আগামী ৯ জুলাই দেশের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠন, এবং বেশ কিছু কর্মী সংগঠন সর্বভারতীয় ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। তাদের প্রধান দাবি, কেন্দ্রীয় সরকারের চারটি শ্রম বিধি বাতিল করতে হবে। এই দাবির সমর্থনে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। যেমন, শ্রম বিষয়টি যুগ্ম তালিকায় থাকায় রাজ্যের হাতে শ্রম ক্ষেত্রে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার যেটুকু অধিকার ছিল, তা কেড়ে নেওয়া হয়েছে, যা যৌথ ব্যবস্থাকে লঙ্ঘন করে। দ্বিতীয়ত, শ্রম বিধি তৈরি হয়েছে অসংগঠিত শ্রমিকদের বাদ রেখে, যাঁরা শ্রমিকদের ৯২ শতাংশ। ভারতে রোজগেরে মানুষদের ৪৬ শতাংশ স্বনিযুক্ত কর্মী, ১৫ কোটি কৃষি মজুর, অন্তত পাঁচ কোটি গৃহশ্রমিক। শ্রম বিধিতে এঁদের প্রতি সে ভাবে দৃষ্টিই দেওয়া হয়নি। দোকান, শোরুমে কর্মরত কয়েক কোটি নারী-পুরুষও উপেক্ষিত। তা ছাড়াও কর্মস্থলে শ্রমিক-সুরক্ষার হাল সরেজমিনে দেখতে শ্রম আধিকারিকদের পরিদর্শন, নিয়মিত ত্রিপাক্ষিক আলোচনা, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের গণতান্ত্রিক অধিকার, এ ধরনের নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয় শ্রম বিধিতে আসেনি, অথবা নতুন আইন প্রচলিত ব্যবস্থাকে শিথিল করেছে, শ্রমিকের অধিকারকে লঘু করেছে।
শ্রম বিধিতে এই সব ফাঁকফোকর, এবং আরও অন্যান্য গুরুতর নৈতিক এবং প্রায়োগিক সমস্যা তুলে ধরতে চাইছে ট্রেড ইউনিয়নগুলি। তাদের দাবি, তিনটি কৃষি আইন যেমন বাতিল করেছে কেন্দ্রীয় সরকার, তেমনই শ্রম বিধিও বাতিল করতে হবে। যদিও কটু বাস্তব এই যে, সংগঠনে, প্রচারে বা বিস্তারে কৃষক আন্দোলনের কাছাকাছি যেতে পারেনি শ্রমআন্দোলন। ২০১৯-২০২০ চারটি শ্রম বিধি সংসদে পেশ করা হল। তখন কোভিড পরিস্থিতি ছিল, কিন্তু তার পরেই বা বিরোধী দলগুলির সম্মিলিত আন্দোলন দেখলাম কোথায়?
গত পাঁচ বছরে দেশের একাধিক রাজ্যে এবং কেন্দ্রে লোকসভা বিধানসভা নির্বাচন হল। বেশ কিছু রাজ্যে কেন্দ্রের শাসক-বিরোধী দলের সরকার ক্ষমতায় এল। তা সত্ত্বেও ৩২টি রাজ্যে শ্রম বিধি চালু করার ‘রুলস’ তৈরি হয়ে গিয়েছে। তা নিয়ে শ্রমিকরা তেমন প্রতিবাদও করেননি। তার কারণ আন্দাজ করা কঠিন নয়। দশ জন শ্রমিকের মধ্যে ন’জনেরই দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা কী? তাঁরা সরকার-নির্ধারিত মজুরির চেয়ে অনেক কম টাকায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। কাজের সময়সীমা আট ঘণ্টা ছিল, আজ বারো ঘণ্টাও পার করে ফেলছে। নিরাপত্তার অভাবে চোখের সামনে সহকর্মীর দেহকে মাংসপিণ্ড হয়ে উঠতে দেখছেন। শ্রম বিধি বাতিল হলে কি এ সব থেকে মুক্তি পাবেন? তাই নেতাদের ভাষণ, স্লোগান, তাঁদের স্পর্শ করে না। শ্রমিকরা দেখছেন যে, আচারে, ব্যবহারে তাঁদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন শ্রমিক নেতারা। শ্রমিক সংগঠনগুলির উপর তাঁরা যেন ভরসা হারাচ্ছেন।
রাজ্যের চটকলগুলোতে শ্রমিকের তরফে চুক্তিতে স্বাক্ষর করার এক্তিয়ার এখনও হয়তো আছে। কিন্তু তাঁদের সিদ্ধান্তে শ্রমিকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতিফলন সামান্যই। প্রায়ই দেখা যায়, মিলের শ্রমিকদের হয়ে সিদ্ধান্ত নেন এলাকার বিধায়ক বা রাজনীতিকরা। শ্রমিক সংগঠন পৃথক অবস্থান ধরে রাখতে পারছে না। শ্রমিকদের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে যেন ভুলে গিয়েছেন তাঁরা। আর আজ নেতৃত্ব বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে, সংগঠনগুলি শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে পরস্পর বিচ্ছিন্নতা বাড়িয়েছে। ফলে আন্দোলনের উপর মজুর আস্থা হারিয়েছেন। হয়তো খাতায়-কলমে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য বেড়েছে। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে শ্রমজীবী মানুষের অর্জিত অধিকারের জমি যে ভাবে ক্রমাগত ক্ষয়েছে, তার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়নি। তার কারণ নিয়ে অনেক মূল্যায়ন অনেক মতামত আছে, তবু বাস্তব এই যে মজুরিবঞ্চিত, কর্মচ্যুত, অধিকারহীন মজুরকে রক্ষা করতে পারছে না বড় বড় সংগঠন। নেতার ক্ষমতা এসে দাঁড়িয়েছে চুক্তিতে স্বাক্ষর করার ক্ষমতায়।
শ্রম বিধি বাতিলের দাবিতে সর্বভারতীয় ধর্মঘটের মুখে দাঁড়িয়ে ট্রেড ইউনিয়নগুলির চার ধরনের অবস্থান দেখা যাচ্ছে। এক, যারা কেন্দ্রের শাসক দলের অনুপ্রেরণায় চলে, যেমন ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ, তাদের সঙ্গী আইএনটিইউসি-র একটি ছোট গোষ্ঠী, এবং টিইউসিসি (তিওয়ারি)। এরা মৃদু সমালোচনা করেও আগাগোড়া মোটের উপর শ্রম বিধির সমর্থক, ধর্মঘট বিরোধী। দুই, যে ইউনিয়নগুলি শ্রম বিধি বাতিল করার জন্য সওয়াল করছে— এর মধ্যে রয়েছে আইএনটিইউসি, সিটু-সহ দশটি কেন্দ্রীয় ইউনিয়ন, এবং ব্যাঙ্ক, জীবনবিমা প্রভৃতি সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মীদের ফেডারেশন, এবং কিছু বামপন্থী শ্রমিক মোর্চা।
তিন, বিরোধী রাজ্যগুলিতে শাসক দলের ‘শাখা সংগঠন’-এর মতো কাজ করে যে সব ট্রেড ইউনিয়ন— যেমন পশ্চিমবঙ্গে আইএনটিটিইউসি। এগুলি শ্রম বিধির বিরোধিতা করছে, কিন্তু ধর্মঘটেরও বিরোধিতা করছে। এর নেতারা ট্রেড ইউনিয়নগুলির যৌথতা থেকে প্রায়ই নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখে। বামফ্রন্ট শাসনকালে কানোরিয়া চটকলে শ্রমিক আন্দোলনকে সিটু সমর্থন করেনি। ব্যতিক্রম কিছু বামপন্থী শ্রমিক সংগঠন, যেগুলি জোট, মোর্চায় থাকলেও চেষ্টা করে শ্রমিকদের সংহতির জন্য কাজ করতে। এগুলির নেতা-কর্মীদের ক্ষমতা সীমিত, কিন্তু তাঁরা আন্তরিক, সৎ।
চার, দলীয় সংগঠন থেকে স্বতন্ত্র ট্রেড ইউনিয়ন, যেমন রেল কর্মী, অটোমোবাইল কর্মী, আশা-অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে মিল কর্মী, বস্ত্র কারখানার নারী-শ্রমিক, নির্মাণ কর্মী প্রভৃতির ইউনিয়ন। এগুলি অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের সংগঠিত করার অনলস পরিশ্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এরা ধর্মঘটকে সমর্থন করছে, তবে রাজ্য সরকারগুলির কিছু সমালোচনাও করছে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার দাবি করেছে যে, তারা এই রাজ্যে শ্রম বিধি চালু করবে না। এই আশ্বাসে ভরসা রাখা কঠিন। শ্রম বিধিতে বলা হয়েছে, শ্রম কমিশন থাকবে না, তার বদলে হবে ‘ফেসিলিটেটর’। রাজ্যে তো এখনই এই কমিশন সালিশি ব্যবস্থা কায়েম করেছে। প্রায় আশিটি পেশায় সরকার-ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি নিয়মিত প্রকাশিত হয়, কিন্তু ‘সিডিউল’-ভুক্ত একটি পেশাতেও শ্রমিকরা সেই মজুরি পান না। ২৯ লক্ষ বিড়ি শ্রমিক দৈনিক ন্যূনতম মজুরির চাইতে গড়ে ১০০ টাকা কম পাচ্ছেন। যার অর্থ, বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার মজুরি চুরি হয়। বিড়ি-ক্ষেত্রে অসংখ্য শ্রমিক ফেডারেশন। তবু বৈষম্য দূর হচ্ছে কই? একই চিত্র চটকল, চা বাগান, খেতমজুরিতে।
শাসক দলের নেতারা জেলা সফরে গিয়ে সমবেত জনতাকে প্রায়ই জিজ্ঞাসা করেন, “সব কিছু ঠিক মতো পাচ্ছেন তো?” ঘিরে-থাকা আধিকারিকরা ফিরিস্তি দেন, কত প্রকল্পে কত মানুষ নাম লিখিয়েছেন। অথচ, এই সব কল্যাণ প্রকল্পের সুবিধা পাওয়া সহজ নয়। সরকারি স্কিমে অসংগঠিত শ্রমিকের জমানো টাকা তুলতে গিয়ে প্রায় আধাআধি ঘুষ দিতে হচ্ছে। আসল প্রশ্ন হল, প্রকল্পের উপরে নির্ভর করে দিনগুজরান করতে হবে কেন? গ্রামীণ শ্রমিকরা যাতে নির্ধারিত মজুরি পান, তার জন্য কী ধরনের উদ্যোগ সরকার করছে? ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বই বা কী করছে?
শ্রমজীবী মানুষ যখন আইনি অধিকারের জন্য লড়াই করেন, সেটা কেবল কিছু সুবিধা পাওয়ার লড়াই নয়, তা সামাজিক ন্যায়ের জন্য লড়াই। সবার জন্য ন্যায়— এই স্বপ্ন শ্রমিক আন্দোলনকে পরিণত করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। সেই দৃঢ় সঙ্কল্প, সেই স্বপ্নের থেকে যদি শ্রমিক সংগঠন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন ধর্মঘট কেবল একটা ‘ইভেন্ট’ বা সাংগঠনিক কর্মসূচি হয়ে ওঠে। আজ ধর্মঘট হল, কাল কী হবে? কিছুই হবে না, এমন মনে হলে শাসক নিশ্চিন্ত থাকেন, শ্রমিকও সাড়া দেন না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)