নবারুণ ভট্টাচার্যের কুকুর-উপকথা লুব্ধক। কলকাতা থেকে পথকুকুরদের সরানোর অভিযান চলছে। কুকুররা ভয়াবহ যন্ত্রণায় আছে। তারই মধ্যে তারা নিজেদের এজেন্সি ঘোষণা করে, তাদের মহাবৈশ্বিক প্রতিরূপ কুকুর-তারা লুব্ধকের নির্দেশে। লুব্ধক খবর পাঠিয়েছে, শিগগিরি গোটা শহরটাকেই সে ধ্বংস করে দেবে। তার আগে কুকুররা যেন সবাই শহর ছেড়ে চলে যায়। এই কুকুররা অনেকটাই রূপক। ক্ষমতাবান মানুষদের হাতে মানুষ-সহ প্রান্তিক প্রাণীদের অসহায়তার (এবং প্রতিবাদেরও)। মানুষের উদ্ধত অসংবেদনা কী ভাবে মানুষেরও ধ্বংস ডেকে আনছে, তারও ইঙ্গিতবাহী। সম্মানার্হ বিদেশি অতিথিদের আগমনে পথবাসী বা ঝুপড়িবাসী মানুষদের শহর থেকে উচ্ছেদ বা সাময়িক পাঁচিল তুলে অদৃশ্য করে দেওয়ার মতো ঘটনাও তো প্রায়শ ঘটে (দু’বছর আগে দিল্লিতে জি২০ বৈঠক স্মর্তব্য), ওরা মানবসমাজের ভিতরকার ‘নেড়ি’ কিনা। কাউকে অদৃশ্য করে দিতে পারলে তার প্রতি আর আমাদের দায়িত্বও থাকে না।
মানুষ বরাবরই অন্য প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুর, নিজেদের মধ্যে যাদের ‘অপর’ মনে করে তাদের প্রতিও। উত্তর-মানবতাবাদী চিন্তকরা, পশু-অধিকারের প্রবক্তারা, সাহিত্যিকরাও দুইয়ের সমান্তরালতা লক্ষ করেছেন। মানুষ যে সমস্ত প্রজাতির মধ্যে নৃশংসতম, এমনকি স্বপ্রজাতির প্রাণীদের হননে অধিকাংশ প্রজাতির মধ্যে যে প্রতিবন্ধকতা থাকে মানুষের যে তাও নেই, এটা বিজ্ঞানও আজ বলছে।
আসলে সংস্কৃতির প্রবল তাড়নায় নিছক প্রাণশীলতা, তার আনন্দ-যন্ত্রণা মানুষের কাছে তুচ্ছ। তাই আবেগের দিক থেকে মানুষেরই সমতু্ল, বুদ্ধিবৃত্তিতেও যথেষ্ট উন্নত স্তন্যপায়ীদেরও আমরা রেয়াত করি না। মানুষের ঘনিষ্ঠতম সহপ্রজাতি কুকুর— কৃষি ও পশুপালনেরও আগে শিকারিজীবন থেকেই যারা মানুষের বিশ্বস্ত সঙ্গী— তাদেরও না। নৃশংসতার ভিত্তিতেই তো গড়ে উঠেছে আমাদের সভ্যতা। আধুনিকতা পশুদের প্রতি মানুষের আচরণ আরও প্রতিকূল করে তুলেছে। পাশ্চাত্যে অষ্টাদশ শতক থেকেই বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য কুকুর-সহ অজস্র পশু নিধন চলতে থাকে। অবশ্য তারা পথকুকুর। উল্টো দিকে, এলিট পরিবারে গৃহপালিত কুকুর-বিড়াল খুবই সোহাগি হয়ে ওঠে আধুনিক যুগেই। উদাসীনতা বা নিষ্ঠুরতায় ভারসাম্য আনার জন্য কিঞ্চিৎ সেন্টিমেন্টালিজ়ম তো মানুষের স্বভাবগত। তবুও স্বীকার করতে হবে, পোষ্যদের প্রতি ভালবাসা না-মানুষদের প্রাণের মর্যাদা আর ব্যক্তি হিসাবে অস্তিত্বের একটা স্বীকৃতি বটে। দেহ-মনের দ্বৈততায় বিশ্বাসী সপ্তদশ শতকীয় দার্শনিক রেনে দেকার্ত একমাত্র মানুষকেই মন-মননের অধিকারী আর পশুদের যন্ত্রবৎ বলে ঘোষণা করেছিলেন এবং এই ভাবে পশু-নিপীড়নের যুক্তি জুগিয়েছিলেন; তিনিও কিন্তু তাঁর পোষ্য সারমেয় মঁসিয় গ্র্যাট-কে ভালবাসতেন। তবে হ্যারিয়েট রিটভো দেখিয়েছেন, ভিক্টোরিয়ান সমাজের উঁচু-নিচু ভেদের দৃঢ়মূল চেতনা কুকুরদের (ও ঘোড়াদের) মধ্যে শ্রেণিবিভাজনেও প্রতিফলিত হয়। ব্রিডারদের কাছে ‘ব্লু বুক’ আর পেডিগ্রি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আমাদের সমাজেও তো বরাবর দেখে এসেছি বিদেশি কুকুরদের কদর, দেশজদের প্রতি অবজ্ঞা; যদিও বুদ্ধিতে, সংবেদনায়, ভালবাসায় দেশজরা যে বিদেশি কুকুরদের চেয়ে কম যায় না, সেটা বারে বারে প্রমাণিত। এ দেশে অবশ্য জাতিভেদ প্রথা ও তৎসংশ্লিষ্ট অশুচিতার ধারণা অনুযায়ী সব কুকুরই ঘৃণ্য। কুকুর চণ্ডালের সঙ্গী। পথকুকুর তো সর্বাধিক নিকৃষ্ট। প্রেমচন্দের ‘দুধকা দাম’ গল্পটিতে তাই সবার কাছে লাঞ্ছিত এক অনাথ ভাঙ্গি বালকের একমাত্র অবলম্বন হয়ে ওঠে একটি দীন কুকুর।
সাহিত্যে যে-হেতু সমমর্মিতা ও সহানুভূতি সম্পন্ন কল্পনা দিয়ে অন্যকে বোঝার চেষ্টা থাকে, দেশি কুকুর প্রায় সব ক্ষেত্রেই দামি পেডিগ্রিড কুকুরের উপর জিতে যায়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ডগি অ্যালসেশিয়ান নয়’, ‘সুকু ও ভুকু’, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পিন্টু’, দিব্যেন্দু পালিতের ‘ভুলি’, এ ছাড়াও লীলা মজুমদার, গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, নবনীতা দেব সেনের বহু গল্প মনে পড়ে। গল্পগুলিতে ‘সভ্য’ এলিট পুরুষদের তুলনায় সভ্যতার কমবেশি প্রান্তে অবস্থিত শিশুদের, মেয়েদের (বিশেষত গৃহপরিচারিকাদের) এবং জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষদের কুকুরদের প্রতি সহানুভূতিশীল দেখানো হয়। অধিকাংশ গল্পে মানুষের দিক থেকে কুকুরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হয় কোনও শিশুর প্রচেষ্টায়। শিশুরা যে-হেতু পুরোপুরি সামাজিকীকৃত নয়, প্রকৃতি ও প্রাণিজগৎ থেকে বিচ্ছিন্নতার বোধ তাদের কম। বয়স্কদের মূল্যবোধেও তারা শামিল নয়। গল্পগুলিতে তারা প্রায়শ রাস্তার কুকুরকে বাড়িতে এনে তাকে পুষতে বাধ্য করায় বড়দের। হয়তো কুকুরের কোনও গুণ, বিশেষত চোর-ডাকাত থেকে রক্ষায় তাদের ভূমিকা, বড়দের বিরূপতা প্রশমিত করে। এই কুকুররা প্রায়ই তাদের প্রতি মানুষের মনোভাবে মানবসংস্কৃতির স্ববিরোধিতা তুলে ধরে। পথকুকুরের অস্তিত্ব তো সভ্যতা আর সভ্যতা-বহির্ভূত জগতের সীমারেখায়। তাই বড়রা তাদের প্রশংসাযোগ্য গুণের স্বীকৃতি দিলেও ঠিক আপন ভাবতে পারে না। লীলা মজুমদারের গল্প ‘ভৌ ভৌ ইয়াপ ইয়াপ’-এ দু’টি মা-মরা কুকুরছানার প্রতি দুই অনাথ ভাইবোনের সমমর্মিতা। রাস্তা থেকে তাদের কুড়িয়ে এনে বামুনদিদি আর দিদাকে যদি বা তাদের পুষতে রাজি করানো গেল, অভিজাত মেজাজের দাদুর চোখের আড়ালে লুকিয়ে রাখতে হয়। তারা বলাবলি করে, দাদু এত স্বদেশি, গিলে-করা পাঞ্জাবি, কস্তাপেড়ে ধুতি ছাড়া পরেন না, তবু বিলিতি কুকুরদের প্রতি তাঁর প্রীতি আর দেশিদেরউপর রাগ কেন!
বাস্তবেও কুকুরের বুদ্ধিমত্তা, সাহস, সংবেদনা এবং মানুষের প্রতি অনুরক্তির দৃষ্টান্ত প্রচুর। সবাই যে তারা খুব উঁচু জাতের কুকুর তা নয়। মনে পড়ে, ‘আরোগ্য’ পর্বের সঙ্গী বঙ্গজ ভক্ত কুকুরটিকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা— ‘বাক্যহীন প্রাণীলোক মাঝে/ এই জীব শুধু/ ভালো মন্দ সব ভেদ করি/ দেখেছে সম্পূর্ণ মানুষেরে;/ ...আমারে বুঝায়ে দেয়— সৃষ্টি মাঝে মানবের সত্য পরিচয়।’ দার্শনিক এমানুয়েল লেভিনাস নাৎসি জার্মানির ক্যাম্পবন্দি জীবনের স্মৃতিচারণ করে ববি নামে একটি কুকুরের কথা বলেছেন। সেও কিছু উঁচু জাতের কুকুর নয়। সে বন্দিদের কাছে এসে লাফালাফি, ডাকাডাকি করত; আদর কাড়ত। লেভিনাস বলেছেন, যেখানে মানুষরাই বন্দিদের মানুষ বলে মনে করত না, নিজেদেরও আর মানুষ বলে মনে হত না, শুধু ববিই তাদের মনে করিয়ে দিত যে তারা মানুষ। মানুষের নীতিবোধ নিয়ে তাঁকে গভীর ভাবে ভাবায় কুকুরটি।
কিন্তু আমাদের নৈতিকতায় যে বরাবরই প্রজাতিগত পাঁচিল তোলা, সেটা আমাদের গভীর যুক্তিহীনতার সঙ্গে যুক্ত। পথকুকুরদের থেকে মানুষের আতঙ্কের কারণ তো আছেই। সে কি মানুষের থেকে মানুষের আতঙ্কের চেয়েও ভয়ঙ্কর? কুকুরের কামড়ে মৃত্যু এবং মানুষের হাতে মানুষ খুনের কোনও তুলনামূলক পরিসংখ্যান আছে কি? কুকুররা কি মানুষের থেকেও বেশি করে পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী? সর্বোপরি, কোনও সম্ভাব্য বিপদের মোকাবিলার জন্য কি অসংবেদী হওয়া নিতান্তই প্রয়োজন? পথকুকুরদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে, চিকিৎসা, টিকাকরণ, নিবীর্যকরণ করে তাদের সুস্থ জীবনের ব্যবস্থা সভ্যতার দায়িত্ব নয়? সদিচ্ছা থাকলে সে কাজ কি অসম্ভব? অধিকাংশ কুকুরপ্রেমীও দেখি শুধু তাদের খেতে দিয়েই আত্মতৃপ্ত থাকেন, তার বেশি দায়িত্ব ক’জন নেন?
আসলে ‘জ্ঞানী মানুষ’ বোধ হয় মোটের উপরে অসাম্য, আধিপত্য, উৎপীড়নকেই সভ্যতার ভিত্তি করতে চায়। হৃদয়বত্তা যেটুকু আমাদের আছে, তাকে যথাসম্ভব ধ্বংস করাই হয়তো বাঞ্ছনীয়। পথকুকুরদের থেকে মানবশিশুদের সুরক্ষার যুক্তি ইদানীং খুব শুনি। অনেকের কাছেই হয়তো আরও বড় যুক্তি আছে— বাজারে মুরগি-কাটা, ছাগল-কাটার দৃশ্য শিশুদের দেখানোই যথেষ্ট নয়, একেবারে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে পথকুকুরগুলিকে টেনে হিঁচড়ে, আহত করে তুলে নিয়ে গেলে, সঙ্কীর্ণ খাঁচায় মুরগির মতোই তাদের মৃত্যুর প্রতীক্ষায় রেখে দিলে, তা দেখে মানবশিশুরা সভ্যসমাজের আরও উপযুক্ত হয়ে উঠবে। ‘অপরায়িত’ মানুষদের উপরেও দাপট দেখানো, দাবিয়ে রাখার মতো যথোচিত আগ্রাসন তাদের মধ্যে তৈরি হবে। ২০০৭ সালে অতি উন্নত শহর বেঙ্গালুরুতে পুরসভা ও উন্মত্ত জনতার যৌথ প্রয়াসে কুকুরদের গণনিধন তো এ ব্যাপারে আরও দারুণ দৃষ্টান্ত রেখেছিল। ধন্য আমাদের সভ্যতা!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)