E-Paper

বহিষ্কার নয়, অন্তর্ভুক্তি

পশ্চিমবঙ্গেও কি তা হলে বাংলা ভাষাভাষী, ‘বাঙালি’, পরিচয়ের ভিত্তিতে গড়ে তোলা যায় অস্মিতার রাজনীতি? এখানেই নিহিত রয়েছে সেই ‘প্রায় অনতিক্রম্য জটিলতা’।

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০২৫ ০৫:১৯
রণক্ষেত্র: ভিন রাজ্যে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপরে নির্যাতনের প্রতিবাদ-মিছিলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

রণক্ষেত্র: ভিন রাজ্যে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপরে নির্যাতনের প্রতিবাদ-মিছিলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

বাঙালি জাতিসত্তার পরিচিতিকে ঘিরে সফল রাজনীতি তৈরি করা যায় কি না, বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে সওয়া শতাব্দী ধরে বাংলার হাওয়ায় এই প্রশ্নটা ঘুরছে। বিভিন্ন মুহূর্তে, বিভিন্ন আঙ্গিকে ফিরে এসেছে প্রশ্নটা, এবং প্রতি বারই তার উপরে পড়েছে নতুনতর প্রলেপ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঙালি অস্মিতার রাজনীতি সেই ঐতিহাসিক ধারার একটা নতুন অধ্যায়— যার মধ্যে একই সঙ্গে রয়েছে একটি ঐতিহাসিক সম্ভাবনা, এবং প্রায় অনতিক্রম্য জটিলতা।

যে কোনও অস্মিতার আখ্যানেই প্রয়োজন দুটো জিনিসের। এক দিকে একটি (তথাকথিত) সমসত্ত্ব গোষ্ঠী বা জাতি— যে গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত সবাই কোনও একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচিতিতে এক রকম; আর অন্য দিকে চাই সেই সমসত্ত্ব জাতির একটি ‘অপর’— অর্থাৎ, এমন একটি গোষ্ঠী, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচিতিতে সেই সমসত্ত্ব গোষ্ঠীর উল্টো দিকে আছে। দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে, অথবা মহারাষ্ট্র, গুজরাতে যে অস্মিতার রাজনীতি তৈরি হয়েছিল, সেখানে সমসত্ত্ব গোষ্ঠীটি ছিল ভাষাগত, অথবা ভাষানির্ভর জাতিপরিচিতিগত— আর, ‘অপর’ ছিল ভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী।

পশ্চিমবঙ্গেও কি তা হলে বাংলা ভাষাভাষী, ‘বাঙালি’, পরিচয়ের ভিত্তিতে গড়ে তোলা যায় অস্মিতার রাজনীতি? এখানেই নিহিত রয়েছে সেই ‘প্রায় অনতিক্রম্য জটিলতা’। প্রথমত, এ রাজ্যে ‘অপর’ হিসাবে চিহ্নিত করার মতো ভিন্ন ভাষাভাষী গোষ্ঠী তেমন প্রবল নয়। অতীতেও ছিল না। ফলে, মহারাষ্ট্রে বিহারি নিগ্রহের, অথবা অসমে বাঙালি খেদানোর মতো রাজনীতি বাংলায় তেমন দানা বাঁধেনি কখনও। আর একটা বড় কারণ হল, বাংলার ভাষা-অস্মিতার রাজনীতির রাশ বিবিধ কারণে থেকেছে ‘নবজাগরণের আলোকপ্রাপ্ত ভদ্রলোক’ শ্রেণির হাতে। সেই শ্রেণির মূল্যবোধ প্রভাবিত করেছে বাঙালি অস্মিতার সীমাকে। মহারাষ্ট্রের অনুকরণে ইদানীং যে ভিন্ন ভাষাভাষী খেদানোর রাজনীতি এ রাজ্যে চালু করার যে প্রয়াস দেখা যাচ্ছে, সেটা বাংলার চেনা রাজনৈতিক সংস্কৃতি নয়।

তার চেয়েও বড় কথা, হিন্দু বাঙালির ‘অপর’ তার বাঙালি পরিচিতির মধ্যেই ঢুকে আছে— মুসলমান বাঙালি। মহারাষ্ট্র বা গুজরাতের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের— এবং, অসমের— একটা মস্ত ফারাক রয়েছে। ২০১১ সালের জনশুমারি অনুসারে, এই দুই রাজ্যের জনসংখ্যায় মুসলমানদের অনুপাত যথাক্রমে ২৭ এবং ৩৪ শতাংশ। মহারাষ্ট্র ও গুজরাতে জনসংখ্যায় মুসলমানদের অনুপাত যথাক্রমে সাড়ে এগারো এবং সাড়ে নয় শতাংশ। কাজেই, পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে ভাষাগত পরিচিতির উল্টো দিকে রয়েছে ধর্মীয় পরিচিতি— ধর্মীয় পরিচয়ের ‘অপর’-কে সঙ্গে নিয়ে ভাষাগত পরিচয়ের সমসত্ত্ব জাতি তৈরি করার দুরূহ প্রকল্প।

এই জটিলতাটি কার্যত পশ্চিমবঙ্গের একার। কারণ, অসমের মুসলমান জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশই বাংলাভাষী— হিন্দু অহমিয়ার কাছে তাঁরা একই সঙ্গে ভাষাগত এবং ধর্মগত অপর। সে রাজ্যে বাঙালি বিদ্বেষ এবং মুসলমান বিদ্বেষ শেষ অবধি কী ভয়ঙ্কর চেহারা ধারণ করেছে, খবরের কাগজের পাতায় তার প্রমাণ খুব নিয়মিত চোখে পড়ে। উল্টো দিকে, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই বাংলাভাষী। ফলে, পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি জাতিসত্তা নির্মাণ করতে হলে অনিবার্য ভাবে দাঁড়াতেই হবে ধর্মীয় বিভাজিকাটির সামনে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু এবং সংখ্যালঘু মুসলমান, উভয় পক্ষকেই সম্মত হতে হবে ধর্মীয় পরিচিতিকে তুলনায় গৌণ বিবেচনা করে বাঙালি পরিচিতিকে প্রাধান্য দিতে। সওয়াশো বছরের বাঙালি পরিচিতির রাজনীতি বারে বারে ধাক্কা খেয়েছে এখানেই।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক এই জায়গাটাকেই বেছে নিয়েছেন ২০২৬-এর রাজনৈতিক যুদ্ধের কেন্দ্র হিসাবে— বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে তাঁর অস্ত্র বাঙালি অস্মিতা। অর্থাৎ, ধর্মীয় বিভাজনকে পাশে সরিয়ে রেখে বাঙালি পরিচয়ে একত্রিত হতে পারা এক দিকে যেমন তাঁর এই রাজনীতির সাফল্যের আবশ্যিক শর্ত, অন্য দিকে সেটা এই রাজনীতির মূল উদ্দেশ্যও বটে। তাঁর এই অবস্থানকে বলতেই হবে কৌশলগত, আদর্শগত নয়। তিনি উত্তর-আদর্শবাদী রাজনীতির কারবারি— ভিন্ন প্রেক্ষিতে ধর্মীয় পরিচয়কে রাজনীতির উপাদান হিসাবে স্বীকার করতে তাঁর আপত্তি নেই— যখন যেমন প্রয়োজন, তখন তেমন তিনি জগন্নাথ মন্দিরেও আছেন, রমজানেও আছেন। ভাষাগত বহুত্বকে স্বীকার করতে, এমনকি ভোটের হিসাব মাথায় রেখে বাংলা ভিন্ন অন্য ভাষাকে তোল্লাই দিতেও তিনি পিছপা হননি। তবে এই মুহূর্তে মমতা যে রাজনৈতিক কৌশলের পথে হাঁটছেন, তা বহিষ্কারের নয়, অন্তর্ভুক্তির— বর্জনের নয়, গ্রহণের। কৌশলগত অবস্থান থেকেই গৈরিক রাজনীতির মতো তিনি কোনও একটি ধর্মীয় পরিচিতিকে ‘একমাত্র’ হিসাবে বিবেচনা করতে নারাজ; আবার, বামপন্থীদের মতো শ্রেণি ছাড়া অন্য সব বিভাজনকে দেখতে অস্বীকার করতেও নারাজ। এখানেই তাঁর রাজনীতির ‘ঐতিহাসিক সম্ভাবনা’— ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে একটি গ্রহণমূলক পরিচিতির রাজনীতি গড়ে তোলার সম্ভাবনা দেখা যেতে পারে।

প্রশ্ন হল, সেটা কি আদৌ সম্ভব? বাংলা ভাষা যে আদৌ ‘কাজের ভাষা’ নয়, অর্থাৎ এ ভাষা শিখে রোজগারের বিশেষ সুবিধা হবে না, তা এত দিনে সন্দেহাতীত রকম স্পষ্ট। রাজ্যের অর্থনীতির সে সামর্থ্যও নেই, যা নিয়ে অহঙ্কার বা ভরসা করা যায়। পাশাপাশি, বাঙালি জাতিসত্তার রাজনীতি বারে বারেই ধাক্কা খেয়েছে ধর্মীয় পরিচিতির অমোঘ দেওয়ালে। হিন্দু এবং মুসলমান, উভয় দিক থেকেই। এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গত এক দশকে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে ধর্মীয় বিভাজিকা অনুসারে আড়াআড়ি ভেঙে ফেলতে বহুলাংশে সক্ষম হয়েছে। বাঙালি হিন্দুর কাছে বাঙালি পরিচিতির তুলনায় হিন্দু পরিচিতি আগে যতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এখন তার চেয়েও বেশি হয়ে উঠেছে কি না, সে প্রশ্নটি থাকছে। এই কথাগুলো গৈরিক রাজনীতির কারবারিরাও বিলক্ষণ জানেন— ফলে, হিন্দু বাঙালি আর মুসলমান বাঙালি যে কোনও মতেই এক নয়, এমন একটি কথা খুব জোরের সঙ্গে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়ার সচেতন চেষ্টা আরম্ভ হয়েছে।

কিন্তু, এখানেই আবার তৈরি হয়েছে একটি অন্য সম্ভাবনা। হিন্দুত্ববাদের বাড়বাড়ন্তে মুসলমানরা এমনিতেই কোণঠাসা। সওয়াশো বছরের ইতিহাসের চেয়ে বর্তমান মুহূর্তটি একটি বিশেষ কারণে আলাদা— দেশভাগের মুহূর্ত ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান জনগোষ্ঠীর কাছে ধর্মীয় পরিচিতির বদলে বাঙালি পরিচিতিকে আঁকড়ে ধরার কারণ এবং প্রয়োজন আর কখনও এতখানি তীব্র হয়নি। অন্য দিকে, এখন বিভিন্ন রাজ্যে বাঙালি বিদ্বেষের আঁচ লাগছে হিন্দুদের গায়েও। উচ্চবর্ণের, উচ্চ অথবা মধ্যবিত্ত বাঙালি নয়, নিম্নবর্ণের দরিদ্র বাঙালির গায়ে— পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে যাঁরা ভিন রাজ্যে কাজ করতে যান। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি একটি অসম্ভবকে প্রায় সম্ভব করতে পেরেছিল— যে জনগোষ্ঠীকে মনুবাদ চিরকাল পদতলে রাখার নিদান দিয়ে এসেছে, তাদেরও বিশ্বাস করাতে পেরেছিল যে, তারা বর্ণবাদী হিন্দুত্বের সমান শরিক। গরিব পরিযায়ী নিম্নবর্গের বাঙালিদের মধ্যে চোখের দেখাতেই হিন্দু ও মুসলমান ভাগ করতে না-পেরে হিন্দুত্ববাদীরা সেই বিশ্বাসের গায়ে খানিক হলেও আঁচড় দিয়ে ফেলেছেন।

প্রশ্ন হল, মমতা কি সুযোগ কাজে লাগাতে পারবেন? এ পথে সবচেয়ে বড় বাধা হল বর্ণহিন্দু জনগোষ্ঠী। ঐতিহাসিক কারণে ‘বাঙালি সংস্কৃতি’র মালিকানাটি সেই জনগোষ্ঠীর হাতে। এবং, প্রায় নিশ্চিত ভাবে অনুমান করা চলে, বৃহত্তর বাঙালি জাতিসত্তা নির্মাণের বিরুদ্ধেও তাদের অস্ত্র হবে সেই সাংস্কৃতিক কৌলীন্যমণ্ডিত বাঙালিত্বই— যেখানে ‘প্রকৃত বাঙালি’ হওয়ার পূর্বশর্ত সত্যজিৎ-ঋত্বিকের সিনেমা দেখা, লিটল ম্যাগাজ়িনচর্চা, এবং সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ। হাতেগোনা ‘এলিট’ বাদে বাঙালিত্ব থেকে বাকিদের বর্জনের মাপকাঠি হিসাবে এই সাংস্কৃতিক এককগুলির— বিশেষত রবীন্দ্রনাথের— ব্যবহারের মধ্যে যে আশ্চর্য পরিহাস রয়েছে, আপাতত সে কথায় ঢোকার দরকার নেই। প্রশ্ন হল, এই দখলদার ‘এলিটতন্ত্র’-কে অতিক্রম করার অস্ত্র মমতার তূণে আছে কি?

বঙ্গ রাজনীতি, আরও এক বার, আক্ষরিক অর্থেই এসে দাঁড়িয়েছে একটি ঐতিহাসিক মোড়ে। উভয়ার্থেই ঐতিহাসিক— এক দিকে রয়েছে সওয়াশো বছরের ইতিহাস; আর অন্য দিকে, প্রাদেশিক এবং সর্বভারতীয় রাজনীতিতে একটি নতুন ভাষ্য তৈরি করার ঐতিহাসিক সুযোগ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Communism Politics

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy