য করছেন। এই আগ্রাসী আমদানি শুল্ক বলবৎ রাখতে গেলে সুদের হার কমানো জরুরি। উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর উপরে চড়া শুল্ক বসলে উৎপাদনের খরচ বাড়বে। তার উপরে ঋণে সুদের হার যদি না-কমে, অনেক মাঝারি এবং ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
মূল্যবৃদ্ধি হলেই ফেডারাল রিজ়ার্ভ চটজলদি সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। অতিমারির সময়ও একই পথ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এই ধরনের সুদনীতি অচল। শুল্ক বাড়ার জন্য মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে আমদানিভিত্তিক উৎপাদনের খরচ বাড়ানোর কারণে, অতিরিক্ত চাহিদার জন্য নয়। ট্রাম্প ব্যবসায়ী লোক বলে এই সত্যটি উপলব্ধি করেছেন যে, শুল্কযুদ্ধের সঙ্গে সুদের হার বাড়ানো একেবারেই মেশে না। ভারত এই ব্যাপারটি অনেক আগেই আঁচ করে গত জুন মাসে রেপো রেট ০.৫ শতাংশ-বিন্দু কমিয়েছে। ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কও একই সময়ে সুদের হার ০.২৫ শতাংশ-বিন্দু কমিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, মূল্যবৃদ্ধির হার আর মূল্যস্তর অথবা দামকে স্বতন্ত্র ভাবে দেখা উচিত। প্রথমটি হল দ্বিতীয়টির বৃদ্ধির হার। দাম যদি এ বছর গত বছরের দ্বিগুণ হয়ে তার পর আর না বাড়ে, তবে আগামী বছরে মূল্যবৃদ্ধির হার হবে শূন্য— যদিও সব কিছুর দাম হবে দু’বছর আগের দামের দ্বিগুণ। ক্রিস্টিন ফোর্বস, জনগ্রিম হা এবং এম আয়ান কোজ়ের একটি গবেষণাপত্রে জানতে পারছি যে, অতিমারির সময় ফেডারাল রিজ়ার্ভ মূল্যবৃদ্ধি রুখতে সুদের হার আগ্রাসী ভাবে বাড়িয়েছিল। তার ফলে আমেরিকায় মূল্যবৃদ্ধির হার প্রায় ৯% থেকে ২.৪% খুব দ্রুত নেমে এসেছিল। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম প্রায় চিরস্থায়ী ভাবে স্বাভাবিক ভিত্তিরেখা থেকে ১৭% বেড়ে গেল, যা স্বাভাবিক বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধির লক্ষ্যরেখা থেকে ৯% বেশি। আমেরিকাতে এ ধরনের মূল্যবৃদ্ধি সত্তর দশকের পরে আর হয়নি। দাম আর কোনও দিন কমবে বলেও মনে হয় না।
আমেরিকার সাধারণ মানুষ মূল্যবৃদ্ধির হার আর দামকে আলাদা করে দেখেন না। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনে সাফল্যের এটি একটি বড় কারণ। যদিও সরকারি তথ্য অনুযায়ী অতিমারির পর মূল্যবৃদ্ধির হার বাইডেনের জমানাতে অনেক কম ছিল, মূল্যস্তর কিন্তু ভয়ানক বেড়ে গিয়েছিল। জিনিসপত্রের দাম যদি আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে, তা মূল্যবৃদ্ধির হারে তেমন ভাবে ধরা পড়বে না। কিন্তু এর ফলে অর্থনৈতিক কাঠামোতে একটি রক্তক্ষরণ শুরু হবে, যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে। ভোগ্যপণ্যের দাম আর মজুরি যদি একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে না বাড়ে, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাবে।
অতিমারির পর থেকেই আমেরিকার অর্থনীতিতে এই রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গিয়েছে। ট্রাম্পের শুল্কের প্রকোপে এটি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। আমদানি-নির্ভর পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। বিবিসি-র একটি প্রতিবেদনে পাচ্ছি যে, আমেরিকাতে জামাকাপড়, জুতো, কফি, বিয়ার, মদ, গাড়ি, বাড়ির দাম বেড়েছে। যদিও আমেরিকাতে তেলের অভাব নেই, কিন্তু অপরিশোধিত তেল আসে কানাডা আর মেক্সিকো থেকে, যার উপরে ১০% শুল্ক বসেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার শীর্ষ ব্যাঙ্কের মুদ্রানীতির আমূল পরিবর্তন দরকার। সুদের হার বাড়িয়ে প্রথাগত পদ্ধতিতে এই মূল্যস্তর কমানো একটি ভ্রান্ত নীতি। আমদানি শুল্ক আর মূল্যস্তরকে মাথায় রেখে ফেডারাল রিজ়ার্ভের নীতির নয়া রূপায়ণ প্রয়োজন।
এর সঙ্গে সরকারের রাজস্ব নীতির আমূল সংস্কারের প্রয়োজন। শুল্কনীতির জন্য আমেরিকাতে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তাঁদের অনুদানের বন্দোবস্ত করা দরকার। সেটি ট্রাম্পের পক্ষে খুব সহজ হবে না, কারণ বাজেটে বিস্তর ঘাটতি আছে। যদি এই রক্তক্ষরণ বন্ধ না হয়, আগামী নির্বাচনে জনগণ এর প্রতিশোধ নিতে পারেন ব্যালট বাক্সে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)