মে ২০২৫। গোটা ভারত যখন ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছোট রাজ্য অসমও তখন আবার জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে আলোচনায় উঠে আসে। প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের দৌলতে অসমে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’, ‘বিদেশি’, ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ ইত্যাদি শব্দ জলভাত হয়ে গেছে। কিন্তু, মে মাসের পর থেকে আরও দুটো শব্দ অসমের বাঙালি জনমানসে আতঙ্কের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ‘পুশব্যাক’ বা অসমের সীমান্ত প্রদেশ দিয়ে বাংলাদেশে গলাধাক্কা ও ‘এভিকশন’ বা সরকারি জমিতে তথাকথিত অবৈধ দখলদারদের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই দুটো বিষয় কি পরস্পর সংযুক্ত, না কি বিচ্ছিন্ন?
মাঝের কয়েক মাসে ‘বাঙালি মানেই বাংলাদেশি’, এই ভাবনা থেকে সারা ভারতে, বিশেষ করে কিছু বিজেপিশাসিত রাজ্যে মুখের ভাষা বাংলা শুনে, বাঙালিদের নিপীড়নের খবর পড়েছি বেশ কয়েক বার। বাংলা এবং বাঙালির ক্ষেত্রে এই ভাষিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে স্বর তুলেছেন অনেক রাজনীতিবিদ থেকে তথাকথিত রথী-মহারথীরাও। কিন্তু তাতে বিশেষ ভাবে উঠে আসেনি অসমের প্রসঙ্গ। বিশেষত যেখানে ধর্ম-জাতি এবং ভাষার কারণে অসমের হিন্দু বাঙালিরা, এবং তার থেকেও বেশি বাঙালি ‘মিয়া মুসলমান’রা রোজকার ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন গত কয়েক দশক ধরে। ভারত-বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে নতুন করে ক্রমপরিবর্তনশীল কূটনৈতিক সম্পর্ক, তার সঙ্গে অসমের ভৌগোলিক অবস্থান, অসমের ভাষিক এবং ধর্মীয় প্রান্তিক/সংখ্যালঘুদের সঙ্কট কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের সঙ্গে ২৬২ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত ভাগ করে নেওয়ার ফলে ১৯৪৭ সালের পর থেকে অসমে বাঙালিদের হয়রানি বিরাট জটিল সমস্যা। এই সমস্যা ঐতিহাসিক ভাবে জাতিগত-ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতি এবং আর্থ-সামাজিক গতিশীলতার সংমিশ্রণ দ্বারা পরিচালিত হয়। কিন্তু গত বছরের জুলাই মাস থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসাবে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ভাঙা-গড়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার ফলে, অসমে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশ’-এর ভয় আবার নতুন করে বেড়েছে। শোনা গিয়েছে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভঙ্গুর সীমান্ত অতিক্রম করে, প্রতিবেশী দেশ থেকে আওয়ামী লীগের সমর্থক বহু মুসলমান বাংলাদেশি, এবং অনেক হিন্দু পরিবার ধর্মীয় ও সামগ্রিক নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচতে ভারতে পালিয়ে এসেছেন। এ সব তথ্য কতটা ‘মিথ’, কতটা সত্যি, তার কোনও প্রমাণ নেই।
অসমের রাজনীতিতে কয়েক শতাব্দী ধরে বাঙালি-অসমিয়া গোষ্ঠী, হিন্দু-মুসলমান অসমিয়া-বাঙালিদের মধ্যে অর্থনৈতিক বিদ্বেষ-সহ, অনেক রকম সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মেরুকরণের সমস্যা ছিল। তার উপরে এখন নতুন দু’রকমের উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। এক, বাংলাদেশ থেকে অসমে বাঙালিদের (মুসলমান বাঙালিদের) ‘অবৈধ অভিবাসন’-এর কারণে জনসংখ্যাগত ভারসাম্যে ব্যাঘাতের শঙ্কা, এবং দুই, তথাকথিত অনাগরিক, ভুঁইফোঁড় বাঙালি মিয়া মুসলমানদের দখল করা সরকারি জমি থেকে তাঁদের উচ্ছেদের প্রয়াস।
মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মিডিয়ায় ‘পুশব্যাক’ শব্দের ঘন ঘন ব্যবহার, ভারতে বাংলাদেশি হিসাবে আটক করা মানুষদের বহিষ্কারের খবর উঠে আসছে। শোনা গেছে, শুধু অসমে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসাবে প্রমাণিত মানুষরা নন, অনেক ক্ষেত্রে ভারতের বিভিন্ন বড় শহর থেকে বাঙালি হিসাবে ধরা পড়ার পর প্রান্তিক শ্রমিক শ্রেণির মানুষদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী কাছাড়, শ্রীভূমি এলাকা, ধুবুড়ি ও দক্ষিণ সালমারা-মানকাচর জেলায় নাকি রাতের অন্ধকারে, অসম-বাংলাদেশ বর্ডারের মাঝের ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এ ছেড়ে আসা হয়েছে। অসমের রাজ্য সরকার যুক্তি হিসাবে বলেছে, এই অভিযানগুলি ‘অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী’দের আক্রমণ থেকে আদি বাসিন্দাদের রক্ষা করার জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়।
ভূমির দখল-জনিত দ্বিতীয় সঙ্কটের ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা সরকারের নীতির মূল ভিত্তি হল ১৮৯১ সালের অসম বন নিয়ন্ত্রণের আইন। তিনি যুক্তি দিয়েছেন, পরিবেশগত ভারসাম্য, আদিবাসী অধিকার রক্ষা এবং অবৈধ কার্যকলাপ রোধের জন্য জমি পুনরুদ্ধার অপরিহার্য। অভিযোগ এই যে, সরকারি বনভূমি, চারণভূমি এবং ‘সত্র’ জমি (বৈষ্ণব মঠ) দখল করা হয়েছে, তাই এই অবৈধ জমি দখলের বিরুদ্ধে সরকারি পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে। হিমন্তবিশ্ব শর্মা বলছেন— এই ‘মুসলমান অভিবাসন’-এর পিছনে আছে অসমিয়াদের সংখ্যালঘু করার একটা গোপন ষড়যন্ত্র।
এ বারের উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে গোলাঘাট, ধুবুড়ি, গোয়ালপাড়া, লখিমপুর, দরং, কামরূপ, নলবাড়ি, কোকরাঝাড় এবং কার্বি আংলং জেলায়। এখনও পর্যন্ত কম করে ৬০০০-এর বেশি বাংলাভাষী মুসলিম পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, তাঁদের ভোটাধিকারও খর্ব করা হয়েছে। বাস্তুচ্যুত মানুষদের বক্তব্য, রাজ্য জুড়ে নদী ভাঙনের ফলে বা বন্যার কারণে ঘরবাড়ি হারিয়ে তাঁরা সরকারি মালিকানাধীন এই জমিগুলো এক সময় দখল করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু উচ্ছেদের পর তাঁদের কোনও পুনর্বাসন দেওয়ার ব্যবস্থা হয়নি, উপরন্তু অসম-নাগাল্যান্ড সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে নির্দেশ জারি করা হয়েছে— উচ্ছেদের ফলে বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো যেন এই অঞ্চলে ঢুকতে না পারে।
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা এই ‘ভূমি জেহাদ’ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, গত চার বছরে, অসমে ১.২৯ লক্ষ বিঘা (৪২,৫০০ একরের বেশি) দখল করা জমি থেকে অন্তত ৫০,০০০ বাসিন্দাকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, কিন্তু তবুও প্রায় ২৯ লক্ষ বিঘা (৯.৫ লক্ষ একরেরও বেশি) দখলদারিতে থেকে গেছে। তাই উচ্ছেদ চলবে। আবার কংগ্রেস এবং সর্বভারতীয় সংযুক্ত গণতান্ত্রিক মোর্চা (এআইইউডিএফ)-র মতে, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ কর্পোরেট বৃহৎ ব্যক্তি ও তাঁদের সংস্থা মূলত বিদ্যুৎ এবং শিল্প প্রকল্পের জায়গা তৈরি করার জন্যই অভিবাসী মুসলিমদের লক্ষ্যবস্তু করছে। কংগ্রেস প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে অসমে তারা ক্ষমতায় এলে, বুলডোজ়ার দিয়ে বাসস্থান ভাঙা এই অসহায় পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
২০২৬-এর নির্বাচন আসতে আরও বেশ কয়েক মাস বাকি, কিন্তু তার মূল ভিত্তি তৈরি হয়ে গেছে। এক দিকে, অসম বিধানসভার এক বিশেষ এক দিনের অধিবেশনে হিমন্তবিশ্ব শর্মা ১৯৫০ সালের অভিবাসী নামের একটা পুরনো আইন প্রয়োগ করার কথা ঘোষণা করেছেন, যাতে ‘বিদেশি ট্রাইব্যুনাল-কে না জড়িয়ে, বহিরাগতকে চিহ্নিত করে, ‘পুশব্যাক’ আরও তীব্র করা যায়। আবার অন্য দিকে, এই মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে ভূমি পুনরুদ্ধার ও পরিচয় রাজনীতি শুরু হয়েছে, তার মধ্যেও যে ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনী কৌশল ঢুকে পড়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ২০১৯ সালের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি-তে বাদ পড়া ১৯ লক্ষের বেশি মানুষের মধ্যে, বাঙালি হিন্দুদের নাগরিকত্বের পথ দাবি করার তবু একটা সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ তার পরবর্তী সময়ে, সিএএ বা নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে পরিষ্কার সঙ্কেত দেওয়া হয়েছে যে, বাঙালি মুসলমানদের আসলে অসমে কোনও রক্ষাকবচ নেই, আর তাই তাঁরা সর্বার্থেই বিদেশি তকমার ‘উপযুক্ত’।
২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে যদি শেষ অবধি কংগ্রেস এবং এআইইউডিএফ আলাদা ভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, তা হলে মুসলিম ভোটের উল্লেখযোগ্য বিভাজন ঘটবে, যা অসমের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৫%। এই বিভাজন অনিবার্য ভাবে বিজেপির পক্ষে ভাল হবে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা এবং বরাক উপত্যকায় অসমিয়া এবং বাঙালি হিন্দু ভোট তাতে আরও বেশি করে একত্রিত হবে। এনআরসি থেকে বাদ পড়া এবং সিএএ-র সুরক্ষা ছাড়া, বাঙালি মুসলমানদের হয় ‘গলাধাক্কা’ বা ‘উচ্ছেদ’ করার অভিযান তাঁদের গভীর বাস্তুচ্যুতি এবং রাষ্ট্রহীনতার দিকে আরও বেশি করে ঠেলে দিতে পারে।
অসমে এনআরসি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরির মাধ্যমে শুরু হওয়া ‘রাষ্ট্র বনাম নাগরিক প্রান্তিকতা’র পরিণাম এবং সংখ্যার রাজনীতি নামক সংঘাতের শেষ অঙ্ক দেখা— এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
ইতিহাস বিভাগ, ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)