Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
Pandemic

অতিমারি এবং গণনা বিতর্ক

কোভিড-পরীক্ষায় জনগণের অনীহা এবং পরিকাঠামোর অভাব নিঃসন্দেহে অনেক কোভিড-মৃত্যুকে কোভিড হিসেবে নথিভুক্ত করায়নি, কমবেশি সব দেশেই।

অতনু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০২২ ০৪:৩৬
Share: Save:

চতুর্দশ শতকের ইউরোপের প্লেগ মহামারি ‘ব্ল্যাক ডেথ’-এ নাকি মৃত্যু হয়েছিল ৭.৫ কোটি থেকে ২০ কোটি মানুষের। শতাব্দী-প্রাচীন ‘স্প্যানিশ ফ্লু’-তে মারা গিয়েছে ১.৭ কোটি থেকে ১০ কোটি। কী সাঙ্ঘাতিক রকমের বিস্তৃত এবং ভাসা-ভাসা এই হিসাব! বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুগাঁথার ইতিবৃত্তে বিস্মিত হওয়া যেতে পারে এই ভেবে যে, মানুষের সভ্যতা সংক্রমিতদের হিসাব রাখতে আর মৃত্যুমিছিলের দৈর্ঘ্য মাপতে কতটা কাঁচা ছিল সে সময়ে। কেউ ভাবতেই পারেন, আজকের ডিজিটাল দুনিয়ায় কোভিড-মৃত্যুর হিসাবটা অন্তত এমন রহস্যময় হবে না।

অথচ কোভিডে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যায় গরমিলের বিস্তর অভিযোগ। একেবারে প্রথম দিকে ইটালি যখন ধুঁকছে, মিলানের শিক্ষক লিখলেন, অনেক মানুষ মরছেন যাঁরা কোভিডের পরীক্ষাই করাননি, তাই তাঁরা সরকারি হিসাবে নেই। এই ভয়ঙ্কর অতিমারি দেশে দেশে চিকিৎসা পরিষেবার কঙ্কাল এ ভাবেই বার করে ছেড়েছে। পরীক্ষা ব্যবস্থা, অক্সিজেন, হাসপাতালের বেড, চিকিৎসা, এমনকি সৎকারেরও যুগসঞ্চিত পরিকাঠামো তো আর তৈরি নয় এমন বিপর্যয়ের ঝাপ্টা সহ্য করতে।

বিভিন্ন গবেষণাপত্রে নানা তথ্য নিংড়ে বলা হতে লাগল পৃথিবীর নানা দেশেই কোভিডে মৃত্যুর আসল সংখ্যা সরকারি হিসাবের চাইতে ঢের বেশি। কোথাও ৪-৫ গুণ, কোথাও বা ১০ গুণ। আমেরিকার সেন্টারস ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন-এর এক হিসাব অনুসারে, সে দেশে নাকি কোভিডে ‘অতিরিক্ত’ মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় দশ লক্ষ। একটি হিসাবে ২০২২-এর মার্চ পর্যন্ত আমেরিকায় সংখ্যাটা সাড়ে এগারো লক্ষের বেশি। স্মরণীয়, আমেরিকার জনসংখ্যা কিন্তু ভারতের এক-চতুর্থাংশ।

ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজ়েশনের এক সাম্প্রতিক রিপোর্ট নিয়ে গোল বেধেছে বিস্তর। সেখানে ২০২০-২১ এই দু’বছরে ভারতে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যার অনুমান হয়েছে ৪৭.৪ লক্ষ, যেখানে সরকারি হিসাবে ২০২০-র ‘অতিরিক্ত মৃত্যু’র সংখ্যাটা প্রায় তার এক-দশমাংশ, পাঁচ লক্ষের কাছাকাছি। ২০২১-এর সরকারি তথ্য যদিও এখনও পাওয়া যায়নি। ‘হু’-র হিসাবের সঙ্গে সরকারি তথ্যের বিপুল ব্যবধান নিয়ে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েছে ভারত আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ভারত অভিযোগ তুলেছে ‘হু’-র রিপোর্টে ব্যবহৃত বেসরকারি তথ্য নিয়ে। আবার ‘হু’-র ব্যবহৃত তথ্য নাকি ভারতের ১৭টি রাজ্যের উপরে, যার উপরে ভিত্তি করেই অনুমান করা হয়েছে গোটা দেশটার মৃত্যু-মিছিলের দৈর্ঘ্য। বিশাল দেশের বিভিন্ন অংশে কোভিডের থাবার প্রভাব অবশ্যই ভিন্ন মাত্রার। কেরল বা মহারাষ্ট্রের মতো সাঙ্ঘাতিক ভাবে প্রভাবিত রাজ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যদি গোটা দেশের সংখ্যার হিসাব কষা হয়, তবে তো তা আকাশ ছুঁতে বাধ্য। আবার ‘হু’-র হিসাবে ভারতকে বলা হয়েছে ‘দ্বিতীয় স্তর’-এর দেশ, যাদের জাতীয় এবং স্থানীয় স্তরের মৃত্যুর তথ্য নেই। অসন্তুষ্ট হয়েছে সরকার। অভিযোগ ‘হু’-র তথ্য-বিশ্লেষণের মডেল নিয়েও, সব দেশের জন্য একই মডেল কি সুপ্রযুক্ত?

সম্প্রতি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অর্থনীতির শিক্ষক ২০২১-এর অগস্ট পর্যন্ত ভারতে ৬৩ লক্ষ অতিরিক্ত মৃত্যুর হিসাব দিয়েছেন। মিডিয়া কিংবা সাধারণ মানুষের পক্ষে এই সব অনুমানের অন্তর্নিহিত তথ্য, মডেল যাচাই করা অসম্ভব।

কোভিড-পরীক্ষায় জনগণের অনীহা এবং পরিকাঠামোর অভাব নিঃসন্দেহে অনেক কোভিড-মৃত্যুকে কোভিড হিসেবে নথিভুক্ত করায়নি, কমবেশি সব দেশেই। কিন্তু যে সব দেশে অন্তত মোট মৃত্যু-সংখ্যার সঠিক তথ্য রয়েছে গত দশ-বিশ বছরের, তাদের পক্ষে কোভিডে অতিরিক্ত মৃত্যুর হিসাব কষা সম্ভব। ২০১৯ পর্যন্ত গত কিছু ‘স্বাভাবিক’ বছরের মৃত্যু-সংখ্যাকে সেই দেশের প্রেক্ষিতে রাশিবিজ্ঞানের উপযুক্ত ছাঁচে ফেলতে হবে। মডেলে মৃত্যু-সংখ্যা এগোবে সময়-সারণির পথ বেয়ে। মডেলটা যদি কাজের হয়, তা হলে সময়ের জায়গায় ২০২০ বা ২০২১ ‘ইনপুট’ দিলেই পাওয়া যাবে— অতিমারি না হলে সেই বছরগুলোতে ‘স্বাভাবিক’ মৃত্যু-সংখ্যা যা হতে পারত তার অনুমান। সংশ্লিষ্ট দেশে ২০২০-২১’এর মোট মৃত্যু-সংখ্যা থেকে এই অনুমেয় সংখ্যাটা বিয়োগ করলেই পাওয়া সম্ভব কোভিডে মৃত্যুর ‘আনুমানিক’ সংখ্যা। যে কোনও বিপর্যয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপের এটাই প্রচলিত পদ্ধতি। পদ্ধতিটা শুনতে আপাত ভাবে সহজ, বাস্তবে অবশ্য ততটা নয়। তথ্যে কিংবা মডেলে ভুল হলে সব তালগোল পাকিয়ে যেতে বাধ্য। কোভিড-কালেই আমরা দেখেছি বিভিন্ন ঢেউয়ের আগমন-কাল কিংবা কোভিডে মোট মৃত্যুর সংখ্যার অনুমান নিয়ে বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংখ্যার গোলমেলে পরস্পর-বিরোধী অনুমান।

যা-ই হোক, তথ্যে ভুলভ্রান্তি থাকলে অনুমানও কঠিন হয়ে পড়ে। তবে তথ্যের ফাঁকফোকর মেরামত করে অনুমান করা একেবারে অসম্ভবও নয়। প্রয়োজন রাশিবিজ্ঞানের দক্ষতর প্রয়োগ।

এ সমস্ত দশ-পঁচিশ খেলার মধ্যে ‘কমন ম্যান’ কিন্তু হতভম্ব, এবং নীরব। এ সব পরস্পর-বিরোধী হিসাবনিকেশের ফলেই হয়তো শতবর্ষ পরে কোভিড-মৃত্যুর পরিসংখ্যান দেওয়া হবে ব্ল্যাক ডেথ কিংবা স্প্যানিশ ফ্লু-র মতোই একটা অতি বিস্তৃত সংখ্যা-ব্যবধানে। গণনায় কী ভীষণ কাঁচা ছিল একুশ শতকের বিশের দশকের মানবসভ্যতা, সে নিয়ে জমিয়ে লিখতে বসবে সে যুগের প্রাবন্ধিক।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

অন্য বিষয়গুলি:

Pandemic COVID-19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE