বছর আটেক আগে পূর্ব দিল্লির এক দুর্গাপুজোর মণ্ডপ চত্বরে এগ রোল, ফিশ ফ্রাই, মাংসের চপ বিক্রি বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। বিজেপি-নিয়ন্ত্রিত পুলিশ-প্রশাসনের তরফ থেকে আপত্তি উঠেছিল। যদিও পুজোর উদ্যোক্তারা সে কথা আদৌ স্বীকার করতে চাননি। এ বছর দুর্গাপুজোয় মহাষ্টমীতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কের পুজোয় গিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে এই প্রথম। চিত্তরঞ্জন পার্কে পুজো মণ্ডপের সামনেই বিরিয়ানির দোকানগুলিতে অনেক লম্বা লাইন পড়ে। দিল্লিতে এখন বিজেপির সরকার। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী দিল্লির বাঙালিপাড়ার দুর্গাপুজোয় যাবেন বলে কেউ আমিষ খাবারের বিক্রিবাটা বন্ধ করার জন্য হুলিয়া জারি করেনি। বরং দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী রেখা গুপ্ত দিল্লির দুর্গাপুজো কমিটিগুলির জন্য বিদ্যুতের বিলে ছাড়ের কথা ঘোষণা করেছিলেন এবং অনুরোধ করেছিলেন, তাঁরা যেন মণ্ডপে মণ্ডপে প্রধানমন্ত্রী মোদীর একটা করে ছবি রাখেন!
একে দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে বিজেপির বাঙালি মন জয়ের মরিয়া চেষ্টা বলা যেতেই পারে। আসলে এটি বিজেপির ক্ষত মেরামতের তাগিদ। বাংলাদেশি চিহ্নিত করে ফেরত পাঠানোর জন্য ধরপাকড় করতে গিয়ে বিজেপি-শাসিত রাজ্যে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের যে রকম হেনস্থা হয়েছে, তাতে তৃণমূলের পক্ষে বিজেপির গায়ে ‘বাঙালি বিদ্বেষী’ তকমাটি সেঁটে দিতে বিশেষ কষ্ট করতে হয়নি। ২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল রীতিমতো প্রচার কৌশল তৈরি করে বিজেপিকে ‘বহিরাগত দল’ বলে দেগে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তার বদলে ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’ বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তুলে ধরেছিল তৃণমূল। সেই সুবাদেই তৃণমূল দশ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও ২০২১-এ রাজ্যের বিধানসভার ২৯৪টি আসনের মধ্যে ২১৫টি আসন জিতে নিয়েছিল।
এ বার ২০২৬-এর বিধানসভা ভোটের আগে বিজেপি নিজেই বাংলা ভাষাকে ‘বাংলাদেশি ভাষা’ বলে তৃণমূলের হাতে বিরাট অস্ত্র তুলে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে তাই চিত্তরঞ্জন পার্কের দুর্গাপুজোয় ছুটতে হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতাদের সমস্ত রাজ্যে পাঠানো হয়েছে দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে ‘বাঙালি মিলন সমারোহ’ আয়োজনে। কলকাতার ইস্টার্ন জ়োনাল কালচারাল সেন্টারে বিজেপির সাংস্কৃতিক সেলের উদ্যোগে শুরু দুর্গাপুজো তিন বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে ফের এ বছর চালু হয়েছে। অমিত শাহ নিজে সেই দুর্গাপুজোয় হাজিরা দিয়েছেন।
প্রশ্ন হল, পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজো যে নিছক ধর্মীয় উৎসব নয়, বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কি তা আদৌ বুঝতে পেরেছেন? দুর্গাপুজো বহু দিনই ধর্মীয় উৎসবের সীমা ছাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গে সংস্কৃতি, শিল্পকলা, সাহিত্য উদ্যাপনের মঞ্চ হয়ে উঠেছিল। এখন সেই দুর্গাপুজো রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, সাংস্কৃতিক দখলদারি ও প্রতীকি রাজনীতির ময়দান হয়ে উঠেছে। বিজেপি নেতার দুর্গাপুজোর থিম ‘অপারেশন সিঁদুর’ হলে তৃণমূল নেতার পুজোর থিম এখন বাংলা ভাষা, বাঙালি অস্মিতার উপরে হামলা। কেন মহালয়ার আগে থেকেই পিতৃপক্ষে মুখ্যমন্ত্রী দুর্গাপুজোর উদ্বোধনে নেমে পড়ছেন, কেন মহরমের জন্য বিসর্জন পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে, বিজেপি এ সব নিয়ে হইচই করতে পারে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে হিন্দু ধর্ম ও বাঙালি ঐতিহ্যকে জলাঞ্জলি দেওয়ার অভিযোগ তুলতে পারে। কিন্তু তাতে রাজনীতির লাভ হয় না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের পুজো কমিটিতে অনুদান, বিদ্যুতের বিলে ছাড় আদৌ খয়রাতি নয়। আসলে তা পাড়ায় পাড়ায় ক্ষমতার জাল বুনে তৃণমূলের ভোটযন্ত্রকে সম্প্রসারণ করা। ভোটের সময় ক্যাডার বাহিনী ও সংগঠনকে চাঙ্গা রাখার জন্য আগাম লগ্নি।
বিজেপি এই লড়াইয়ে তৃণমূলের থেকে বহু আলোকবর্ষ পিছিয়ে। তার কারণ বিজেপির ক্ষমতায় না-থাকা নয়, তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা। গত লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির আশানুরূপ ফল না হওয়ার পরে দলীয় পর্যালোচনায় এই বুথ স্তরে দুর্বলতার কথাই উঠে এসেছিল। দেখা গিয়েছিল, খাতায়-কলমে বুথ কমিটি থাকলেও বাস্তবে সিংহভাগ ক্ষেত্রেই তার অস্তিত্ব ছিল না। রাজ্যের প্রায় আশি হাজার বুথের শতকরা সত্তর ভাগ ক্ষেত্রেই এই ছবি দেখা গিয়েছিল। তার ফলে অনেক জায়গাতেই ভোটের দিন বুথে বিজেপির এজেন্টই ছিল না।
প্রায় ১৫ বছর কোনও সরকার ক্ষমতায় থাকলে তার বিরুদ্ধে অসন্তোষ তৈরি হবেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষের কারণের অভাব নেই। বিজেপি বরাবর সেই অসন্তোষকে পুঁজি করার বদলে ধর্মীয় মেরুকরণ, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, উগ্র হিন্দুত্বের চেনা পথে হাঁটতে চেয়েছে। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহকে সামনে রেখে সোনার বাংলা গঠনের মতো রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরি করতে চেয়েছে। তাতে হয়তো গত বিধানসভা ভোটের মতো সত্তর-আশিখানা আসন জেতা যায়, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখলের জন্য যে সংগঠন বা ক্যাডার বাহিনী প্রয়োজন, তা বিজেপি এখনও গড়ে তুলতে পারেনি। হয়তো সেই কারণেই বিজেপির সাংসদ খগেন মুর্মু ও বিধায়ক শঙ্কর ঘোষকে বিধানসভায় বিজেপিরই জিতে আসা নাগরাকাটায় গিয়ে আক্রান্ত হতে হয়। দেহরক্ষী ছাড়া তাঁদের রক্ষা করার জন্য বিজেপির কোনও কর্মী-সমর্থকের দেখা মেলে না।
পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের অবশ্য এখনও পাঁচ-ছ’মাস দেরি। তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষনেতৃত্বের জন্য চিন্তার কারণ হল, বিজেপি এ বার পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী ভূপেন্দর যাদবকে দিয়েছে। ভূপেন্দর যাদব বিজেপির অন্য নেতাদের মতো বড় বড় বুলি আওড়ান না। তাই তুলনামূলক ভাবে তাঁর পরিচিতি কম। এই ভূপেন্দর যাদবই গত বছর মহারাষ্ট্র বিধানসভায় বিজেপি তথা এনডিএ-কে বিপুল ভোটে জিতিয়ে আনতে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন। সেটাও লোকসভা নির্বাচনে মহারাষ্ট্রে বিজেপির খারাপ ফলের চার মাসের মধ্যে। তার আগে ভূপেন্দর যাদব ২০২৩-এর মধ্যপ্রদেশের বিধানসভা ভোটেও বিজেপির হয়ে বাজিমাত করেছিলেন।
কী ভাবে? নির্বাচনী বুথ জয় থেকে ভোট জয়— ভূপেন্দর যাদবের বরাবরের মন্ত্র। মহারাষ্ট্রে এক লক্ষ বুথের মধ্যে ভূপেন্দর যাদব মাত্র বারো হাজার বুথ বেছে নিয়েছিলেন, যে সব হারা বুথে বিজেপি জিততে পারে। যে সব বিধানসভা আসনে বিজেপি তিন থেকে চার শতাংশের মতো ভোটে হেরেছে, প্রথমে সেগুলি চিহ্নিত করা হয়। তার পরে ওই সব আসনের কোন কোন বুথে বিজেপি জিততে পারলে গোটা বিধানসভা আসন দখল করা সম্ভব, সেগুলি খুঁজে বার করা হয়। মহারাষ্ট্রের নেতাদের জন্য ভূপেন্দর যাদবের বার্তা ছিল, এটা বিধানসভা নির্বাচন ভুলে যান। ধরে নিন এটা বুথ স্তরের নির্বাচন। কী ভাবে একটা বুথ জেতা যায়, সে দিকে নজর দিন। কোন কোন বুথে বিজেপি জিতবে, কোন বুথে বিজেপি জিতবে না, তা বাদ দিয়ে কোন বুথে বিজেপি জিততে পারে, সেই তালিকায় ভূপেন্দর যাদব নজর দিয়েছিলেন। তার সুবাদেই মহারাষ্ট্রে বিধানসভায় প্রায় ৮৯ শতাংশ আসন দখল করে জয়ের রেকর্ড গড়েছিল বিজেপি।
এ বার পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে রাজ্যের বিজেপি নেতাদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকেই ভূপেন্দর যাদব মহারাষ্ট্রের পথে হাঁটার ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্রথমেই তিনি রাজ্য বিজেপিকে কোন কোন বুথে দলের জেতার সম্ভাবনা প্রবল, তা চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। রাজ্য জুড়ে প্রচার কৌশলকে প্রধান পুঁজি করার বদলে বুথ স্তরে সংগঠন মজবুত করার নির্দেশ দিয়েছেন। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে যে সব ভুল হয়েছিল, তা শোধরানোর নির্দেশ দিয়েছেন। ভুললে চলবে না, ২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন পরিচালনার ভার অঘোষিত ভাবে অমিত শাহের হাতে ছিল। যিনি দু’শো আসন জয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করলেও তা মেলাতে পারেননি।
পশ্চিমবঙ্গে সাফল্য পেতে হলে বিজেপিকে আগে মেনে নিতে হবে— সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নয়, সংগঠন দরকার। বাগাড়ম্বরের বদলে বুথ জয় প্রয়োজন। ধর্ম নয়, তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষকে পুঁজি করা জরুরি। এ কথা বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যত দ্রুত বুঝতে পারবেন, ততই তাঁদের সাফল্যের সম্ভাবনা বাড়বে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)