বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে বদল চাওয়ার যুক্তি চাই। সুতরাং আরএসএস যুক্তি: এক সময় বাংলার জলমগ্ন মাটিতে ছোলা, অড়হর ও বিউলির মতো ডাল উৎপাদন হত না বলে শস্য থেকে প্রোটিনের কোনও উৎস ছিল না। সেই কারণেই তাঁদের মধ্যে মাছ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। “এখন পরিস্থিতি বদলেছে, কিন্তু অভ্যাসটি যায়নি। এই পরিবর্তনগুলি আমাদের আনতে হবে,” সম্প্রতি বলেছেন আরএসএস-এর সরসঙ্ঘচালক, অর্থাৎ সর্বাধিনায়ক, মোহন ভাগবত।
নভেম্বরের ৯ তারিখ, বেঙ্গালুরুতে একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘ভারতের মতো এক দেশ’ থেকে কেন কোনও রকম মাংস রফতানি হবে, এই প্রশ্ন সরকারকে করে লাভ নেই, যতক্ষণ না সমাজ তার খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, অর্থাৎ আমিষ বর্জন— করতে পারছে। তিনি বলেন, আমিষাশী হিন্দুরাও কিছু নিয়ম মানেন, যেমন মাংস তাঁরা শুধু বুধ ও রবিবারই খান। হিন্দুরা কেউ গোটা শ্রাবণ মাসে মাংস ছোঁন না। কিন্তু যে হেতু, নিয়মিত না হলেও, মাংস তাঁরা খান, ভাগবত বলেন, “আমাদের এই অভ্যাস শোধরাতে হবে।” গোটা দেশে সরকারি ভাবেও নিরামিষের প্রসার প্রয়োজন বলে তাঁরা মনে করেন।
এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়েই ভাগবত বুঝিয়েছেন হিন্দু বলতে তিনি কাদের বোঝেন— মূলত যাঁরা নিরামিষাশী, এবং যাঁরা মাংস খেলেও বুধ ও রবিবার ছাড়া খান না এবং গোটা শ্রাবণ মাস এবং অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবের সময় নিরামিষ আহার করেন। প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, ভেবে দেখুন, আপনি ও আপনার পরিবার, বন্ধুবান্ধব এই আওতায় এল, না কি আরএসএস-বিজেপির হিন্দু সমাজ থেকে বাদ পড়ে গেল? আমাদের অঞ্চলে ক্লাবগুলি থেকে দুর্গাপুজোয় সবাইকে পাঁঠার মাংস খাওয়ানো হয় অষ্টমীর দিন, অন্নপূর্ণা পুজোয় পোলাও-মাংস। বিপুল লাইন পড়ে। যারা খায় ও খাওয়ায়, সবাই তবে আরএসএস-বিজেপির হিন্দু সমাজ থেকে বাদ।
পঞ্চম ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের (২০১৯-২১) রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলার ৯৮% মানুষ মাংস ও ৯৯% মানুষ মাছ খান। দেশের বড় রাজ্যগুলির মধ্যে আমিষের জন্য খরচের হার বাংলায় সর্বাধিক খাওয়া খরচের ২০% আমিষে বরাদ্দ। জাতীয় গড়ের দ্বিগুণেরও বেশি। বাঙালির নিরামিষ বৈচিত্রও বিপুল। আনাজের খরচও জাতীয় গড়ের চেয়ে বেশি।
আসলে, সারা দেশের উপর নিরামিষ চাপিয়ে দেওয়ার এই প্রচেষ্টার কারণ, দেশের উত্তর, পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চল— ভারতের যে হিন্দি বলয় বা ‘গো বলয়’— সেটাই তাঁদের মূল ঘাঁটি। গুজরাত, রাজস্থান, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশে খাদ্যের জন্য মোট ব্যয়ের যথাক্রমে মাত্র ২%, ৩%, ৪%, ৫% ও ৭% হয় আমিষে। উত্তরপ্রদেশে এই ব্যয় করেন মূলত দলিত ও মুসলিমরা। এই রাজ্যগুলিতে খাওয়ার খরচে সর্বাধিক ব্যয় দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যে— বাংলার ঠিক উল্টো। কিন্তু ওই উল্টোটাই আরএসএস-বিজেপির ‘সহী হিন্দু খানা’।
২০২২-এর সেপ্টেম্বরে ভাগবত বলেন, খাদ্যাভ্যাস কারও উপর চাপিয়ে দেওয়া অনুচিত, কিন্তু ধীরে ধীরে অভ্যাসের পরিবর্তন সম্ভব। এই ‘চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়’ বলার পরও তিনি সরকারি ভাবে নিয়ন্ত্রণের দাবি তোলেন। এ বছরই অগস্টে, দিল্লিতে একটি অনুষ্ঠানে ভাগবত বলেন, যে হেতু ‘উৎসবের সময় নিরামিষ খাওয়া স্বাভাবিক’, তাই সেই সময়ে তাঁদের বাড়ির সামনে কাউকে মাংস খেতে বা বিক্রি করতে দেখলে তাঁদের অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে। সুতরাং, উৎসবের সময় সবারই আমিষাহার থেকে বিরত থাকা উচিত।
অর্থাৎ, আমিষাশীরা স্বেচ্ছায় নিরামিষাশীদের অনুভূতির সম্মানে আমিষ ত্যাগ না করলেই আইন আসবে। প্রশ্ন হল— আমিষাশীদের কি তবে অনুভূতি নেই? আরএসএস-এর নীতি অনুযায়ী বিজেপি-শাসিত রাজ্যে হিন্দু উৎসবের সময় মাছ-মাংস বিক্রি বন্ধ করা হচ্ছে। মিড-ডে মিল থেকে ডিম তুলে নেওয়া হচ্ছে। নবরাত্রির জন্য আমিষ বন্ধ হচ্ছে, ওই একই সময়ে চলা দুর্গাপুজোর জন্য কিন্তু কোনও ছাড় থাকছে না। অর্থাৎ, বিজেপি রাজ্যে দুর্গাপুজোকে নবরাত্রির অধীন হতে হচ্ছে।
আবার ২০২২-এর ডিসেম্বরে জল সংরক্ষণ বিষয়ক এক সম্মেলনে ভাগবত বলেন, মাংস রান্না এবং কসাইখানায় প্রচুর জলের ব্যবহার হয় এবং জল দূষণেও কসাইখানার উল্লেখযোগ্য অবদান আছে। “অতএব, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও, নিরামিষভোজই শ্রেয়।”
তিনি জলসঙ্কট প্রসঙ্গে আমিষকে টেনে আনলেন, যেখানে ভারতে মাথাপিছু বার্ষিক আমিষ গ্রহণের পরিমাণ (১.৩ কেজি) আন্তর্জাতিক গড়ের এক-দশমাংশ মাত্র। ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, প্রাণিজ খাদ্য, যথা মাংস, মাছ, ডিম, দুধ, চিজ় খাওয়ায় বিশ্বের ২৫টি সর্বাধিক জনবহুল দেশের মধ্যে ভারত একেবারে তলায়, আফ্রিকার তানজ়ানিয়ার থেকেও কম। দেশে জনসংখ্যার ১২% অপুষ্ট। সরকারি তথ্য-মতে, পাঁচ বছরের নীচে শিশুদের মধ্যে ৩৫.৫% অস্বাভাবিক খর্বকায় (স্টান্টেড), ৩২.১%-এর ওজন কম (আন্ডারওয়েট), ১৯.৩% উচ্চতার তুলনায় হালকা (ওয়েস্টেড)।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)-এর ২০২৪-এর প্রকাশনা মতে, খাদ্য থেকে আহৃত মোট শক্তির ১৪% ডাল বা আমিষ থেকে আসা উচিত, কিন্তু গড়ে এক জন ভারতীয়ের ক্ষেত্রে তা আসে ৬ থেকে ৯%। তাঁদের মতে, ডাল, মাছ ও মাংসের দাম তুলনায় বেশি বলেই অধিকাংশ মানুষ তা প্রয়োজনমতো পান না।
অতিরিক্ত মাংস ও প্রসেসড মিট পশ্চিমা, উন্নত দেশগুলির সমস্যা। তা ছাড়া, ইন্ডিয়ান এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর ২০২১ সালের একটি স্টাডি দেখায়, আনাজের সঙ্গে মুরগি বা ডিম সমেত যে মিল, তার থেকে বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করে আনাজ ও দুগ্ধজাত খাবার মিলে যে থালি তৈরি হয়।
কিন্তু পরিবেশ সংক্রান্ত দিক থেকে ভারতের কাছে যেগুলি জ্বলন্ত বিপদ, যেমন স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকলের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার বা অরণ্য ছেদন— সেগুলি নিয়ে আরএসএসকে কিছুই বলতে শোনা যায় না। কারণ হিন্দুত্ববাদীদের মূল পৃষ্ঠপোষক হল দামি গাড়ি, প্রাইভেট জেট বা অরণ্য ছেদনের মূল উপভোক্তা যাঁরা, সেই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী— যাঁদের অধিকাংশই নিরামিষাশী।
এক দিকে দেশের জনগণের আমিষের প্রয়োজনীয়তা, আর এক দিকে তাঁদের উপর নিরামিষ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন বলেই ১৮৯৭ সালের এপ্রিলে সরলা ঘোষালকে একটি চিঠিতে বিবেকানন্দ— যিনি নিজে আমিষাশী ছিলেন— লেখেন, সমাজের উপর স্তরের ১০% যাঁরা কায়িক শ্রমের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন না, তাঁরা নিরামিষ খেলে খান, কিন্তু যাঁদের দিনরাত পরিশ্রম করে গ্রাসাচ্ছাদন করতে হয়, তাঁদের উপর নিরামিষ চাপিয়ে দেওয়া আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা হারানোর অন্যতম কারণ।
আইসিএমআর বলে, বাড়ন্ত শিশু, কিশোর-কিশোরী, গর্ভবতী মহিলা এবং অসুস্থ ব্যক্তিদের বেশি প্রোটিনের প্রয়োজন। দুধ, মাংস, মাছ এবং ডিমের মতো প্রাণিজ খাবার এবং ডালের মতো উদ্ভিদজাত খাবার প্রোটিনের সমৃদ্ধ উৎস। কিন্তু প্রাণিজ প্রোটিন উচ্চমানের, কারণ এতে এগুলি সঠিক অনুপাতে সমস্ত প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড সরবরাহ করে। উদ্ভিদজাত খাবার থেকে আয়রনের প্রাপ্যতা কম, কিন্তু মাছ-মাংস থেকে অনেক আয়রন পাওয়া যায়। তাই তাদের পরামর্শ, প্রতি দিনের খাদ্যতালিকায় বিভিন্ন ধরনের ডাল, বাদাম, মাছের পাশাপাশি দুধ এবং ডিম অন্তর্ভুক্ত করুন।
২০২২-এর সেপ্টেম্বরে ভাগবত বলেন, ‘ভুল ধরনের খাবার খাওয়া উচিত নয়’ এবং যে খাবারের সঙ্গে অতিরিক্ত হিংসা— অর্থাৎ প্রাণিহত্যা— জড়িয়ে, তা এড়িয়ে চলা উচিত। ‘ভুল’ বা ‘তামসিক খাদ্য’ মানুষকে ভুল পথে নিয়ে যাবে। বলা বাহুল্য, তামসিক বলতে আমিষ বুঝিয়েছেন।
ওঁদের মতে যা সাত্ত্বিক বা ভাল/সঠিক খাদ্য, সেই নিরামিষ ভোজে শীর্ষে আছে রাজস্থান, গুজরাত, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ। ভারতের যে রাজ্যগুলিতে ৬ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে কন্যার অনুপাত পুত্রের তুলনায় সবচেয়ে কম, সেগুলির মধ্যে জম্মু ও কাশ্মীর ছাড়া বাকি সব মূলত নিরামিষভোজী রাজ্য। সেক্স রেশিয়োর ক্ষেত্রেও, যে বড় রাজ্যগুলির গড় জাতীয় গড় ১,০০০ পুরুষে ৯৪৩ নারীর তুলনায় কম, সেগুলি মূলত নিরামিষভোজী রাজ্য।
দেশের জনসংখ্যার ৫.৬৬% রাজস্থানের। রাজ্যের তিন-চতুর্থাংশ নিরামিষাশী। কিন্তু ২০২০, ২০২১ ও ২০২২-এ দলিতদের উপর হিংসার ঘটনায় ভারতে নথিভুক্ত মোট ১,৫৮,৭৭৩টি ঘটনার প্রায় ১৫% রাজস্থানের। রাজস্থানে পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে শিক্ষার হারের পার্থক্য দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি— পুরুষদের ৭৯.২% আর মহিলাদের ৫২.১%। ছয় বছরে নীচে শিশুদের মধ্যে যেখানে জাতীয় গড় হল প্রতি ১,০০০ পুত্রে ৯১৪ কন্যা, রাজস্থানে তা ৮৮৩ কন্যা। ৭০% নিরামিষাশী হরিয়ানায় এই সংখ্যা ৮৩০। ২০২০-২১ ও ২২-এর সরকারি তথ্য অনুযায়ী, হত্যা মামলার হার হরিয়ানা ও রাজস্থানে বাংলার চেয়ে বেশি।
তা হলে, এত সাত্ত্বিক আহার তাঁদের কোন সুপথে নিয়ে গেল? না কি, এটাই সুপথ?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)