E-Paper

সত্যিকারের অগ্নিপরীক্ষা

ফলে তর্ক করা ওই পরিস্থিতিতে বুদ্ধিমানের কাজ নয়। একই বিমানে আসা এক সহযাত্রীর বদান্যতায় টাকা-ডলার বিনিময় সেরে বাইরে পা রাখতেই ধাক্কা মেরেছিল এক গন্ধ।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৯:৫৯
দগ্ধসূচনা: সদ্য-দেখা সরকারবিরোধী অভ্যুত্থানে অসংখ্য মৃত্যুর পর সাধারণ নগরবাসীর মোমবাতি মিছিল। কাঠমান্ডু, ১৭ সেপ্টেম্বর।

দগ্ধসূচনা: সদ্য-দেখা সরকারবিরোধী অভ্যুত্থানে অসংখ্য মৃত্যুর পর সাধারণ নগরবাসীর মোমবাতি মিছিল। কাঠমান্ডু, ১৭ সেপ্টেম্বর। ছবি রয়টার্স।

সে  দিন ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে পা রাখার আগেই ধাক্কা। বন্ধ বিমান পরিষেবা চালু হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আপৎকালীন ভিত্তিতে এসে নেমেছি ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সে ভাবে গুছিয়ে সব কিছু নিয়ে আসার সময় ছিল না। সত্য, অর্ধসত্য, অতিসত্য মিলিয়ে শীত-পূর্ববর্তী কুয়াশায় মুড়ে রয়েছে বিমানবন্দরের বাইরের শহর। সে কুয়াশা আতঙ্কের। চব্বিশ ঘণ্টা আগে জেন-জ়ি পরিচালিত তাণ্ডবলীলা রিল এবং ছোট ছোট ক্লিপ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে এই উপমহাদেশ হয়ে গোটা বিশ্বে। এক বছর আগে ঘটা ঢাকার ধ্বংসলীলার অ্যাকশন রিপ্লে ঘটছে যেন সে দিন কাঠমান্ডুতে।

“ডলার দিন ভাঙিয়ে দেব। ভারতীয় টাকার বদলি নেই।” ঠান্ডা অথচ কঠিন স্বর তরুণের। ইমিগ্রেশনে সইসাবুদ সেরে লাগেজ নিয়ে বাইরে প্রথমেই মুদ্রাবদলের কাউন্টারে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। প্রথম, দ্বিতীয়, তার পর তৃতীয় দোকানের কাউন্টার। জবাব উনিশ-বিশ একই। ডলারে ভারতীয় মুদ্রা বদলে আনার সময় ছিল না, ভেবেছিলাম পৌঁছে বিমানবন্দরে করে নেওয়া যাবে। শহর অচল থাকলেও বন্দর তো চালু। কিন্তু ভারতীয় টাকার উপর দরজা বন্ধ করে দেওয়া এই রাগী যুবকরা কি জেন-জ়ি? কাঠমান্ডুর রাস্তাঘাটে ভারতীয় সাংবাদিকদের হেনস্থার খবর তত ক্ষণে আমাদের সবার পকেটে। আসার আগের রাতে সম্পাদক পইপই করে বলে দিয়েছিলেন, কোনও বাড়তি ঝুঁকি না নিতে। কারণ, অফিসে সেই রাতেই খবর এসেছে মানসযাত্রা ফেরত পশ্চিমবঙ্গের একটি দলকে খোলা কুকরি দেখিয়ে রাস্তায় আটকে দেওয়া হয়েছে। হুমকি দেওয়া হয়েছে, আগুনে ফেলে দিলে কেমন লাগে তা তাঁরা পরখ করে দেখতে চান কি না!

ফলে তর্ক করা ওই পরিস্থিতিতে বুদ্ধিমানের কাজ নয়। একই বিমানে আসা এক সহযাত্রীর বদান্যতায় টাকা-ডলার বিনিময় সেরে বাইরে পা রাখতেই ধাক্কা মেরেছিল এক গন্ধ। যে গন্ধ শ্মশানে পাওয়া যায়। তার পর যথাসম্ভব সতর্কতায় নোট করেছি কাঠমান্ডুর ডায়েরি, যেখানে এক দিকে দুঃস্বপ্নের চিত্রনাট্য সপ্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে প্রকাশ্যে রাজপথে। অন্য দিকে, পুরাণ পাখির মতো ধ্বংসের ভিতর থেকে জেগেছে শুভবোধ। বিমানবন্দর থেকে সোজা পৌঁছেছি বহুতল হিল্টন হোটেলের সামনের নরক হয়ে থাকা রাস্তায়। যার অর্ধেক অবিকল এক, বাকিটা ঝলসে গিয়েছে। বাইরের দিকের ‌ইমার্জেন্সি ঘোরানো সিঁড়িটা কোন নরকে উঠে গিয়েছিল? আশপাশ দিয়ে সাইরেন বাজিয়ে ছুটছে অ্যাম্বুল্যান্স, আর ওই হোটেলের শূন্যতার ভিতর অবিরল জল পড়ার শব্দ। তখনও ভিতরে আগুন থামানোর কাজ চলছে। হোটেলের উল্টো দিকেই ভগবতী ভালের মন্দির। সামনে স্থানীয় মানুষের ছোট্ট জটলা। ভারত থেকে এসেছি শুনে প্রসন্ন হয়েছিলেন না তার ঠিক উল্টোটা— সে দিন তা বোঝা যায়নি! কারণ অদূরেই কার্যত মার্চ পাস্ট করছিল সশস্ত্র সেনাবাহিনী।

প্রথম এবং দ্বিতীয় দিন গোটা শহরের রং ছিল জলপাই, রিংটোন ছিল সাইরেনের শিস, অভ্যস্ত ছবি ছিল রাস্তার দু’পাশে জ্বলে যাওয়া গাড়ির কঙ্কাল। মাছি উড়লেও নজরে আসবে এমন স্তব্ধতা ও শূন্যতা রাজপথ, গলি, মোড়, শাটার ফেলা বাজার বিপণিতে। বিকেল পাঁচটায় কার্ফু উঠে যাওয়ার পর পরের ছবিটা কিছু বদলে হল ধ্বংসের একক প্রদর্শনীতে। নেপাল পার্লামেন্টের মূল ফটক থেকে শুরু করে ভাঙচুর দেওয়ালের দৈর্ঘ্য বরাবর ভিড়। বাচ্চা কোলেও পুরুষ-নারী এসেছেন, সেলফি তুলছেন পিছনে ধ্বংসকে রেখে। এঁরা কেউ জেন-জ়ি নন, নেহাতই মজা দেখতে এসেছেন না পরিবর্তনের আঁচ পেতে, তা বোঝা দায়। একই চিত্র, ভাঙচুর হওয়া সুপ্রিম কোর্টের সামনেও।

তবে অতি আশ্চর্যের বিষয়, রোষান্ধ জেন-জ়ি কিন্তু তত ক্ষণে উধাও কাঠমান্ডুর রাজপথ থেকে, মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগেই যাদের হিংস্র আক্রমণের একের পর এক ভিডিয়ো দেখে স্তম্ভিত হয়েছে ভারত, দক্ষিণ এশিয়া তথা গোটা বিশ্ব। তাদের ধ্বংসলীলার চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে গোটা শহর এবং দেশে, কিন্তু তারা আর রাস্তায় নেই। তখন ভদ্রকালী হেডকোয়ার্টারে বসে জেন-জ়ি প্রতিনিধিরা বৈঠক করছেন সেনা প্রধান, প্রেসিডেন্ট এবং দেশের চার প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে। চলছে কূট-রাজনীতির পাশা খেলা, যার মধ্যে থেকে উঠে আসছেন সুশীলা কারকি। সংসদ ভাঙার তীব্র বিরোধতা করেছিলেন নেপালি কংগ্রেস, এনসিপি (ইউএমএল) এনসিপি (মাওবাদী)-র শীর্ষ নেতারা। কিন্তু জেন-জ়ি-র চাপের কাছে হার মানতে হল দেওবা, ওলিদের। নেপালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর এই প্রথম কেউ প্রধানমন্ত্রী (হলই বা অন্তর্বর্তিকালীন) হলেন, যিনি মানুষের ভোটে জিতে আসা সংসদ সদস্য নন।

মাত্র ৪৮ ঘণ্টার বিদ্রোহে দেশের সরকার বদলে যাওয়ার দৃষ্টান্ত দেখেননি বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী সুশীলা। তুলনামূলক আলোচনায় বার বার যেটা উঠে আসছে, সেই বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলেছিল এর থেকে অনেক বেশি দিন ধরে। নেপালে ধীরে ধীরে সেনারা ব্যারাকে ফিরে গেলেন। শহরের বিপণিতে এখানকার সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় উৎসব ‘দশহরা’ বা ‘বড়া দশাই’-কে ঘিরে (অক্টোবরে) কেনাকাটার ভিড় বাড়ল। মাঝে কোথায় হারিয়ে যাওয়া কাঠমান্ডুর পুলিশ এখন আবার দখল নিল রাজধানীর নিরাপত্তার। সেই শ্মশানের মতো খাঁ খাঁ রাস্তা এত দিনে পাকাপাকি ভাবে নেপালের ইতিহাসের ফ্রেমে ঢুকে গিয়েছে।

তবে সে দিন গ্রাউন্ড জ়িরোতে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল ইতিহাসের সবে শুরু হল নেপালে। রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ২০০৮ সালে যখন নতুন সংবিধান রচিত হয়েছিল সে দেশে, তা ছিল ইতিহাসের প্রথম ধাপ। তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলের ১৪টি সরকার নেপাল পেয়েছে ইতিমধ্যে। সরকার আসে সরকার যায়, রং বদলায়, দিন বদলায় না। নির্লজ্জ দলতন্ত্র, স্বজনপোষণ, দুর্নীতি, অপশাসন, বেহাল অর্থনীতি, বেকারত্বের হতাশা, অসাম্যের ভাঁড়ার পূর্ণ হয়েছে। নেপালের রাজপথে নামা জেন-জ়ি-র উদ্দেশ্যে নেপাল সরকার সে দিন গুলি না চালালে হয়তো এত দ্রুত সরকারের বদল হত না। কিন্তু এই আন্দোলনের কুশীলবরা (যাঁদের অনেকেই আন্ডারগ্রাউন্ড ‘র‌্যাপার’) বদল আনতেনই, আজ হোক বা কাল। তাঁদের পিছনে একাধিক সরকার-বিরোধী এবং তথাকথিত রাজনৈতিক দল-বিরোধী শক্তি, পৃথক পৃথক ভাবে একজোট হয়েছিল। আন্দোলনের দিনে ঢুকে পড়েছিল এক বড় সংখ্যক সমাজবিরোধী, অপরাধী, লুম্পেনতন্ত্র। তাতে রাষ্ট্রের বিপুল ক্ষতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কে পি শর্মা ওলির অপসারণ ত্বরান্বিত হয়েছে। আন্দোলনের চেহারা ভয়ঙ্কর ঘাতকের রূপ নিয়েছে।

আপাতত শান্তির পথে ফিরলেও জেন-জ়ি তথা নেপালের সাধারণ মানুষের লড়াই যে প্রার্থিত উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছে বিষয়টি এত সরল নয়। সব জেতা-হারাকে সাদা কালোয় ভাগ করা যায় না। এখনও নেপালের আমলাতন্ত্র এবং পুলিশি ব্যবস্থা পুরোপুরি ভাবে করায়ত্ত করে রেখেছে তিন প্রধান রাজনৈতিক দল। যে তিন নেতা পিছন থেকে গত পাঁচ মাস জেন-জ়িকে সামনে রেখে কলকাঠি নাড়লেন সেই কাঠমান্ডু মেয়র বলেন্দ্র শাহ, রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টির নেতা রবি লামচানে এবং একদা সরকার ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি দুর্গা পরসাঁই-এর সাধারণ মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও প্রশাসন যন্ত্র, আমলাতন্ত্র এবং সংবাদমাধ্যমের সিংহভাগের উপর তেমন প্রভাব নেই।

‘বড়া দশাই’কে আলোকজ্জ্বল করা সুশীলা কারকির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু আরও বড় চ্যালেঞ্জ, নেপালের রাজপথে গুলিতে নিহত মানুষের পরিবারকে সুবিচার দিয়ে, রাজনৈতিক নেতাদের চাঁইদের গ্রেফতার করিয়ে, দেশে শান্তি ও ভারসাম্য বজায় রেখে, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উদ্ধার করে আগামী বছর সঠিক সময়ে নেপালকে নির্বাচনের সামনে দাঁড় করানো।

বিষয়টি অগ্নিপরীক্ষারই সমান।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Nepal Generation Z

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy