বহু, বহুদিন পরে এমন আশ্চর্য লাগল। ভাল লাগল। এত ভাল লাগা সম্প্রতি ঘটেছে কি? মনে করতে পারি না।
অনেক বছর আগে মুম্বইয়ের ঘোর বর্ষায় অ্যাসাইনমেন্টে গিয়েছিলাম। ফেরার দিন মনে হচ্ছিল, সকাল থেকে পৃথিবীর ছাদ ফুটো হয়ে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা নেমে এসে ভাসিয়ে দিচ্ছে বাণিজ্যনগরীর ধরাতল। তার আগে সপ্তাহখানেক ধরে বিখ্যাত ‘মুম্বই মনসুন’ দেখেছি। দেখেছি মানে সহ্য করেছি পেটের দায়ে! জল ছপর ছপর করে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছে। যাকে বলে বিরক্তির একশেষ!
হোটেলের লোকজন তার মধ্যেই ক্রমাগত বলে যাচ্ছেন, ‘‘ওই যে থোবা-ঘুতরা-এগাল (যথাক্রমে সাদা আলখাল্লা-মাথার গামছা সদৃশ স্কার্ফ এবং সেই স্কার্ফ এঁটে বসিয়ে রাখার জন্য কালো দড়ি) পরা আরবদের দেখছেন? ওরা মরুভূমির দেশ থেকে মুম্বইয়ে হোটেল ভাড়া করে থাকতে এসেছে শুধু এই বৃষ্টি দেখবে বলে। প্রতি বছরই আসে।’’ শুনছি আর মনে মনে ভাবছি, সে আসে হয়তো। কে আর অত খতেন নিতে যায়। পশ্চিমবঙ্গে কি আর বৃষ্টি বা জমা জলের রাস্তার অভাব।
কিন্তু বর্ষার অভিঘাত কাকে বলে, ফেরার দিন টের পেলাম। মেরিন ড্রাইভ ধরে রওনা হয়েছি সন্ধ্যার উড়ান ধরব বলে। বৃষ্টিতে সমুদ্র উত্তাল। দেড়তলা, দোতলা-সমান উঁচু ঢেউ এসে বাঁধানো তীর পেরিয়ে আছড়ে পড়ছে রাস্তায়। কূল ছাপিয়ে সেই তীরভাঙা ঢেউয়ের তলায় ডুবকি মেরে গুটগুট করে একটা গুবরে পোকার মতো চলেছে কালো-হলুদ পুঁচকে প্রিমিয়ার পদ্মিনী ট্যাক্সি। হাঁ হয়ে চারদিকে দেখছি। মনে হচ্ছে, ব্রহ্মাণ্ড কি আজই রসাতলে যাবে?
তখনই নজরে এল দৃশ্যটা। সেই ঘোর বর্ষায় মেরিন ড্রাইভের অনুচ্চ পাঁচিলে বসে এক যুগল। জগৎসংসার ভেসে চলে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের কোনও হুঁশ নেই। পাহাড়ের মতো ঢেউ আছড়ে পড়ছে। উত্তুঙ্গ সেই ঢেউয়ের ঝরোখায় মাঝেমাঝেই ঢাকা পড়ে যাচ্ছে দুটো অবয়ব। ঢেউ সরে গেলে আবার দেখা যাচ্ছে তাদের। নোনাজলের ইলশেগুঁড়ির মধ্যে আধফোটা মূর্তির মতো। আরবসাগরের উপর ঘন কালো মেঘে ঢাকা আকাশ, নীচের সমুদ্রে উত্তাল ঢেউয়ে মোচার খোলার মতো ভাসতে-থাকা জলযান, মেরিন ড্রাইভ বরাবর অসময়ে জ্বালিয়ে দেওয়া সোডিয়াম ভেপারের মায়াবী আলোর রেখা, নোনা বাতাসের ঝাপটা— সব ছাপিয়ে জেগে রয়েছে দুটো চেহারা। অনড়, অটল, স্থাণু, পরস্পরে মগ্ন।
মনে হচ্ছিল, ওই ফ্রেমটায় সময় থমকে গিয়েছে। মনে মনে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘যাও পাখি’ আওড়ালাম, ‘ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে’।
বহুদিন পরে আবার সেই লাইনটা বলতে ইচ্ছে করল একটা ছোট ভিডিয়ো দেখে। ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে আচমকাই দেখা। কিন্তু তার পর কতবার যে দেখলাম! অপাপবিদ্ধ দু’টি মুখ। পরস্পরের ভালবাসায় মাখামাখি। খানিক ভঙ্গুর, খানিক ভীত, খানিক পেলব, খানিক মেদুর, খানিক বিস্মিত, খানিক নিশ্চিন্ত। দেখলে হৃদয় আপনা থেকে দ্রব হয়। বিশেষত, চারদিকের এই উচ্চকিত এবং অবিশ্রাম কাড়ানাকাড়ার আবহে।
দৃশ্যটা নাটকীয়ও। কিন্তু কুনাট্য নয়। বরং অণুগল্পের মতো। গঙ্গার ঘাটে এক জুড়ির কাহিনি। দেখে মনে হয়, দু’জনেরই বয়স কুড়ির কোঠায়। বেড়াতে এসেছিল নদীর তীরে। খানিকটা আচম্বিতেই তাদের সামনে হাজির এক ছবিওয়ালা। কার্যত বিনা ভূমিকায় সেই যুগলকে অচেনা ফোটোগ্রাফার বলে, ‘‘দাদা, তোমাদের কিছু কাপ্ল শুট করতে পারি? অ্যাজ় আ স্ট্রেঞ্জার পোর্ট্রেট?’’
পটভূমিতে ঘন নীল আকাশ। মৃদুমন্দ বহিতেছে মলয়পবন। আচমকা পিছন থেকে অনুরোধ শুনে ঝপ করে তাকায় সেই ‘কাপ্ল’। প্রথমে খানিক সন্দিহানই ছিল বোধহয় তারা। মেয়েটির পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ি, কনুই পর্যন্ত কালো হাতার ব্লাউজ়। তাতে লতাপাতার সেলাইয়ের কারুকাজ। কপালে পুঁতির মতো টিপ। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। চুলে হালকা বার্গান্ডি হাইলাইট। ডান হাতের কব্জিতে একটা কালো কার। বাঁ হাতের কব্জিতে লাল-হলুদ চুড়ির গোছা। একটা মোটা ধাতব বালা। বাঁ হাতের দু’টি আঙুলে দু’টি রুপোলি আংটি। রোগাটে গড়নের ছেলেটির পরনে সাদা খাটো হাতাগোটানো ফুলস্লিভ কুর্তা (চমৎকার লম্বাটে কাঠের বোতাম-সহ) আর কালো জিন্সের ট্রাউজ়ার্স। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। বাঁ হাতের কব্জিতে কালো স্ট্র্যাপের রিস্টওয়াচ। কাঁধে লাল স্লিং ব্যাগ। কৈশোরের চৌকাঠ পেরিয়ে তারুণ্যে ঢোকা মুখে কোমল শষ্পসদৃশ দাড়ি-গোঁফ।
মেয়েটির দু’টি হাত তখন ছেলেটির দু’কাঁধে। ভিডিয়ো লেন্সের দিকে মুখ ঘুরিয়ে ছেলেটি হঠাৎ-আসা ফোটোগ্রাফারকে (সায়ন্তন মণ্ডল) বলে, ‘‘আমাদের ছবিগুলো দেবে?’’ ফোটোগ্রাফার বলেন, ‘‘অবশ্যই!’’
মেয়েটি বড় বড় চোখ করে আবার আগন্তুকের দিকে তাকায়। তারপর ঠোঁটে এক নিরুপায় হাসির রেখা টেনে এনে বলে, ‘‘আমাদের কাছে কিন্তু টাকা নেই।’’ ছেলেটিও চটপট হাত উল্টে বলে, ‘‘আমাদের কাছে টাকাই তো নেই।’’ সহাস্য জবাব আসে, ‘‘টাকার জন্য নয়। এটা পুরো নন-পেড হয়। স্ট্রেঞ্জার্স শুট। আমার প্রোফাইল চেক করতে পারো। (ফোন এগিয়ে দিয়ে) তুমি চেক করে নিতে পারো। কোনও অসুবিধা নেই।’’
দ্বিধাগ্রস্ত হাতে মেয়েটি ফোনটা নেয়। কয়েক লহমার উচাটন। খানিক দোনামোনা। ফোন ফিরিয়ে দিয়ে ছেলেটির কাঁধে হাত রেখে মেয়েটি সেই অচেনা ফোটোগ্রাফারকে বলে, ‘‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুলুন আপনি।’’ ফোটোগ্রাফার আবার বলেন, ‘‘না-না, তুমি চেক করে নিতে পারো।’’ মেয়েটির সঙ্গে ছেলেটির চোখে চোখে সেতু তৈরি হয়ে যায়। মেয়েটি মৃদু হেসে আবার বলে, ‘‘তুলুন আপনি।’’
ছবি: সায়ন্তন মণ্ডল।
তার পরে ক্যামেরার শাটার পড়ার শব্দ আর কিছু চকিত বিভ্রমের মুহূর্ত। গঙ্গার উপরে আরও গাঢ় নীল হয়ে যাওয়া আকাশ, ঘাটের পাশের ম্যাস্টিক অ্যাসফল্টের রাস্তায় দাঁড়ানো সাদা এসইউভি, নদীর উপরে ঝুলে-থাকা গাছের ডালে বিপজ্জনক রকমের সবুজ পাতার আলগোছে দোল খাওয়া, আবহে তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে বয়ে যাওয়া গানের কলি ‘তোমাকেই ভাল লেগেছে, তাই পুরনো খাতায় লিখে রাখলাম নতুন প্রেমের গান’।
আর তার মধ্যে এক আত্মহারা যুগল।
শুট শেষের পরে ডিজিটাল ক্যামেরার মনিটরে ছবি দেখতে দেখতে মেয়েটি বলে, ‘‘খুবই সুন্দর এসেছে!’’ পাশে দাঁড়ানো ছেলেটি হাতের মুদ্রায় ডানহাতের তর্জনী নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে, ‘‘এই ছবিগুলো আমাদের পাঠাবে তো?’’ তারপরে তারা গায়ে গা ঠেকিয়ে ছবি দেখতে বসে। আঙুলে আঙুল জড়িয়ে থাকে।
দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এমন পরাবাস্তব মুহূর্ত এখনও রচিত হয়। ভাগ্যিস হয়! নইলে তো পরিপার্শ্বের উপর থেকে বিশ্বাসই উঠে যাচ্ছিল প্রায়। মনে হত অর্থলোলুপ, স্বার্থপর, কৃতঘ্ন এবং অবিশ্বাসীতে ভরে গিয়েছে দুনিয়া। মনে হত, আর আশা নেই। ভালবাসা নেই।
ভাগ্যিস এই কাহিনিটা ছিল! তিলেক পরিমাণ যে কাহিনির গভীরতম মুহূর্ত রচিত হয়েছিল, যখন সারল্য আর অপাপবিদ্ধতায় মাখামাখি দু’চোখ তুলে মেয়েটি অপ্রতিভ ভাবে আগন্তুক ফোটোগ্রাফারকে বলেছিল, ‘‘আমাদের কাছে কিন্তু টাকা নেই।’’ তারপরে একটু থেমে, ‘‘আপনি তুলুন।’’
মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল বর্ষামঙ্গলের মেরিন ড্রাইভে মায়াবী আলোয় ভেসে যাওয়া দু’টি অবয়ব আর গঙ্গাতীরের গোধূলি আলোয় উজ্জ্বল আপাত-অপ্রতিভ যুগল।
বহুদিন পরে মনে মনে আবার বলছিলাম, উহারা যেন সুখে থাকে।