অবশেষে সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আগামী জনশুমারির গেজ়েট বিজ্ঞপ্তি জারি হল। জনশুমারি কেন গুরুত্বপূর্ণ, এই বিপুল তথ্যভান্ডার থেকে আমরা কী কী জানতে পারি— এই প্রশ্নগুলো নিয়ে গত কয়েক বছরে অনেক কথা হয়েছে, তা এই লেখায় এই প্রসঙ্গগুলিতে ঢুকব না। অন্য কয়েকটি প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা যাক। এই প্রথম ভারত সরকার জনশুমারিতে ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার করবে। একই সঙ্গে, এই প্রথম বার সরকার ‘স্ব-গণনার’ও অনুমতি দিয়েছে, যার ফলে নাগরিকরা গণনাকারীর পরিদর্শন ছাড়াই জনশুমারির তথ্য পূরণ করতে পারবেন। অনেক উন্নত দেশ জনশুমারিতে স্ব-গণনা পদ্ধতি ব্যবহার করে। এক দিকে ভারত এখন বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণের পদ্ধতিতে বেশ অগ্রগতি করেছে, মোবাইল ফোনের ব্যবহারও ব্যাপক; অন্য দিকে, যাত্রী বা অভিবাসীদের মতো চলমান জনগোষ্ঠীর সাক্ষাৎকার নেওয়ার অসুবিধা, সাবেক পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহের ব্যয়বহুলতার কারণে, সরকারের পক্ষে এই ধারণাটি পরীক্ষা করা যুক্তিসঙ্গত।
কার্যকর সহজতার বাইরেও, স্ব-গণনার মাধ্যমে তুলনায় উচ্চ মানের তথ্য সংগ্রহ সহজতর হতে পারে। ভারতের সমাজব্যবস্থায় জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল। ধরুন, মহারাষ্ট্রে যদি বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য কোনও পরিযায়ী শ্রমিককে গ্রেফতার করে সোজা বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে কি সেখানে এক জন বাংলাভাষী উত্তরদাতা এক জন মরাঠাভাষী গণনাকারীকে জনশুমারিতে ভাষাগত প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে সাহস করবেন? অথবা, ধর্মীয় ভাবে বিদ্বিষ্ট রাজ্য অথবা অঞ্চলে কোনও সংখ্যালঘু ব্যক্তি হিন্দু গণনাকারীর কাছে নিজের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে ভয় পেতে পারেন। ক্ষেত্রবিশেষে গণনাকারীও উত্তরদাতাকে ভুল তথ্য দেওয়ার জন্য ভয় দেখাতে পারেন। নীতিগত ভাবে, স্ব-গণনায় যদি প্রদেয় তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার নিয়ম যথেষ্ট শক্তিশালী হয়, তা হলে উত্তরদাতারা আরও সততার সঙ্গে তাঁদের তথ্য দিতে পারেন, যার ফলে তথ্যের গুণমান বাড়বে। এই ভাবে, স্ব-গণনা ‘গণনাকারী পক্ষপাত’ কমাতে সাহায্য করতে পারে।
কিন্তু, স্ব-গণনার মাধ্যমে তথ্যের মান নিয়ে উদ্বেগও থাকতে পারে— তথ্য পূরণের ত্রুটির সম্ভাবনা থেকে শুরু করে উদ্দেশ্যমূলক ভুল তথ্য প্রদান পর্যন্ত। জনশুমারির তথ্য জটিল। বিভিন্ন সংজ্ঞা (যেমন, পরিবারের সংজ্ঞা) কী ভাবে কোড করতে হয়, সে সম্পর্কে গণনাকারীদের সুস্পষ্ট নির্দেশিকা দেওয়া হয়। এই নির্দেশিকাগুলি কী ভাবে নাগরিকদের কাছে পৌঁছবে? যদি বা পৌঁছয়, তাঁরা কি সেগুলি সঠিক পদ্ধতিতে প্রয়োগ করতে সক্ষম হবেন? স্ব-গণনায় ইচ্ছুক প্রত্যেক ব্যক্তির কার্যকর সাক্ষরতা থাকবে, তার নিশ্চয়তা নেই। সে ক্ষেত্রে কি তথ্যাবলি পূরণের জন্য ‘এজেন্ট’ নির্ভরতা বাড়বে?
স্ব-গণনার তথ্যের গুণমান যাচাই করার আর একটি পদ্ধতি হল, যাঁরা স্ব-গণনার মাধ্যমে তথ্য দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে যদৃচ্ছ ভাবে অন্তত ৫ শতাংশ নমুনার উপর গণনা-পরবর্তী নমুনা সমীক্ষা করা। স্ব-গণনার তথ্যের গুণমান যাচাই করাটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ভবিষ্যতে তথ্য সংগ্রহের এটাই একমাত্র অবলম্বন হতে চলেছে।
দ্বিতীয়ত, এই জনশুমারি ২০২৬-এর পরিবর্তে ২০২৭-এ করা হচ্ছে সম্ভবত একটাই কারণে যে, ২০২৬-এর পর জনগণনা অনুযায়ী বিধানসভা ও লোকসভার সীমানা নির্ধারণ এবং আসনসংখ্যার পুনর্বিন্যাস করা হবে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসনসংখ্যার পুনর্বিন্যাস ৮৪তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ২০০০ সালের পরিবর্তে ২০২৬ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছিল। তাই যদিও ২০০১ সালের জনশুমারির ভিত্তিতে সংসদীয় আসন সংখ্যা পরিবর্তন না করে আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছিল তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের জন্য, কিন্তু সংসদীয় আসন সংখ্যার পুনর্বিন্যাস করা হবে ২০২৬-পরবর্তী জনশুমারির ভিত্তিতে। নিয়মমাফিক এই পুনর্বিন্যাস হওয়া উচিত ছিল ২০৩১ জনশুমারির ভিত্তিতে। কিন্তু যে-হেতু ২০২১ সালের জনশুমারি হয়নি, তাই আসন পুনর্বিন্যাসও এই জনশুমারির পরিপ্রেক্ষিতেই হবে।
বহু দশক ধরেই রাজ্যগুলির মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন, দক্ষিণের রাজ্যগুলির মধ্যে কেরল ও তামিলনাড়ুতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমার প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে, কর্নাটকে ১৯৮১-পরবর্তী সময়ে এবং অন্ধ্রপ্রদেশে ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে। অর্থাৎ, দক্ষিণের রাজ্যগুলির মধ্যেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হ্রাসের হারের মধ্যে তারতম্য আছে। অন্য দিকে, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, অসম ও মহারাষ্ট্রে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হ্রাস পাওয়া শুরু করে ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে; আর পঞ্জাবে ১৯৮১-পরবর্তী সময়ে। অন্য দিকে, হিন্দিবলয়ের রাজ্যগুলি যেমন উত্তরপ্রদেশ (উত্তরাখণ্ড-সহ), বিহার (ঝাড়খণ্ড-সহ), মধ্যপ্রদেশ (ছত্তীসগঢ়-সহ), হরিয়ানা এবং রাজস্থানে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার কমতে থাকে ২০০১-পরবর্তী সময়ে। পশ্চিম ভারতের গুজরাতেও জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার একমুখী ভাবে কমতে থাকে ২০০১-পরবর্তী সময়ে। এই রাজ্যওয়ারি তারতম্যের কারণেই উত্তর ভারতের মোট জনসংখ্যা এবং দেশের জনসংখ্যায় তাদের অনুপাত দক্ষিণ, পূর্ব বা খানিকটা পশ্চিম ভারতের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে।
২০২১-২০৩১ সাল পর্যন্ত অভিক্ষেপ অনুযায়ী, দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার কমে গড়ে দশকে ৩-৪ শতাংশ হয়ে যাবে, সেখানে উত্তরের রাজ্যগুলিতে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার দশকে ১১-১২ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করবে। যেমন, ২০৩১ সালের অভিক্ষিপ্ত জনসংখ্যা অনুসারে, বিহার ও উত্তরপ্রদেশের মোট জনসংখ্যা হবে আনুমানিক ৩৫.৪ কোটি, আর সেখানে দক্ষিণের সব রাজ্যের সম্মিলিত জনসংখ্যা হবে আনুমানিক ২৬.৯ কোটি। জনশুমারিতেও এই অভিক্ষেপের প্রতিফলনই দেখতে পাওয়া যাবে। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রেখে লোকসভায় আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে দক্ষিণের রাজ্যগুলির প্রতিনিধিত্ব যাতে বিঘ্নিত না হয়, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ বিষয়টি ভারতের গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর।
তৃতীয়ত, স্বাধীন ভারতে এই প্রথম বার জাতিগণনা হবে। ভারতে জাতিসত্তার প্রশ্নটি অবশ্যই রাজনৈতিক। ১৯৩১ সালের জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী, তৎকালীন অবিভক্ত ভারতে ৪১৪৭টি জাতি ও উপবর্ণ (সাব কাস্ট) ছিল। ২০১১ সালের সোশিয়ো-ইকনমিক অ্যান্ড কাস্ট সেনসাস অনুযায়ী ভারতে ৩০০০-এর বেশি জাতি ও ২৫,০০০-এর বেশি উপবর্ণ আছে। সংবাদে প্রকাশ, জাতির নাম নাকি গণনাকারীর ট্যাবলেটের ‘ড্রপ ডাউন মেনু’-তে থাকবে, এবং উত্তরদাতা নিজের জাতি যেমন রিপোর্ট করবেন, গণনাকারী সেই মতো জাতির নাম খুঁজে সেটা এন্ট্রি করবেন। কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক জাতি ও উপবর্ণের মধ্যে একটি জাতি বা উপবর্ণ খুঁজে বার করাটা মোটেও সহজ কাজ নয়, কারণ একই জাতির নাম বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে যারা কায়স্থ, উত্তর ভারতে তারাই আবার চলতি ভাষায় লালা নামে পরিচিত। আবার অনেক জাতি ও উপবর্ণ কেবলমাত্র একটা অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ। তাই, গোটা ভারত জুড়ে একটা মডিউল তৈরি করা হবে, না কি অঞ্চলভিত্তিক ভাগ করা হবে, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। দ্বিতীয়টিই বেশি যুক্তিসঙ্গত। এ ক্ষেত্রে নৃতত্ত্ববিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
এক দিকে জাতিগণনা হলে একুশ শতকে ভারতের জাতিসত্তার উপরে গবেষণার পরিসরটি যেমন উন্মোচিত হবে, তেমন অন্য দিকে সরকারি ক্ষেত্রে ওবিসি সংরক্ষণ বাড়ানোর সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করবে। সর্বশেষ জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য সমীক্ষা, ২০১৯-২১ অনুযায়ী, ভারতের সমীক্ষিত পরিবারগুলির মধ্যে প্রায় ৪৪% ওবিসি। কেরল বাদে দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে ওবিসি ৫৫ শতাংশের বেশি— তামিলনাড়ুতে সবচেয়ে বেশি, ৬৮ শতাংশেরও উপরে। উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে ওবিসির অনুপাত বিহার ও উত্তরপ্রদেশে ৫০ শতাংশের বেশি, এ ছাড়া মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থান, গুজরাত ইত্যাদি রাজ্যে ৪৫-৫০ শতাংশের মধ্যে। সুতরাং, ওবিসি সংরক্ষণ বিষয়টি আগামী দিনে ভারতের রাজনীতিতে গুরুতর বিষয় হতে চলেছে। আর কেবলমাত্র জাতিসত্তার ভিত্তিতে ওবিসি সংরক্ষণ বাড়ালে উচ্চ বর্ণের কাছে সরকারকে শুধু যে প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে তা-ই নয়, ওবিসি ও উচ্চ বর্ণের মধ্যে সামাজিক দ্বন্দ্ব হিংসার রূপও ধারণ করতে পারে।
তাই জনশুমারি শেষ হওয়ার অল্প দিনের মধ্যে তার প্রাথমিক সারাংশ প্রকাশ হলেও, এই সব অস্বস্তিজনক বিষয় সর্বসমক্ষে কখনও আসবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। আর এলেও, সেটা ২০২৯-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে তো নয়ই। এই সব তথ্য প্রকাশ আরও দেরিতে হলে অবাক হব না, কারণ ২০৩১-এ কোনও জনশুমারি হচ্ছে না।
ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)