দক্ষিণ অতলান্তিক মহাসাগরের সাউথ জর্জিয়া দ্বীপে কয়েকশো কিং পেঙ্গুইনের সামনে দাঁড়ানো দু’টি সাদার্ন এলিফ্যান্ট সিলশাবকের একটি ফিরে তাকাল ঠিক ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে। সেবাস্তিয়াও সালগাদো (১৯৪৪-২০২৫)-র বিখ্যাত বই জেনেসিস-এর মনকেমন করা ছবি। আজ যখনই দেখি, জলবায়ু পরিবর্তনে মানুষের ভূমিকার কথা ভেবে মাথা হেঁট হয়ে আসে। পাণ্ডববর্জিত প্রত্যন্ত দ্বীপের হাজার হাজার প্রাণীর সঙ্গে সেতু গড়ে দেয় মুহূর্তে, ঘা দেয় মানবজন্মের অহঙ্কারে। সাদা-কালোর আলো-আঁধারিতে সেই সিলশাবকের অভিব্যক্তির ব্যঞ্জনা আরও বাঙ্ময়। এখানেই সালগাদোর ছবির আবেদন, তাঁর স্বকীয় ঘরানার ছাপ। ছবি যেন মন নিংড়ে নেয়, থমকে যেতে হয়। তবু ফিরতেও হয়, আরও দেখার অমোঘ টানে।
সালগাদোকে নিছক ব্রাজ়িলীয় চিত্রসাংবাদিক বললে ভুল হবে। ‘প্ল্যানেটারিটি’ শব্দটা তাত্ত্বিক চর্চায় চালু হওয়ার আগেই সালগাদো প্ল্যানেটারি-ভাবে ভেবেছেন। আবার ব্রাজ়িলীয় বলেই তাঁর প্রেক্ষিত তথাকথিত অনুন্নত বিশ্বের প্রতি সহমর্মী। অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তরের পর ১৯৬৯-এ পিএইচ ডি শুরু প্যারিসে। ছাত্রাবস্থায় একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার জেরেও ভুগেছেন, পাসপোর্ট-হারা হয়ে দেশে ফিরতে পারেননি এক দশক। ১৯৭০-এর গোড়ার দিকে ফোটোগ্রাফিতে নিজ ‘প্রতিভা’ আবিষ্কার করেন স্ত্রী লেইলিয়ার ক্যামেরায় ছবি তুলতে গিয়ে। এর পর ইন্টারন্যাশনাল কফি অর্গানাইজ়েশন-এর অর্থনীতিবিদ হিসাবে আফ্রিকা ভ্রমণ, পাশাপাশি ছবি তোলা। ক্রমে এলেন এই প্রশ্নে: অর্থনীতিবিদ না আলোকচিত্রী, কী হবে পেশা? সিগমা এজেন্সি-র হয়ে পর্তুগাল ও পর্তুগিজ়ভাষী আফ্রিকায়, তার পর গামা-র হয়ে পুরো ইউরোপ, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা জুড়ে ছবি তুলতে থাকলেন। ১৯৭৯-তে চিত্রসাংবাদিকতা শুরু অঁরি কার্তিয়ের-ব্রেসঁ, রবার্ট কাপা, জর্জ রজার ও ডেভিড সিমুরের স্থাপিত ‘ম্যাগনাম’-এর হয়ে।
আলোকচিত্র-জগৎ যেমন মনে রাখবে সালগাদোর দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের ফসল— সাহেল, ওয়ার্কার্স, মাইগ্রেশনস, জেনেসিস, অ্যামাজ়নিয়া— তেমনই রোনাল্ড রেগনের উপর আততায়ীর আক্রমণের কিছু ছবিও। ১৯৮১-র মার্চে ওয়াশিংটন ডিসিতে শিল্পোদ্যোগীদের উদ্দেশে রেগনের ভাষণ কভার করতে যান সালগাদো। ধার করে পরেছিলেন বেঢপ, বড়সড় স্যুট। অস্বস্তিতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন অনুষ্ঠান শেষের আগেই। প্রেসিডেন্ট বেরোতেই তাঁকে অনুসরণ করতে করতে আক্ষরিক অর্থেই সালগাদো বন্দুকের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। ফলে এমন কিছু ছবি পেয়ে যান, যা তোলার জন্য ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় ছিলেন শুধু তিনিই।
ম্যাগনাম-এ পনেরো বছর যুক্ত থাকার পর ‘অ্যামাজ়নাস ইমেজেস’ তৈরি করেন লেইলিয়ার সহযোগিতায়। প্রথম থেকেই তাঁর ছবির সঙ্কলনের বিন্যাস ও সামগ্রিক পরিবেশনার তত্ত্বাবধায়ক লেইলিয়া, দু’জনের যুগলবন্দির ফল অনবদ্য। ব্রাজ়িলের রিয়ো দোচে উপত্যকায় পারিবারিক খামারের দায়িত্ব নিতে হয় ১৯৯০-এ, পরিবারের স্বার্থে। তখন সেখানে রেনফরেস্ট প্রায় বিনষ্ট। লেইলিয়ার প্রস্তাবে পুনরায় বনায়নের সঙ্কল্প নিয়ে এগিয়ে যান সালগাদো। ১৯৯৮-এ প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইনস্তিতুতো তেরা’, বনসৃজন, জলসম্পদ সংরক্ষণ ও এই বিষয়ে স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতা প্রসারে।
এক সাক্ষাৎকারে সালগাদো বলেন, মর্ম স্পর্শ করাই তাঁর ছবির লক্ষ্য। হয়তো সে জন্যই তাঁর ছবির প্রদর্শনী চোখের জল থেকে চরম আপত্তি, সব রকম প্রতিক্রিয়া জাগায়। দুর্ভিক্ষকবলিত আফ্রিকা, সেরা পেলাদা-র সোনার খনি বা জেনেসিস-এর ছবির মধ্যে যদি কোনও সূত্র খুঁজতে হয়, তবে তা সালগাদোর লেন্সে ধরা দেওয়া মানুষ, প্রকৃতি ও প্রাণিজগতের ভঙ্গুরতা। আপত্তি মূলত এটাই— আলো-আঁধারির শৈলীতে মানুষের অসহায়তাকে বিরাট ক্যানভাসে উন্মোচিত করেন তিনি, আর ছবি বিকোয় ‘কালেক্টর’স আইটেম’-এর দরে। এক-এক জায়গায় মাসের পর মাস থেকে, বিষয়ের সঙ্গে যথাসম্ভব নৈকট্য ও একাত্মতা গড়াই তাঁর শৈলীর ভিত্তি। দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ যত ক্ষণে ক্যামেরার সামনে এসেছেন, খনি-শ্রমিকরা দেখছেন তাঁদের রক্ত জল করা শ্রম সালগাদোর লেন্সবন্দি হচ্ছে, তত ক্ষণে তাঁরা হয়ে উঠেছেন প্রকল্পের স্বেচ্ছা-অংশীদার।
রিক্ত রেন-ফরেস্টে স্থানীয় গাছ লাগিয়ে সালগাদো দম্পতি দেখেন প্রকৃতির নিজ ক্ষত ধীরে ধীরে সারিয়ে লুপ্ত জীববৈচিত্র ফিরিয়ে আনার আশ্চর্য ক্ষমতা। এই চেতনা থেকেই জন্ম জেনেসিস-এর। দিগ্বিদিক ঘুরে সংগ্রহ করা ছবির দুর্মূল্য রত্নসম্ভার: উত্তর অ্যান্টার্কটিকার প্রান্তরময় চিনস্ট্র্যাপ পেঙ্গুইনের কলোনি বা ফকল্যান্ড আইল্যান্ডসের পশ্চিম প্রান্তে পৃথিবীর বৃহত্তম আলবাট্রস কলোনির ছবিতে স্পষ্ট জীবজগৎ ও প্রকৃতির পরিপূরকতা; দক্ষিণ সুদানের গোধূলিতে প্রকৃতি, পশু ও মানুষের পরস্পরনির্ভরতা। যত দূর চোখ যায়, শুধু মানুষ ও গরুর শিং— ধুলোর আবছায়ায় স্পষ্ট, কম স্পষ্ট, প্রায় বিলীন। ধূসরতার নানা স্তরে এই ছবি যেন মনে করিয়ে যায়, অন্য সব প্রাণীর মতোই মানুষও একটি প্রাণী, এ দিক থেকে ও দিক হলেই এই ভারসাম্যের চিত্রে চিরযবনিকা অবশ্যম্ভাবী।
ইংরেজি বিভাগ, স্বর্ণময়ী যোগেন্দ্রনাথ মহাবিদ্যালয়
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)