আলোর মিছিল। আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে মিছিল। নদীয়ার কৃষ্ণনগরে। ছবি: প্রণব দেবনাথ।
এ তো বড় আশ্চয্যি!/ বিলেতফেরত টানছে হুঁকো, সিগ্রেট টানছে ভশ্চায্যি!” আর জি কর কাণ্ডের সূত্রে ধারাবাহিক ভাবে ঘটে চলা নানা উলটপুরাণ দেখে পুরনো প্রবচনটি মনে পড়ে গেল। গত কয়েক দশকের সমাজচিত্রের প্রেক্ষিতে রাজ্যবাসীর ধারণা হয়েছিল, এখানে প্রচুর তৃণমূল, বিজেপি, সিপিএম বা কংগ্রেস সমর্থক থাকলেও বুঝি ‘মানুষ’ থাকতে পারেন না। কারণ তাঁরা অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছিলেন, এ সবের বাইরে স্রেফ ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে চাইলে অনেক মূল্য দিতে হয়। একটি ধর্ষণ ও মৃত্যুর অভিঘাতে প্রমাণ হল, সযত্নে আরোপিত রাজনীতির রংচঙে খোলসের আড়ালেও আদতে প্রচুর ‘মানুষ’ ছিলেন, যাঁরা ভয়ে বা অনিশ্চয়তায় খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার সাহস পাচ্ছিলেন না। এখন সব ভীতি প্রলোভনের ঊর্ধ্বে উঠে তাঁরাই রাত জেগে পথ দখল করছেন, মিছিল করছেন, দীর্ঘ মানবশৃঙ্খল গড়ছেন, রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাঁটতে হাঁটতে আওয়াজ তুলছেন, এমন ঘটনায় যুক্ত ও অভিযুক্তদের দ্রুত চিহ্নিতকরণ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। তাঁদের একটাই স্বর, “উই ওয়ান্ট জাস্টিস!”
কিন্তু এর চেয়েও অবাক করা ঘটনা, দিনের পর দিন যে গণ-আন্দোলন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে, সেগুলি এতই স্বতঃস্ফূর্ত যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর অপেক্ষা রাখছে না। প্রাথমিক ভাবে চিকিৎসকরা জোটবদ্ধ প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু করলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার পরিসর ও প্রতিবাদী-সংখ্যা বেড়ে চলেছে। সাধারণ নাগরিকরা তো আছেনই, একই সঙ্গে নার্সিং স্টাফ, অভিনেতা, কবি, সঙ্গীতশিল্পী, আইনজীবী, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, যৌনকর্মী, বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষ, গিগ-কর্মীদের দেখা গেছে প্রতিবাদে শামিল হতে! দিন যত এগোচ্ছে, আন্দোলনের তেজ ততই বাড়ছে। শহরকেন্দ্রিক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে রাজ্যের প্রান্তিক এলাকাতেও।
লক্ষণীয়, রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় প্রতি দিন যে আন্দোলনগুলি সংগঠিত হচ্ছে, তার বেশির ভাগই আহ্বান করছেন বা নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন মানুষেরা, যাঁদের কথা অতীতে সে ভাবে শোনা যায়নি। এমনকি তাঁদের অধিকাংশেরই প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণের পূর্ব-ইতিহাস নেই। গত ১৪ অগস্ট মাঝরাতে ‘মেয়েরা রাত দখল করো’ নামের যে কর্মসূচির সাফল্য সবাইকে চমকে দিয়েছে, তা সংগঠিত করার নেপথ্যে তথাকথিত কোনও প্রতিষ্ঠিত নেতা বা নেত্রী ছিলেন না। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈকা ছাত্রী-সহ কয়েক জন সমমনস্কের ডাকে এ রাজ্যে তো বটেই, ভারতের নানা রাজ্যে, পৃথিবীর নানা দেশে বয়স ও লিঙ্গনির্বিশেষে যে অগণিত মানুষ রাত ও রাজপথের দখল নিতে নেমে পড়েছিলেন, তার তুল্য স্বতঃস্ফূর্ততা এই সময় শেষ কবে দেখেছে বলা শক্ত। তার চেয়েও বড় কথা, এই গণ-আন্দোলন যে উৎসাহ ও প্রেরণার জন্ম দিয়েছে তার সুদূরপ্রসারী অভিঘাত।
এ-হেন অরাজনৈতিক আন্দোলনে কোথাও কোথাও রাজনৈতিক লোকজন কুলচিহ্নবাহী পতাকা ছাড়া ঢুকে পড়ছেন। এ-ও এক বিস্ময়— এক দিকে যেমন তাঁরা নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় দানে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না, অন্য দিকে যোগদানকারীদের বেশির ভাগই সচেতন ভাবে রাজনীতির ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলতে চাইছেন। আবার উল্টো দিকে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও এই গণ-আন্দোলনে নিজেদের ভূমিকা গোপন করার মরিয়া তাগিদ লক্ষ করা যাচ্ছে।
গত ১৮ অগস্ট যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ডার্বি ম্যাচটি নিরাপত্তাজনিত সমস্যা দেখিয়ে প্রশাসনের বাতিল করার প্রতিবাদে, এবং আর জি করের ঘটনার সুবিচারের দাবিতে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান ও মহমেডানের সমর্থকরা একযোগে যে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন, তাতে উত্থিত স্লোগানগুলিতে রাজনৈতিক বার্তা প্রকট হয়ে উঠছিল বটে, তবে বিপুল জনজোয়ারে মথিত এই আবেগ-বিস্ফোরণ এবং পুলিশি সক্রিয়তার বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ প্রতিরোধ সারা দেশের নজর কাড়লেও কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেই এর সাফল্যের কৃতিত্ব দাবি করা হয়নি। বরং সব বিরোধী রাজনৈতিক দলই এই কর্মসূচিতে নিজেদের অন্বয় অস্বীকার করেছে।
এর পর ২৭ অগস্টে ‘ছাত্র সমাজ’-এর পক্ষ থেকে নবান্ন অভিযানের ডাক দেওয়া হয়। অভিযানে শামিল আন্দোলনকারীদের বিজেপির পক্ষ থেকে সব রকম আইনি সহযোগিতা ও দরকারে চিকিৎসার আশ্বাস দেওয়া হলেও, দলের পক্ষ থেকে একে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক প্রতিপন্ন করার আপ্রাণ চেষ্টা দেখা গেছে। দু’-এক জন ছাড়া প্রথম সারির কোনও দলীয় নেতা বা মুখপাত্রকে এই অভিযানে দেখা যায়নি। আর এখান থেকেই যে অমোঘ জিজ্ঞাসার উদয় হচ্ছে তা হল, নেতৃত্ববৃন্দ-সহ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের বিতৃষ্ণা ও অবিশ্বাস কি নেতা-নেত্রীরা টের পেতে শুরু করেছেন বলেই এই সতর্কতা? নবজাগ্রত মানুষ কি দলীয় রাজনীতির পঙ্কিল আবর্তে নিমজ্জিত নেতা-নেত্রীদের প্রত্যাখ্যানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন? ২৮ অগস্ট বিজেপির ডাকা বাংলা বন্ধে আশানুরূপ জনসমর্থনের অভাব কি এই ধারণাকেই দৃঢ় করছে না?
বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, “হায় লাঠি! তোমার দিন গিয়াছে!” আগামী দিনে ‘লাঠি’ শব্দটির জায়গায় ‘রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী’ বসিয়ে কি নতুন কোনও আখ্যান রচিত হতে চলেছে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy