এক দিকে কর্নেল সোফিয়া কুরেশি। গুজরাতের মুসলিম পরিবারের সন্তান। অন্য দিকে উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিংহ। লখনউয়ের কন্যা, হরিয়ানার পুত্রবধূ। মাঝে বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রী। কাশ্মীরি পণ্ডিত। ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে এক সঙ্গে তিন জন। অনেকেরই মনে হয়েছিল, আহা, এই তো আমাদের ভারত। এটাই তো পাকিস্তান সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে আসল জবাব। কে বলে, ভারতে হিন্দু-মুসলিম এক সঙ্গে থাকতে পারে না!
পহেলগামে পর্যটকদের উপরে সন্ত্রাসবাদী হামলার পরে দিন চারেক আগেই পাক সেনাপ্রধান আসিম মুনির ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ শুনিয়েছিলেন। প্রবাসী পাকিস্তানিদের সম্মেলনে মুনিরের বক্তব্য ছিল, পাকিস্তানের ছেলেমেয়েদের দেশের সৃষ্টির কাহিনি শোনাতে হবে। পাকিস্তান তৈরির কাহিনি কোনও ভাবেই ভুলতে দেওয়া চলবে না। মনে রাখতে হবে পাকিস্তানের আদিপুরুষরা বুঝেছিলেন যে মুসলিমরা হিন্দুদের থেকে সব রকম ভাবে আলাদা। মুনিরের যুক্তি ছিল, “আমাদের ধর্ম আলাদা। প্রথা আলাদা। ঐতিহ্য আলাদা। চিন্তাভাবনা আলাদা। লক্ষ্য আলাদা। সেখানেই দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত। আমরা দু’টি আলাদা রাষ্ট্র। এক নই।”
শব্দগুলো খুব অচেনা ঠেকছিল কি? গত এক দশকে দেশের উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা এই কথাগুলোই উল্টো দিক থেকে বলছেন। ভারত হিন্দুদের দেশ। মুসলিম হলে পাকিস্তানে চলে যাওয়াই শ্রেয়। এই উগ্র হিন্দুত্ববাদের আঁচে গেরুয়া শিবির ও বিরোধী শিবির, দু’পক্ষই নিজেদের সুবিধামতো রাজনীতির রুটি সেঁকার চেষ্টা করেছে। তার প্রভাবে দেশের একটা বড় অংশ এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, ভারতের ২০ কোটির মতো মুসলিম বিদায় নিলেই দেশের অনেক সমস্যা মিটে যাবে। চাকরিবাকরি পেতে, ভাল স্কুলে ভর্তি হতে, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে বাধা থাকবে না। এই আলেখ্য বলে, মুসলিম মানেই জেহাদি, কাশ্মীরি মানেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আর প্রকৃত হিন্দু সে-ই, যার মুসলিম বা কাশ্মীরিদের প্রতি কোনও সহানুভূতি নেই।
সোফিয়া কুরেশি, ব্যোমিকা সিংহ কি রাজনীতির স্বার্থে তৈরি এই সামাজিক ফাটল মেরামত করতে পারলেন? ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে সামরিক বাহিনীর দুই অফিসার যখন সাংবাদিক সম্মেলন করছেন, তখনই হায়দরাবাদে, বিশাখাপত্তনমে করাচি বেকারির সামনে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল— এ দেশের কোনও বিপণিতে কেন পাকিস্তানের আর্থিক রাজধানীর নাম থাকবে? দেশভাগের পরে একটি হিন্দু সিন্ধি পরিবার করাচি ছেড়ে হায়দরাবাদে এসে পুরনো শহরের নামে বেকারি খুলেছিল। তা নিয়ে গত বাহাত্তর বছরে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। তিরঙ্গা হাতে করাচি বেকারির সামনে হল্লা করে কেউ নাম বদলের দাবিও তোলেনি।
চলতি বছরের শেষে বিহারের বিধানসভা নির্বাচন। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মরসুমে বিহারে পাকিস্তান টোলা খবরের শিরোনামে। পূর্ণিয়া জেলার শ্রীনগর ব্লকের পাকিস্তান টোলায় মূলত আদিবাসীদের বসবাস। জনশ্রুতি অনুযায়ী, দেশভাগের পরে মুসলিমরা নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় আদিবাসীদের সব কিছু দান করে গিয়েছিলেন। অনুরোধ ছিল, মহল্লার নাম যেন পাকিস্তান টোলা রাখা হয়। পহেলগামের সন্ত্রাসবাদী হামলার জবাবে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সঙ্গে পাকিস্তান টোলার অস্তিত্বও বিপন্ন। প্রস্তাব এসেছে, তার নাম বদলে বিরসা নগর রাখা হোক।
ভোটমুখী রাজ্যে এই রাজনীতির বিভাজন বেশি। কেরলে বিজেপি শাসিত একটি পুরসভা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নাম আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের নামে নামকরণ করেছে। তাতে কংগ্রেস, সিপিএম আপত্তি তুলেছে। বিজেপি পাল্টা প্রশ্ন তুলেছে সেখানকার একটি রাস্তার নাম জিন্না স্ট্রিট কেন?
নামবদলের এই রাজনীতির সূচনা গেরুয়া শিবিরের শীর্ষনেতৃত্বের হাত ধরেই। ঔরঙ্গজেব রোডের নাম বদলানোর পরে বিজেপি এখন দিল্লির আকবর রোড, হুমায়ুন রোড, শাহজাহান রোডের নামও বদলাতে চায়। উত্তরপ্রদেশে ফৈজ়াবাদের নাম বদলে অযোধ্যা, মোগলসরাইয়ের নাম বদলে পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় জংশন ও ইলাহাবাদের নাম বদলে প্রয়াগরাজ হওয়ার কাহিনি সকলের জানা।
ইতিহাস বদলের দোহাই দিয়ে এই বিভাজনের বিষ কতখানি গভীরে পৌঁছেছে?পহেলগামের সন্ত্রাসবাদী হামলার সবথেকে হৃদয়বিদারক দৃশ্য ছিল, এক সদ্য বিবাহিত দম্পতির দাম্পত্য আচমকা শেষ হয়ে যাওয়ার ছবি। নৌসেনার লেফটেন্যান্ট বিনয় নারওয়ালের গুলিবিদ্ধ দেহ পড়ে রয়েছে। পাশে বসে তাঁর স্ত্রী হিমাংশী। সেই হিমাংশীকেই সমাজমাধ্যমে কদর্য ভাষায় আক্রমণের মুখে পড়তে হল, কারণ পহেলগামের হামলার পরে নতুন করে গোটা মুসলিম সম্প্রদায় ও কাশ্মীরিদের দায়ী করা শুরু হলে হিমাংশী আর্জি জানিয়েছিলেন যেন এই কাজ না করা হয়, সব মুসলমানদের বা কাশ্মীরি জনগণকে যেন দায়ী না করা হয়।
হিমাংশীর জন্য সহানুভূতি আচমকাই হিংস্র আক্রমণে বদলে গিয়েছিল। হিমাংশীকে বিদ্রুপের মুখে পড়তে হয়েছিল। ওই যে ধারণা মনে গেঁথে গিয়েছে— তুমি প্রকৃত হিন্দু হলে তোমার মনে মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতি থাকতে পারে না। শুধুই উগ্র হিন্দু— একটাই পরিচয়। হিমাংশীকে যে শব্দে সবথেকে বেশি আক্রমণ ও কটাক্ষ করা হয়েছিল, তা হল ‘সেকুলার’— ধর্মনিরপেক্ষ।
কোনটা তা হলে আসল ভারত? সামরিক বাহিনীর উর্দিতে পাশাপাশি সোফিয়া ও ব্যোমিকা? নৌসেনার লেফটেন্যান্ট বিনয়ের চিকিৎসার পরে রক্ত দিতে আসা সাধারণ কাশ্মীরি মানুষ? সন্ত্রাসবাদী হামলার পরে মোমবাতি হাতে পহেলগামের স্থানীয় বাসিন্দা? না কি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’-কে গালিগালাজে পরিণত করে ফেলা ফেসবুক-টুইটার-ওয়টস্যাপের উন্মত্ত জনতা? যারা করাচিতে ভারতের সামরিক বাহিনীর হামলা ও হায়দরাবাদের করাচি বেকারিতে হামলাকে একই মনে করে?
‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রী একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। যে ভাবে পহেলগামের হামলা হয়েছে, তাতে জম্মু-কাশ্মীরের সঙ্গে গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক অশান্তি তৈরির লক্ষ্যও ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার ও দেশের মানুষ সেই ষড়যন্ত্র সফল হতে দেয়নি। অথচ ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ বিরতি ঘোষণা করার পরে সেই বিক্রম মিস্রীকেই হিমাংশী নারওয়ালের মতো নেট-দুনিয়ার উগ্র জাতীয়তাবাদীদের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে।
পহেলগামের হামলার পিছনে ভারতে সাম্প্রদায়িক অশান্তি তৈরির ছকের কথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও বলেছেন। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর বিরতির পরে প্রধানমন্ত্রী মনে করিয়ে দিয়েছেন, পহেলগামে সন্ত্রাসবাদীরা পর্যটকদের খুন করার আগে ধর্ম জিজ্ঞাসা করেছিল। সাম্প্রদায়িক অশান্তি তৈরির এই লক্ষ্য ব্যর্থ করে দিয়েছে সরকার। প্রশ্ন ওঠে, দেশের উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা যে নিয়মিত সাম্প্রদায়িক অশান্তি তৈরির চেষ্টা করে চলেছে, নরেন্দ্র মোদীর সরকার কি তা-ও একই ভাবে ব্যর্থ করে দেবে? না কি সোফিয়া কুরেশি ও ব্যোমিকা সিংহের এক সঙ্গে সাংবাদিক সম্মেলনের ছবি স্রেফ প্রতীকী হয়েই থেকে যাবে?
সন্ত্রাসবাদের জবাবে সেনা অভিযানের নাম ‘অপারেশন সিঁদুর’ রাখাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। মোদী নিজেই বলেছেন, সন্ত্রাসবাদীরা ভারতের কন্যা, বোনদের মাথার সিঁদুর মুছে দিয়েছিল। তাই ভারতের সেনা পাকিস্তানের ভিতরে ঢুকে সন্ত্রাসবাদীদের সদর দফতরে হামলা চালিয়েছে।
এতে কোনও ভুল নেই ‘অপারেশন সিঁদুর’ নরেন্দ্র মোদীর মহিলা ভোটব্যাঙ্ক আরও মজবুত করবে। তার সুফল তিনি বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে পাবেন। হয়তো তার পরে বাংলা, অসম, কেরল, তামিলনাড়ুর বিধানসভা ভোটেও। কিন্তু তাঁর আসল চ্যালেঞ্জ হয়তো অন্যত্র। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হিন্দু-মুসলমান এক সঙ্গে থাকতে পারে না বলে দাবি করছেন। আসিম মুনিরের হাত ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতেও যাতে নতুন করে দ্বিজাতি তত্ত্বের বিষ শিকড় ছড়াতে না পারে, তা নিশ্চিত করাই আসল পরীক্ষা। বিজেপি শীর্ষনেতৃত্ব কি সেই চেষ্টা করবেন? না কি ভোটের স্বার্থে মেরুকরণ ও বিভাজনের রাজনীতি আঁকড়ে ধরবেন?
কর্নেল সোফিয়া কুরেশি ও উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিংহের পাশাপাশি ছবি প্রতীকী হয়েই থেকে যাবে কি না, সেটাই এখন দেখার।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)