Advertisement
E-Paper

একই যুদ্ধ তেহরানে, কাবুলে

উড়ছে মুক্তির পতাকা। হিজাব ছিঁড়ে ফেলে তেহরানের নারীদের এ যেন এক আমরণ বিপ্লবের ডাক। চৌরাস্তায় আগুন জ্বলছে, জ্বলছে রাজপথ।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:২৮
সহযোদ্ধা: ইরানের তরুণী মাহশা আমিনির হত্যার প্রতিবাদে নিজের চুল কেটে ফেলছেন তুরস্কে বসবাসকারী এক ইরানি মহিলা। ২১ সেপ্টেম্বর। রয়টার্স

সহযোদ্ধা: ইরানের তরুণী মাহশা আমিনির হত্যার প্রতিবাদে নিজের চুল কেটে ফেলছেন তুরস্কে বসবাসকারী এক ইরানি মহিলা। ২১ সেপ্টেম্বর। রয়টার্স

চুল তার কবেকার অন্ধকারে জয়ের নিশান হয়ে অপেক্ষা করছিল এত কাল! মুক্তির আকাঙ্ক্ষা হয়ে ছিল সীমাহীন মৌলবাদের নরকে। দেবীপক্ষে আজ আন্তর্জাতিক আকাশে পতপত করে উড়ছে দর্পিত কেশদাম। উড়ছে মুক্তির পতাকা। হিজাব ছিঁড়ে ফেলে তেহরানের নারীদের এ যেন এক আমরণ বিপ্লবের ডাক। চৌরাস্তায় আগুন জ্বলছে, জ্বলছে রাজপথ। রাষ্ট্রযন্ত্র এই আগুন স্তিমিত করতেই পারে আরও পেট্রল ঢেলে দিয়ে! কিন্তু ছাইয়ের তলায় আগামী দিনেও সেই আগুন ধিকিধিকি জ্বলবে, তা এখন স্পষ্ট।

এই আগুনের আলো পড়ছে দূরেও। তেহরান থেকে দু’হাজার কিলোমিটার দূরে একটি (আসলে অসংখ্য) ম্লান মুখের উপর। রাষ্ট্রপুঞ্জ তার নিউজ়লেটারে এক আফগান কিশোরীর মুখচ্ছবি দিয়ে তার মনের কথা বিবৃত করেছে সম্প্রতি। না, সে মেয়ে ইরানের মাহশা আমিনির মতো মৃত্যুকে বরণ করতে বাধ্য হয়নি এখনও। সে বেঁচে আছে, লড়াইও জারি আছে।

মেয়ের নাম মুরসল ফাসিহি। ১৭ বছরের এই আফগানি মেয়েটি এই ধাক্কা এখনও সামলাতে পারেনি যে, সে আর ফিরতে পারবে না তার প্রিয় ক্লাসঘরে। ওই ক্লাসের ছাদ ফুঁড়ে সে মুক্তির আকাশ দেখেছিল এক দিন। “কেন আমরা মাহ্‌রাম (পুরুষ সঙ্গী) ছাড়া বেরোতে পারব না? কেন সর্বদা মুখ ঢাকতে হবে? কেন যেতে পারব না স্কুলে?” একের পর এক প্রশ্ন তার। ২০২১-এর জুলাইয়ে তার স্কুল-ফাইনাল ছিল। এক মাসের মধ্যেই দেশ উলটপালট করে দেয় তালিবান। কাবুলের পতন হয় ১৫ অগস্ট। তার অনেক বন্ধু পালিয়ে গিয়ে বাইরে লেখাপড়া করছে। “ওদের কথা খুব মনে পড়ে, টিচারদের কথা, আর স্কুল। আর কি কখনও যেতে পারব না?”

এই প্রশ্নগুলিকে সামনে রেখে লড়াই করেছে তার মতো আফগানিস্তানের অসংখ্য মেয়ে, তালিবানের এ কে-ফর্টি সেভেনের মুখে দাঁড়িয়ে। এ বড় চাট্টিখানি কথা নয়। ফাসিহির ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন আপাতত গভীর অন্ধকারে। কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে নেই সেই মেয়ে। রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি স্বাস্থ্য সংস্থা ‘ইয়ুথ পিয়ার এডুকেশন নেটওয়ার্ক’ (ওয়াই-পিয়ার)-এ যোগ দিয়েছে সে। বর্তমান সঙ্কট মোকাবিলায় তরুণদের দক্ষতা বাড়াতে এই উদ্যোগ। সেখানে আরও জনা পঁচিশেকের সঙ্গে প্রশিক্ষণ কর্মশালায় যোগ দিয়েছে ফাসিহি।

শিয়া মৌলবাদই হোক (ইরান) বা সুন্নি মৌলবাদ (আফগানিস্তান)— নিপীড়ন এবং দমনের ব্যাকরণে উনিশ-বিশের ফারাক। তার থেকেও বড় কথা, আজ যে ভাবে নারীশক্তি রাস্তায় নেমে তাদের মৌলিক অধিকারটুকু ছিনিয়ে নিতে লড়ছে ইরানের শাসক অথবা আফগানিস্তানের তালিবানের সঙ্গে, বহু কার্যকারণে তেমনটা সম্ভব ছিল না আগে।

পূর্বতন তালিবান জমানায় রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ দূরস্থান, আফগানিস্তানে বিনা আতঙ্কে ঘর থেকে পা বাইরে রাখতে পারতেন না কোনও একাকী নারী। ইরানের প্রখ্যাত লেখিকা আজ়ার নাফিসিকে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮১ সালে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তিনি হিজাব পরতে অস্বীকার করায়। সাত অল্পবয়সি ইরানি তরুণীকে প্রতি বৃহস্পতিবার তিনি নিজের বাড়িতে গোপনে পড়াতেন পশ্চিমি সাহিত্য। পরবর্তী কালে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন নাফিসি, চলে যান আমেরিকা। তাঁর রিডিং লোলিটা ইন তেহরান পড়লেই বোঝা যাবে সে সময়ের দমন পীড়নের মাত্রা।

সেই আজ়ার নাফিসির তেহরানে আজ নারীরা গর্জন করছেন। মুঠিভরে নিজেদের কেশদাম কেটে, হিজাব পুড়িয়ে তার ছাই উড়িয়ে দিয়ে জানাচ্ছেন প্রতিবাদ। মুহূর্তে সে ছবি ভাইরাল। দু’সপ্তাহ হতে চলল বিক্ষোভের লেলিহান শিখা জ্বলছে তেহরান-সহ বিভিন্ন এলাকায়। সরকারের হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করেই রাস্তায় নেমেছেন বিক্ষোভকারীরা। কার্যত পেট্রল ঢেলে সেই আগুন নেবানোর চেষ্টা করছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। হুমকি দিচ্ছেন বরদাস্ত না করার। তাতেও কাজ হচ্ছে না। ইরানের মানবাধিকার সংগঠনের দাবি, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

তবুও ঝড় উঠছে, কারা টুটছে, প্রাণ জাগছে, জাগছে, জাগছে। আর সেই পরানসম্বল করে খোদ কাবুলে স্কুল খোলার দাবিতে পোস্টার হাতে নিয়ে সিটি স্কোয়ারে মিছিল করে এসে স্লোগান দিয়েছেন মেয়েরা। তাঁদের প্ল্যাকার্ডে উজ্জ্বল—‘শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকার।’ আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বে বাদাকশান প্রদেশে একশো মেয়ে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন মেশিন গানের সামনে। শিক্ষার দাবিতে, বন্ধ স্কুল খোলার নির্ঘোষে। ছিয়ানব্বইয়ের সেই দর্পিত আদ্যন্ত বর্বর তালিবানকে কিন্তু ২০২২-এ এসে একশোরও বেশি মহিলা পুলিশ ডাকতে হয়েছে আন্দোলন সামলাতে। তাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলেছেন মেয়েরা সমস্বরে। তাঁরা হয়তো ফিরে গিয়েছেন এ বারের মতো। তাঁদের বাড়িতে গিয়ে গিয়ে বাদাকশানের এই মহিলা লেফটেন্যান্টরা অপরাধী খোঁজার নামে অত্যাচারও চালিয়েছেন। কিন্তু এ বার এখনও পর্যন্ত তালিবান সরকার বলতে বাধ্য হচ্ছে, তারা মহিলা শিক্ষার সুবন্দোবস্ত করবে।

বিষয়টি এমন নয় যে, পূর্বতন তালিবান জমানার থেকে উগ্র মৌলবাদের উগ্রতায় এবং পুরুষতান্ত্রিকতায় বর্তমান তালিবান জমানা কিছু কম। কিন্তু এটা ঘটনা, এ বারে সেই বোধ তৈরি হয়েছে যে, অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, বহির্বিশ্ব থেকে অনুদান আসার রাস্তা তৈরি না করতে পারলে বেঘোরে মরবে তালিবান, এবং সেই সঙ্গে দেনায় অভাবে জর্জরিত দেশও। তালিবানের প্রয়োজন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, ও বিপুল আর্থিক অনুদান। মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে বার বার প্রশ্ন উঠলে, যা পাওয়া কার্যত অসম্ভব। পশ্চিমের দেশগুলি সন্ত্রাসদমন, মানবাধিকার রক্ষা নিয়ে তালিবানদের উপর চাপ ক্রমাগত বাড়িয়েও চলেছে। কারণ সেনা সরিয়ে নেওয়ার পর আমেরিকাও বুঝেছে যে, তালিবানের নিয়ন্ত্রণে থাকা আফগানিস্তানকে সন্ত্রাসের মুক্তাঞ্চল করে দিলে আশেপাশের দেশগুলির নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হবে। গোটা অঞ্চলে তৈরি হবে সেই বিষচক্র, আবার বাড়বে পাকিস্তান-নির্ভরতা (ইতিমধ্যেই ভারত প্রশ্ন তুলেছে পাকিস্তানকে আমেরিকার এফ ১৬ বিক্রি করা নিয়ে)। চিন-পাকিস্তান-রাশিয়া অক্ষের বিরুদ্ধে যে কোয়াড-এর তোড়জোড় করছে ওয়াশিংটন, তার ভরকেন্দ্র দুর্বল হবে। তালিবানের প্রথম জমানা ছিল বহুলাংশে প্রচারের আওতার বাইরে। আজ আন্তর্জালের কল্যাণে প্রতিটি বুলেটের হিসাব চাইছে বিশ্বজোড়া মানবাধিকার সংগঠনগুলি। তাতে অনেকটাই চাপ বাড়ছে কাবুলে।

অতিমারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর আমূল বদলে গিয়েছে ভূ-অর্থনীতি এবং ভূকৌশলগত বিশ্বব্যবস্থা। এমনিতেই পশ্চিমের অভিযোগ, লেবাননে হিজবুল্লা, গাজায় হামাস এবং ইরাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের পিছনে ইরানের প্রত্যক্ষ মদত রয়েছে। এ ছাড়াও ইরান ‘পরমাণু শক্তিধর দেশ’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করায় আমেরিকা, ব্রিটেন-সহ উন্নত দেশগুলি ইরানের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে নানা ভাবে। ২০১৮ সালে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি থেকে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফা সরে এসে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আবারও কঠিন করেন। চুক্তিটি পুনরুদ্ধারের জন্য ২০২১ সালের এপ্রিলে ভিয়েনায় যে আলোচনা শুরু হয়েছিল, তা তেহরান এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে গত মার্চ থেকে স্থগিত রয়েছে। উভয় পক্ষই পরোক্ষ ভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমন্বয়কারীর মাধ্যমে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এত দিনে ইরানের নাভিশ্বাস উঠে যাওয়ার কথা।

মৌলবাদের চোখে চোখ রেখে পাল্টা দেওয়ার যে এটাই সময় তা আফগান এবং ইরানি নারীরা বুঝেছেন। তা ছাড়া তাঁদের ধৈর্যের বাঁধও এত দিনে ভেঙে যাওয়ারই কথা। এই আন্দোলনগুলি কত দিনে আংশিক ভাবে হলেও জয়যুক্ত হয়, তার জন্য গোটা বিশ্বের শুভশক্তি সাগ্রহে অপেক্ষা করছে।

Protest Women Iran Iran Hijab Row Afghanistan taliban
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy