সর্বনাশের অর্ধেক ত্যাগ করাই শ্রেয়— জ্ঞানীরা বলেন। কিন্তু কেউ যদি সারার্ধ ত্যাগ করে অসারার্ধ আঁকড়ে ধরার প্রয়াসী হন তবে বুঝতে হবে, হয় জ্ঞানের অভাব, নয়তো ওই অসারার্ধেই তাঁর গোপন স্বার্থ লুকোনো। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ২০১৬-র এসএসসি-র পুরো প্যানেল বাতিল হওয়ার সঙ্গে আরও যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম হল ‘স্পেসিফিক্যালি টেন্টেড’ শিক্ষকদের কাছ থেকে বেতন বাবদ দেওয়া পুরো টাকা আদায় করতে হবে এবং ‘নট স্পেসিফিক্যালি টেন্টেড’ শিক্ষকদের চাকরি ফেরত পেতে ফের পরীক্ষায় বসার ব্যবস্থা করতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি বার করেছে বটে, তবে এখনও পর্যন্ত ‘স্পেসিফিক্যালি টেন্টেড’ হিসাবে চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের থেকে টাকা ফেরত নেওয়ার কোনও উদ্যোগ করেনি। আইন অনুযায়ী ঘুষ দেওয়া ও নেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও, ‘ঘুষদাতা’ বলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত কোনও তদন্ত শুরু তো হয়ইনি, যারা ঘুষ নিয়েছে বলে অভিযোগ, তাদের চিহ্নিত করার কাজও শুরু হয়নি। আরও আশ্চর্যের, বিজ্ঞপ্তিতে শীর্ষ আদালতের রায় অনুযায়ী দাগিদের জন্য এই নতুন পরীক্ষায় বসার সুযোগ বহাল রাখা হয়েছে।
স্বাভাবিক বোধসম্পন্ন মানুষমাত্রেই বুঝতে সক্ষম, শীর্ষ আদালতের চূড়ান্ত রায়ের নিরিখে এ পুরোপুরি অবৈধ। তার পরেও যদি তর্কের খাতিরে ধরা যায় যে, সরকারের সুশিক্ষিত আমলাকুল ও আইনবেত্তা পরামর্শদাতাদের অজ্ঞানতা বা অনবধানে বিজ্ঞপ্তিতে ত্রুটি রয়ে গেছে এবং এর ফলে উদ্ভূত আইনি জটিলতা অগ্রিম আঁচ করা সম্ভব হয়নি, তবে যাঁদের গাফিলতি বা অদূরদর্শিতায় তা ঘটল, তাঁদের কাছে জবাবদিহি তলব এবং ওই বিজ্ঞপ্তি বাতিল করে নতুন করে বিজ্ঞপ্তি জারি, অন্তত একটা সংশোধনী প্রকাশ সঙ্গত ছিল। রাজ্য সরকার সে পথে হাঁটল না, উপরন্তু দাগি শিক্ষকদের নতুন করে পরীক্ষায় বসার সুযোগ বহাল রাখতে উচ্চ আদালতের সিঙ্গল বেঞ্চ থেকে ডিভিশন বেঞ্চ পর্যন্ত ছোটাছুটি করে রাজ্যের ভাবমূর্তি ও জনকোষাগারের বিপুল অর্থ জলাঞ্জলি দিতেও পিছপা হল না।
ওএমআর শিটের মিরর ইমেজ প্রকাশ, বা প্রকৃত যোগ্য এবং অযোগ্যদের পৃথক তালিকা প্রকাশ করলে হয়তো অনেক আগেই এ সমস্যার সমাধান হত। কিন্তু ঘুষের বিনিময়ে নিযুক্ত চাকুরেদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার এখনও পর্যন্ত অনড়। ফলে মেধার ভিত্তিতে চাকরি পাওয়া শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের ভবিষ্যতের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের হতমান শিক্ষাব্যবস্থা আরও বেশি বিপন্ন হয়ে উঠছে। অথচ সরকারের শুভবুদ্ধি উদয়ের চিহ্নও দেখা যাচ্ছে না।
এই প্রেক্ষিতে যথার্থ বোধসম্পন্ন অনেকে আর একটা গুরুতর প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন: সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে বলীয়ান হলেই কি কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অন্যায্য স্বার্থরক্ষায়, বা জনস্বার্থের সঙ্গে সম্পর্করহিত বিষয় নিয়ে সরকারের তরফে বার বার আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার অধিকার জন্মায়? প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক এ জন্য যে, এ ধরনের পদক্ষেপে শুধু রাজ্যের ভাবমূর্তিই ক্ষুণ্ণ হয় না, জনগণের করের টাকার অপচয় ঘটে, এবং অকাজে সরকারি প্রশাসনযন্ত্রকে ব্যস্ত থাকতে হয়। অর্থ ও শ্রমঘণ্টার অপব্যবহার দায়িত্ব-কর্তব্য প্রতিপালনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, ফল ভুগতে হয় সাধারণ মানুষকেই।
অতীতে কেবল বিভিন্ন সরকারি পদে নিয়োগ-দুর্নীতি আড়াল করতেই নয়, সারদা, নারদা, রোজ় ভ্যালির মতো গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক কেলেঙ্কারি, কয়লা চুরি, বালি চুরি, গরু পাচার, শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থের গন্তব্য-সহ নানা দুর্নীতি-তদন্তে সিবিআই বা ইডি-র মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাকে আটকাতে বারংবার আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে এই সরকার। এমনকি প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, একশো দিনের কাজ বা আমপান-ত্রাণ বিতরণে বিপুল আর্থিক দুর্নীতির ফলে প্রান্তিক দরিদ্র মানুষরা বঞ্চিত হলেও, সরকারের আদালতমুখিতার পরিবর্তন ঘটেনি। জনকোষাগারের রাশি রাশি টাকা খরচ হলেও অধিকাংশ মামলায় রাজ্য সরকার শুধু পরাজিতই হয়নি, বহু বার আদালতের রোষের মুখে পড়তে হয়েছে সরকারপক্ষের কৌঁসুলিকে।
অনেকের অভিযোগ, জয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ জানা সত্ত্বেও শুধু ‘সময় কিনতে’ও সরকার একই মামলায় বার বার আপিল-রিভিউ-রিভিশনের পথ নেয়। উদাহরণ হিসাবে তাঁরা রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘভাতা সংক্রান্ত মামলার কথা বলেন। আর একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার আগে রাজ্যের মানুষের স্বার্থ রক্ষার্থে বিষয়টি কেন অপরিহার্য, আদালতে তা গ্রাহ্য হওয়ার সম্ভাবনা কতখানি, মামলার আনুমানিক খরচ ও তার প্রেক্ষিতে প্রতিবিধানের সম্ভাব্যতা, এক কথায় লাভ-ক্ষতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করার জন্য নির্দিষ্ট দফতর রয়েছে। সুপারিশের দায়িত্বে আছেন বেতনভুক একাধিক আইনি পরামর্শদাতা, পদস্থ আধিকারিক। তার পরেও একের পর এক মামলায় সরকার পর্যুদস্ত হলে, এঁদের অভিজ্ঞতা, আইনি প্রজ্ঞা ও মামলার ‘মেরিট’ মূল্যায়নের ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ জাগে। সরকারি অর্থের অনর্থক অপচয় ও সরকারের ভাবমূর্তির হানি হল বলে এঁদের কেন দায়বদ্ধ করা হবে না?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)