Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
এত নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে কি সেনার দায়িত্ব পালন করা যায়?
Agnipath Scheme

অগ্নিপথে সঙ্ঘ-স্বার্থের সিদ্ধি

গত ১৪ জুন তিন সেনাপ্রধানকে পাশে বসিয়ে অগ্নিপথ প্রকল্প চালু করার কথা ঘোষণা করেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ।

আশঙ্কিত: জালন্ধর-দিল্লি জাতীয় সড়কে ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধরা। ১৮ জুন, ২০২২।

আশঙ্কিত: জালন্ধর-দিল্লি জাতীয় সড়কে ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধরা। ১৮ জুন, ২০২২। ছবি: পিটিআই

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০২২ ০৪:৫৪
Share: Save:

অগ্নিপথ’ নামে ছোট একটি কবিতা লিখেছিলেন হরিবংশ রাই বচ্চন আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। কোনও প্রতিদানের আশা না নিয়ে অক্লান্ত এগিয়ে চলার প্রেরণাদায়ী একটি রচনা। ১৯৯০ সালে সেই শীর্ষককে ব্যবহার করে বলিউডে একটি সিনেমা তৈরি হয়। কবিপুত্র অমিতাভ বচ্চন অভিনীত সেই চলচ্চিত্রের মূল বিষয় অবশ্য প্রতিশোধ। পিতৃহত্যার প্রতিশোধের আগুন একটি ছেলেকে কোন পথে ঠেলে দেয়— সেটাই সিনেমার কাহিনি। তথ্য বলছে, বত্রিশ বছর পর এই সিনেমার এক দ্বিতীয় সংস্করণও বাজারে এসেছিল। কবিতা বা ফিল্ম কিন্তু বাস্তবে বা বক্স অফিসে আগুন লাগাতে পারেনি। তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও অনেক বছর। বলা বাহুল্য, ‘অগ্নিপথ’ নামকে আজ আক্ষরিক ভাবে চরিতার্থ করার কৃতিত্ব একশো ভাগ মোদী সরকারের।

গত ১৪ জুন তিন সেনাপ্রধানকে পাশে বসিয়ে অগ্নিপথ প্রকল্প চালু করার কথা ঘোষণা করেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। ওই একই দিনে আগামী দেড় বছরের মধ্যে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দশ লক্ষ খালি সরকারি পদে নিয়োগের কথা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রধানমন্ত্রী দশ লক্ষ পদের কথা বললেন, আর প্রতিরক্ষামন্ত্রী বললেন মাত্র ছেচল্লিশ হাজার নিয়োগের কথা। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে গোটা দেশের নজর গিয়ে পড়ল দশ লক্ষকে ছেড়ে ওই ছেচল্লিশ হাজারের উপর। দেখতে না দেখতে বিহার থেকে হরিয়ানা, রাজস্থান থেকে তেলঙ্গানা, গোটা দেশ জুড়ে শুরু হয়ে গেল স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের ঝড়। সেই ঝড়ের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে আন্দোলনরত কৃষক মোর্চা, ছাত্র-যুবসমাজ এবং প্রতিবাদী জনতা। প্রধানমন্ত্রীর কথায় কর্ণপাত না করে রাজনাথ সিংহের ঘোষণাকে কেন যুবসমাজ এত পাত্তা দিতে গেল?

এর সোজা কারণ, অগ্নিপথ এক ধাক্কায় ভারতের সেনাবাহিনীতে কর্মসংস্থানের মানচিত্র ও গতিপথ বদলে দিয়েছে। প্রতি বছর যেখানে সত্তর থেকে আশি হাজার যুবক-যুবতী স্থায়ী কাজের সুযোগ পেতেন, তাঁদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিবারের জন্য সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তার রাস্তা খুলে যেত, অগ্নিপথ প্রকল্পের ফলে সেই সংখ্যাটা এক ধাপে নেমে আসবে সাড়ে এগারো হাজারে। হ্যাঁ, বছরে ছেচল্লিশ হাজার ভাবী অগ্নিবীরদের এক-চতুর্থাংশ বা মাত্র সাড়ে এগারো হাজার জন নতুন করে পরীক্ষা দিয়ে নিয়মিত কাজের সুযোগ পাবেন। ভারতীয় রেলের পরে এযাবৎ ভারতীয় সেনাই ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম নিয়োগকারী সংস্থা। সেখানে আগামী এক দশকে নিয়মিত বা স্থায়ী সেনার সংখ্যা তলানিতে এসে ঠেকবে। এত দিন সেনাবাহিনীকে শোনানো হয়েছে এক স্তরের জন্য এক পেনশনের প্রতিশ্রুতি। সে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের ত্রুটি নিয়ে এখনও অসন্তোষ রয়েছে। কিন্তু এখন বেতন ও পেনশনের বিল কম করার জন্য অগ্নিপথ প্রকল্পে পে স্কেল ও পেনশন ব্যাপারটাই তুলে দেওয়া হল। চার বছর পর এককালীন যে প্যাকেজের কথা বলা হচ্ছে, তার অর্ধেক টাকাই অগ্নিবীরদের বেতন থেকে কেটে নেওয়া অংশ।

হঠাৎ করে এই অগ্নিপথ প্রকল্প চালু করার প্রয়োজন কেন পড়ল? প্রতিরক্ষা দফতরের মুখপাত্রের মতে, গত তিন দশক ধরে নাকি এই চিন্তাভাবনা চলছিল। আর তাকে বাস্তবায়িত করার সুবর্ণসুযোগ এসে গেল কোভিড অতিমারির মাধ্যমে। পাঠকদের মনে থাকবে, লকডাউনে যখন দীর্ঘ দিন দূরপাল্লার ট্রেন বন্ধ ছিল, তখনই রেল কর্তৃপক্ষ একশো পঞ্চাশটি রুটে প্রাইভেট ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এখন দেখা যাচ্ছে, সেনাবাহিনীও কোভিডের অজুহাতে গত দু’বছর ধরে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রেখে সেই সুযোগে পুরো নিয়োগ নীতিকেই স্বল্পমেয়াদি ও ঠিকাভিত্তিক করে ফেলেছে। একেই সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন সঙ্কটে সুযোগ খোঁজা। বর্তমানের পুঁজিবাদী বিশ্বে ক্রোনি ক্যাপিটালিজ়ম বা স্বজনতোষী পুঁজিবাদের মতো এ-ও এক উদীয়মান ঘরানা— ডিজ়াস্টার ক্যাপিটালিজ়ম বা বিপর্যয় শিকারি পুঁজিবাদ।

সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, অগ্নিপথের ফলে সেনার গড় বয়স কমে আসবে। সেনার যৌবনায়ন ঘটবে। সেনাতে তো কম বয়সিদেরই নিয়োগ করা হত। আসল রহস্য হল, অধিকাংশ সৈনিকদের জন্য অবসরের বয়স কমিয়ে দিয়ে জোর করে সেনার বয়স কমানো হচ্ছে। বছর বছর একুশ থেকে পঁচিশ বছর বয়সের পঁয়ত্রিশ হাজার অগ্নিবীর অবসর নিয়ে ঘরে ফিরে আসবেন। সেনার আকার ক্রমেই কমে আসবে এবং স্বল্পমেয়াদি ঠিকা সৈনিকরাই হয়ে উঠবেন সেনার বড় শক্তি। এই কারণেই সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের অনেকেই এই প্রকল্পকে ‘অপ্রয়োজনীয়’, এমনকি ‘সর্বনাশা’ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। আমরা জানি, প্রয়াত জেনারেল বিপিন রাওয়ত, হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় যাঁর মৃত্যুর পর থেকে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ আসনটি ফাঁকাপড়ে রয়েছে, এই প্রকল্প সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন। রণক্ষেত্রে তরুণ সৈনিকদের প্রয়োজনের পাশাপাশি তিনি চেয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে সাধারণ ভাবে অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে দিতে। সেনাবাহিনীর সমস্ত শক্তি ও ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে প্রশিক্ষিত এক জন তরুণকে মাত্র চার বছরের মধ্যে অবসরে পাঠিয়ে দেওয়ার কোনও যুক্তি তিনি খুঁজে পাননি।

যে সামাজিক-আর্থিক নিরাপত্তার ভিত্তিতে ঝুঁকি নিয়ে সৈনিকেরা কাজ করেন, নিরাপত্তাহীনতার ফলে সেই মনের জোর ও ঝুঁকি নেওয়ার সাহস দুর্বল হয়ে পড়বে, এ কথাও অনেকেই বলছেন। নিয়মিত সেনা ও স্বল্পমেয়াদি সেনার মধ্যে সমন্বয়ের পরিবেশ গড়ে তোলাটাও হবে এক বড় চ্যালেঞ্জ। ভারতের বহু গ্রামে এক জন গ্রামবাসীর সেনায় যোগ দেওয়াটা গোটা গ্রামের কাছে সম্মান ও আনন্দের ব্যাপার। কর্তব্যরত সৈনিকের মৃত্যুতে গোটা গ্রাম শোক পালন করে। সেখানে এই চার বছরের মাথায় ঘরে ফিরে আসা অগ্নিবীরদের সামাজিক পুনর্বাসন কী ভাবে হবে, সেটাও বড় প্রশ্ন। সরকারি ভাষ্যে ঘরে ফিরে আসা অগ্নিবীরদের সোনালি আর্থিক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে আদানি-অম্বানী-টাটারা লুফে নেবে। এখন যাঁরা চল্লিশ বছর বয়সে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে সেনা থেকে ঘরে ফিরে আসছেন, তাঁদের অধিকাংশই অফিস, ব্যাঙ্কের নিরাপত্তারক্ষী বা এটিএমের পাহারাদারের কাজ পান। আর মাত্র চার বছরের অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের অম্বানীরা লুফে নেবে?

নোট বাতিল, জিএসটি, এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধন আইন, অপরিকল্পিত লকডাউন, কৃষি আইন, অগ্নিপথ। মোদী সরকারের এই সব ক’টি পদক্ষেপই দেশে ব্যাপক আর্থিক সঙ্কট অথবা গভীর সামাজিক অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র কৃষি আইনের ক্ষেত্রে সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। তাও এই বলে যে, কৃষকদের তাঁদের ভালটা বোঝানো গেল না। অগ্নিপথের ক্ষেত্রেও সরকার একই কথা বলছে। সঙ্গে হুমকি, কোনও প্রতিবাদী আন্দোলনে যোগ দিলে যুবকেরা চাকরির সুযোগ হারাবেন। সেনাবাহিনীর পুরো গঠন ও নিয়োগব্যবস্থাকে কোনও রকম আলোচনা ছাড়াই এ ভাবে বদলে দেওয়াটা যে গণতান্ত্রিক দেশে চলতে পারে না, এই গোড়ার কথাটাই এ সরকার মানতে নারাজ। গণতন্ত্র মানে শুধু ভোটে জিতে সরকার বানিয়ে ফেলে যা খুশি করার লাইসেন্স পাওয়া নয়। সরকার পরিচালনা ও নীতি নির্ধারণের প্রতিটি পদক্ষেপে সংশ্লিষ্ট সব মহলের সঙ্গে কথোপকথন চালানো এবং জনগণের ও সমালোচকদের কথা শোনা গণতন্ত্রের আবশ্যক শর্ত। অগ্নিপথ বাতিলের দাবিতে যুবসমাজের প্রতিবাদ গণতন্ত্রের এই মূল কথাটা আবার দেশের সামনে তুলে ধরছে।

শুধু যুবসমাজের আর্থিক ভবিষ্যৎ নয়, ভারতের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্যও আশঙ্কার প্রশ্নচিহ্ন তুলে ধরেছে অগ্নিপথ। ইটালি ও জার্মানির ইতিহাস বলে, মুসোলিনি ও হিটলারের ফ্যাসিবাদী ধ্বংসযজ্ঞে ব্ল্যাক শার্ট ও ব্রাউন শার্টের মতো মিলিশিয়ার বিরাট ভূমিকা ছিল। কৈলাশ বিজয়বর্গীয় যখন বলেন, অগ্নিবীরদের বিজেপি অফিসে নিরাপত্তারক্ষীর কাজে লাগানো হবে, বা মধ্যপ্রদেশের আর এক বিজেপি সাংসদ যখন টুইট করেন, চার বছর দেশকে রক্ষা করার পর ঘরে ফেরা অগ্নিবীররা বিধর্মীদের হাত থেকে নিজেদের পরিবারকে রক্ষা করবেন, তখন বুঝতে অসুবিধে হয় না ভারতীয় সেনাকে পুনর্গঠন করে সঙ্ঘবাহিনী নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করতে চাইছে। অগ্নিপথের অশনিসঙ্কেত থেকে তাই ভারতের যুবসমাজ, ভারতীয় সেনা ও ভারতীয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করার দায়িত্ব আজ প্রতিটি চিন্তাশীল নাগরিকের। কৃষকরা তাঁদের সন্তান ও সঙ্গীদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। আসুন, আমরা সকলেই দাঁড়াই।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

অন্য বিষয়গুলি:

Agnipath Scheme Protest
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE