বিদ্যা বলো, টাকা বলো, প্রতাপ বলো, ধর্ম বলো, মানুষের যা-কিছু দামী এবং বড়ো, তাহা মানুষ দল বাঁধিয়াই পাইয়াছে। বালি-জমিতে ফসল হয় না, কেননা, তাহা আঁট বাঁধে না; তাই তাহাতে রস জমে না, ফাঁক দিয়া সব গলিয়া যায়। মানুষেরও ঠিক তাই; তাদের মধ্যে ফাঁক বেশি হইলেই তাদের শক্তি কাজে লাগে না, থাকিয়াও না থাকার মতো হয়।” ‘সমবায় ১’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ডিসেম্বর ২০১২-য় যে তেইশ বছরের মেয়েটিকে আমরা ‘নির্ভয়া’ নাম দিয়ে, দিল্লির রাস্তায় তাঁর উপর ঘটা নৃশংস অত্যাচারের প্রতিবাদে দেশের নানা জায়গায় পথে নেমেছিলাম, সেই প্রতিবাদী কর্মসূচির অংশ ছিল শহরগুলোর নানা ধরনের জনপরিসরে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা। ২০১৩-র গোড়া থেকে প্রতি মাসের শেষ শনিবার কলকাতার কিছু পাড়ায়, সিনেমাহলের সামনে, পার্কের পাশে, ফ্লাইওভারের তলায় রাত আটটা থেকে বারোটার মধ্যে ‘টেক ব্যাক দ্য নাইট’ নামে ছোট একটি গোষ্ঠী মিলিত হত। রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাতের বেলা চলাফেরায় নিরাপত্তার অভাব নিয়ে কথা হত পথচারীদের সঙ্গে।
যাঁরা পথ চলতে চলতে এগিয়ে এসে কথা বলতেন, তাঁদের মধ্যে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত মানুষজন সাধারণত রাস্তায় আলোর অভাব ও রাতের দিকে বাস-ট্রাম কমে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করতেন। অন্য দিকে, ফুটপাতবাসী বেশির ভাগ পুরুষ, যাঁরা অনেকেই অন্যান্য প্রদেশ থেকে কলকাতায় এসে খেটে খাচ্ছেন, তাঁরা সে সময়ে আমাদের বলেছিলেন হঠাৎ তৈরি-হওয়া এক অন্য ধরনের বিপন্নতার কথা। ‘নির্ভয়া’র অত্যাচারীরা দিল্লির বস্তিবাসী পরিবারের হওয়ায়, ওই ঘটনার পর এখানকার ফুটপাতবাসী অভিবাসী মানুষদের বিপন্নতার উৎস ছিল এঁদের প্রতি মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের অনেকেরই প্রকাশ্য অসহিষ্ণুতা। ফুটপাতবাসীদের মধ্যে কেউ কেউ সে সময় বলেন যে ‘টেক ব্যাক দ্য নাইট’-এর মতো উদ্যোগ পাড়ায় পাড়ায় হতে থাকলে তাঁদের উপর চাপ হয়তো কিছুটা কমতে পারে।
কিছু দিন ধরে দিল্লি-গুরুগ্রাম ও দেশের নানা প্রান্তে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান পরিযায়ী শ্রমিক মানুষদের যে-ভাবে চূড়ান্ত হেনস্থা করে, বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দিয়ে উচ্ছেদ করা এবং বাংলা ভাষাকে বিভেদের অস্ত্র করা হচ্ছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে মাথার মধ্যে কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে কলকাতার রাস্তায় বারো বছর আগে শোনা ওই কথাগুলো। গত অগস্টে নিজের কর্মক্ষেত্রে এক সাহসী, দুর্নীতি-বিরোধী ডাক্তার-পড়ুয়ার ধর্ষণ-খুনের পর যে অভূতপূর্ব আন্দোলনের জন্ম, আজ সেই আন্দোলনের কথা ভাবতে গিয়ে, নাগরিকত্ব প্রমাণ দিতেহয়রান হয়ে যাওয়া বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারগুলোর কথা, বিশেষত পরিযায়ী শ্রমিক নারীদের কথা, অবধারিত ভাবে এসে পড়ছে। এর কারণ গত বছর শুরু হওয়া আন্দোলনের অন্যতম প্রধান অভিমুখ ছিল কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের ও প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌন পরিচয়ের মানুষদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা। ভাবছি, আজ এই আন্দোলন কী ভাবে কাজ করলে পরিযায়ী শ্রমিক-নারীর উপর চাপ সামান্য কমলেও কমতে পারে।
বাঙালি পরিযায়ী নারী-শ্রমিকরা, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই সংখ্যালঘু, চরম বিপন্নতার মধ্যে রয়েছেন, সেই জন্য তো বটেই। তা ছাড়া, কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যমূলক হিংসার দিকটা নিয়ে এক বছর ধরে নতুন উদ্যমে লড়াইয়ে নেমেছে নাগরিক আন্দোলনের যে অংশ, সেই আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও প্রসারের জন্যও ভাবা জরুরি পরিযায়ী শ্রমিক-নারীর সঙ্কটের কথা।
পরিযায়ী শ্রমিক-মেয়েদের নিয়ে লাগাতার কাজ করে যাওয়া মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী আছে সারা দেশে। এ কাজটা তাদের কাজ— আমরা এ রকমটা ভাবতেই পারি। আবার বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক-নারীর জীবিকা ও নাগরিকত্বের অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে সেতুবন্ধন ও সংহতির কথাটাও ভাবতে পারি। ২০১৯-২০’তেই আমরা দেখেছিলাম মেয়েরা, বিশেষ করে প্রান্তিক মেয়েরা নাগরিকপঞ্জির কাজ চলাকালীন কাগজপত্র জমা করার সময় কতটা বেশি অসহায়, কারণ তাঁদের অনেকেরই নিজেদের নামে কাগজপত্র নেই, বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গিয়েছেন অল্প বয়সে এবং নিজেদের জন্মস্থান বিষয়ক প্রমাণপত্র অথবা স্কুল-পাশ সার্টিফিকেট তাঁদের পক্ষে পেশ করা দুঃসাধ্য! অনেকেই পরিযায়ী শ্রমিক-নারী, কর্মক্ষেত্রে যাঁদের ন্যূনতম নিরাপত্তা থাকে না। এখন খানিকটা ঘুরপথে তাঁদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে বলা হচ্ছে যখন, পুরোপুরি ‘নেই’ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এই মেয়েদের ক্ষেত্রে আরও কতটা বেশি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এই মুহূর্তে বাঙালি মুসলমান পরিযায়ী শ্রমিক-মেয়েরা দেশের সবচেয়ে সঙ্কটাপন্ন গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে পড়ছে, তাই তাঁদের কথা প্রথমেই বললাম। মূলত যেটা বলতে চাইছি সেটা হল, অগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ রাজ্য জুড়ে নানা বর্গের মেয়েরা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তার পর আন্দোলনের বৃত্ত কেন ছোট হতে থাকল এবং কী ভাবে আবার আন্দোলনের পরিসর বাড়ানো যেতে পারে, ‘অভয়া’র জন্য ন্যায়বিচার চাওয়ার পাশাপাশি এই প্রশ্নগুলো তোলা জরুরি, যাতে আগামী দিনে আন্দোলন নতুন গতি পায়।
যে কোনও আন্দোলনেরই ওঠাপড়া থাকে এবং কখনওই কোনও আন্দোলনকে তুঙ্গে ধরে রাখা যায় না বেশি দিন। মেয়েদের অংশগ্রহণের কথাটা যদি ধরি, তা হলে দেখব ঘরে-বাইরে দু’দিক মিলিয়ে বেশির ভাগ মেয়েরই সারা দিনে কাজের ঘণ্টা পুরুষের তুলনায় বেশি হওয়ায় এবং শ্রমজীবী মেয়েদের চব্বিশ ঘণ্টায় বলতে গেলে ত্রিশ ঘণ্টা খেটেও কূল করতে না পারায় এমনিতেই কোনও দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনে শরিক হতে পারাটা তাঁদের পক্ষে মুশকিল। তার উপর পারিবারিক অমত, রাজনৈতিক দলের হুমকি— এ সব তো আছেই।
তবে নিজেদের কর্মক্ষেত্রগত বৈষম্য ও নিরাপত্তা-সুরক্ষা নিয়ে স্বকণ্ঠে ও সসম্মানে কথা বলার জায়গা আন্দোলনের মধ্যে তৈরি হতে দেখলে, তাঁরা আন্দোলনকে শক্তি জোগাবেন বলেই আমার বিশ্বাস। যেমন ধরুন, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যদি ডাক্তার-মেয়েদের হেনস্থা ও বৈষম্য নিয়ে কথা বলার মঞ্চে একই সঙ্গে নার্স, আশাকর্মী ও স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত রূপান্তরকামী মানুষদের কর্মস্থলগত সমস্যা তুলে ধরার আহ্বান থাকে, তা হলে এঁদের সকলের একজোট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে বই কমে না। নতুন আন্দোলনগুলোর মধ্যে সমন্বয় ঘটে, কার্যকর ‘প্রেশার গ্রুপ’ তৈরি হয়। হয়তো সেটা শুরু হয়েছে, দানা বাঁধেনি এখনও।
এর ফলে আর একটা কাজের কাজও হতে পারে। আগেকার নারী আন্দোলনগুলো দীর্ঘ লড়াইয়ের পর যে আইনি পরিবর্তন ও লিঙ্গ-সংবেদনশীল প্রাতিষ্ঠানিক অন্তর্ভুক্তিগুলো আদায় করেছিল রাষ্ট্রের থেকে, সেগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না তার উপর নজরদারি। যেমন, ‘নির্ভয়া’-পরবর্তী পর্যায়ে ঘরে-বাইরে-কর্মক্ষেত্রে যে কোনও ধরনের নিগ্রহের শিকার মেয়েদের জন্য দেশের প্রতিটি জেলায় এক বা একাধিক ‘ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার’ চালু থাকার কথা। কিন্তু আমাদের রাজ্যে যে সব সমাজকর্মী ‘সার্ভাইভর’দের নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের বয়ান অনুযায়ী বেশির ভাগ ‘ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার’গুলোর অবস্থা খুবই করুণ। এগুলো ঠিকঠাক চালানোর জন্য অবিরত চাপ সৃষ্টি করার কাজটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে সমাজের বড় অংশের মেয়েরা কিছু সুরাহা পেতে পারেন। সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রগত ও যৌন হয়রানির অভিযোগ জানানোর কমিটিগুলো ঠিকমত চলছে কি না দেখার সঙ্গে সঙ্গে এই অন্য ব্যবস্থাগুলোর ‘জেন্ডার অডিট’ও জরুরি।
মোট কথা, গত অগস্টে সূচিত নাগরিক আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও প্রসারের জন্যে পুরনো অর্জন নিয়ে নতুন ভাবনা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে বিভিন্ন বর্গের মেয়েদের আন্দোলনগুলো জোটবদ্ধ হয়ে কী ভাবে তাঁদের দাবিসনদ বিষয় রাষ্ট্র ও প্রশাসনকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করতে পারে, সেটা ভেবে দেখা দরকার। সাম্প্রতিক কালে নারী-ভোটদাতার সংখ্যা বিপুল বৃদ্ধি পেলেও, মেয়েদের ভোট নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও, রাষ্ট্রের রাজনীতিতে লিঙ্গ-সাম্যের প্রশ্নটা কিন্তু উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। জোটবদ্ধ হয়ে উপেক্ষা থেকে প্রভাব বিস্তারের পথে এগোতে পারি কি না, ভাবতে হবে সেটাও।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)