E-Paper

দেখতে নারি, তাই

সন্দীপ নিখিলেশকে বলল, “আমার রাগ আছে, আমি দেশের জন্যে রাগ করব; আমি কাউকে চাই যাকে কাটব-কুটব, যার উপরে আমি আমার এতদিনের অপমানের শোধ তুলব।”

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০২৫ ০৭:৫৪

ভারতীয় ও পশ্চিমবঙ্গীয় নাগরিক সমাজ এই মুহূর্তে প্রতিক্রিয়ার রাজনীতিতে উত্তাল, সমাজমাধ্যমে সেই মনোভঙ্গি বহু ক্ষেত্রেই গালাগালের নধর ফোয়ারা হয়ে দুই পক্ষের সাম্প্রদায়িক আমোদপ্রিয়দের অশুচিতার শুচিস্নান সমাপন করাচ্ছে। কী আনন্দ! কী গর্ব! রাষ্ট্রীয় স্তরে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি তো এক অর্থে প্রতিক্রিয়ারই রাজনীতি— একটি সম্প্রদায়ের সঙ্কীর্ণমনারা যখন অনৈতিক বাহুবল প্রদর্শনে উদ্যোগী হন তখন অপর সম্প্রদায়ও পাল্টা শক্তি প্রদর্শনে তৎপর হয়ে ওঠেন। প্রতিটি ক্রিয়ারই সমান বিপরীত প্রতিক্রিয়া সামাজিক স্তরে থাকা উচিত বলে মেকি বিজ্ঞানপন্থীরা ঘাড় শক্ত করেন। ডারউইনের মতবাদকে ব্যবহার করে নির্মম সামাজিক ডারউইনপন্থা তৈরি হয়েছিল। সেই সামাজিক ডারউইনবাদীরা মনে করতেন, পিতৃভূমিতে যোগ্য নর্ডিক জার্মানরাই থাকবে, দুর্বল মানুষদের যোগ্যতম নয় বলে মেরে ফেলা হবে। এও তেমনই খুনি বিজ্ঞানপন্থা, নিউটনের সূত্রের মূর্খ অপব্যবহার। এই পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অনিঃশেষ চক্র সুকৌশলে দুই সম্প্রদায়ের উদারমনাদেরও ক্রমশই যেন কব্জায় এনে ফেলে। মনে হয়, কোনও এক পক্ষে বা দলে মিশে প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন না করলে বুঝি নিজের অস্তিত্বই সঙ্কটে পড়বে। রাজনৈতিক দলগুলিও এই সুযোগে প্রতিক্রিয়ার রাজনীতি প্রদর্শন করার জন্য নাগরিক সমাজকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে উদ্বুদ্ধ করে। সমাজে মেরুকরণ ঘটে।

প্রতিক্রিয়ার রাজনীতি আধুনিক অর্থে পরিপুষ্টি লাভ করে ইংরেজ উপনিবেশেই প্রথম থাবা বসাতে শুরু করেছিল। তার বিরুদ্ধে সরব সচেতনতা প্রদর্শনে বাঙালিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথই ছিলেন অগ্রগণ্য। এখানে একটা কথা বলা দরকার, কোনও মর্মান্তিক অমানবিক দমনমূলক ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো আর প্রতিক্রিয়ার রাজনীতি কিন্তু সমার্থক নয়। জালিয়ানওয়ালা বাগের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তীব্র ভাষায় চিঠি লিখে তিনি যখন নাইটহুড ত্যাগ করলেন, তখন বিশেষ ঘটনার সাপেক্ষে সেই প্রতিবাদ নিছক প্রতিক্রিয়ার রাজনীতি ছিল না, কারণ রবীন্দ্রনাথ এই সূত্রে সর্বত্র সর্বদা ইংরেজমাত্রকেই রেজিনাল্ড ডায়ারের বংশধর বলে চিহ্নিত করেননি। প্রতিক্রিয়ার রাজনীতি তা-ই করে। এই রাজনৈতিক পন্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল তাৎক্ষণিক যুক্তিতে সাদা-কালো বিভাজন তৈরি করা, কোনও এক পক্ষের ক্রিয়ার সূত্রে অতিদ্রুত প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করা ও সামনে সব সময় চাঁদমারির মতো কোনও এক শত্রুপক্ষকে বাস্তবের সঙ্গে অতিরঞ্জিত কল্পনার মিশেলে খাড়া করে রাখা। সেই প্রতিপক্ষকে বিদ্ধ করতেই সমস্ত বল উত্তেজিত ভঙ্গিতে প্রয়োগ করতে হবে বলে নিদান দেওয়া হয়।

জালিয়ানওয়ালা বাগের ঘটনার আগেই রবীন্দ্র-উপন্যাসে হিন্দুত্ববাদী ‘গোরা’ ও উগ্রজাতীয়তাবাদী সন্দীপ প্রতিক্রিয়ার রাজনীতি প্রদর্শন করেছিল। উগ্র গোরা বিনয়কে বলে, “এক দল লোক সমাজের বাঁধন ছিঁড়ে সব বিষয়ে উলটোরকম করে চলবে আর সমাজের লোক অবিচলিতভাবে তাদের সুবিচার করবে এ স্বভাবের নিয়ম নয়।... ব্রাহ্ম হয়ে বাহাদুরি করবার শখ যাদের আছে অব্রাহ্মরা তাদের সব কাজেই ভুল বুঝে নিন্দে করবে এটুকু দুঃখ তাদের সহ্য করতেই হবে।” এই হল পাল্টা আঘাত প্রদানের জন্য নিছক প্রতিক্রিয়াবাদীর যুক্তি। ব্রাহ্মরা কেন সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর থেকে আলাদা হলেন তা তলিয়ে বিচার না করেই ‘যাকে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’ ভেবে সকল ব্রাহ্মকে বিদ্ধ করা হচ্ছে। এই ‘দেখতে নারি’-র প্রতিক্রিয়া থেকেই কিন্তু হিন্দুরা মুসলমানদের, মুসলমানরা হিন্দুদের, ভারতীয়রা ইংরেজদের নির্বিচারে চাঁদমারি হিসেবে বেছে নিতে পারে। ঘরে-বাইরে উপন্যাসে বিমলা দেশপ্রেমের চাঁদমারি প্রতিক্রিয়ায় বলেছিল, “মিস গিল্‌বিকে ছাড়িয়ে দিতে হবে।” সন্দীপ যখন এল, তখন বিমলার সামনে সে বন্ধু নিখিলেশকে বলল, “আমি মানুষ, আমার লোভ আছে, আমি দেশের জন্যে লোভ করব; আমি কিছু চাই যা আমি কাড়ব-কুড়ব। আমার রাগ আছে, আমি দেশের জন্যে রাগ করব; আমি কাউকে চাই যাকে কাটব-কুটব, যার উপরে আমি আমার এতদিনের অপমানের শোধ তুলব।” সন্দীপ আসার আগে বিমলার মনে দেশের নামে অন্য মানুষকে বাদ দেওয়ার যে আবেগ ভর করছিল, সেই একই আবেগে সন্দীপ জ্বালাময়। এখানে আদতে সে দেশের নামে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চাইছে, সেখানেই রবীন্দ্রনাথের আপত্তি। রবীন্দ্রকল্প চরিত্র নিখিলেশ বিমলাকে বলে, “মিস গিল্‌বিকে কেবলমাত্র ইংরেজ বলে ঝাপসা করে দেখতে আমি পারি নে। এতদিনের পরিচয়েও কি ঐ নামের বেড়াটা ঘুচবে না?” এখন এই মুহূর্তে ভারতীয় উপমহাদেশে নামের বেড়াটাই হয়ে উঠেছে বড়। প্রতিবেশী রাষ্ট্রে নামের বেড়ার সূত্রে যে হিংসার দূরত্ব তৈরি হচ্ছে, সেই হিংসার দূরত্ব ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতের ভিতরে তৈরি হোক এ কখনও বাঞ্ছনীয় নয়। অন্যত্র ধর্মের নামে হানাহানি হচ্ছে বলে আমাকেও ধর্মের নামে হানাহানি করতে হবে এ আত্মঘাতী যুক্তি।

উপন্যাসের পাতা থেকে এ বার ঘটনার বাস্তবে। ১৯২৬ সালে স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে কট্টরপন্থী আবদুল রশিদ হত্যা করেন। শ্রদ্ধানন্দকে হত্যা করার এই নিন্দনীয় ঘটনার নির্দ্বিধ নিন্দা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। লিখেছিলেন, “স্বামী শ্রদ্ধানন্দের মতো অতবড়ো বীরের এমন মৃত্যু যে কতদূর শোকাবহ তার বর্ণনায় প্রয়োজন নেই।” এই মৃত্যুঘটনাকে প্রতিক্রিয়ার রাজনীতির ইন্ধন হিসেবে ব্যবহার করে ‘ধর্মবিদ্রোহী ধর্মান্ধতার কাঁধে চড়ে রক্তকলুষিত বীভৎসতা’ যাতে নগরের পথে পথে ছড়িয়ে না পড়ে, সে বিষয়ে সাবধান করে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর ১৯১৬-র উপন্যাসে নিখিলেশ বাইরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা থামানোর চেষ্টা করে মারাত্মক জখম হয়েছিল। শ্রদ্ধানন্দ যখন নিহত হলেন, সে-সময় দাঙ্গার চেহারা কী হতে পারে তা প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে শ্রদ্ধানন্দের হত্যার মর্মান্তিকতাকে মেনে নিয়েও রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “যদি ভাবি, মুসলমানদের অস্বীকার করে এক পাশে সরিয়ে দিলেই দেশের সকল মঙ্গলপ্রচেষ্টা সফল হবে, তা হলে বড়োই ভুল করব।”

সমাজের মঙ্গলের জন্য প্রতিক্রিয়ার রাজনীতি থেকে বাইরে যেতে হবে, কিন্তু বাইরে যাওয়ার উপায় কী? রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন, প্রতিক্রিয়ার রাজনীতি কোনও একটি ক্রিয়ার সাপেক্ষে গড়ে ওঠে, স্বাধীন ভাবে গঠনমূলক কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের কঠিন পথে চলার প্রয়োজন তার নেই। কোনও প্রতিপক্ষ সামনে না থাকলে এই রাজনীতির কারবারিদের পেটের ভাত মারা যায়। শত্রু ইংরেজ ও শত্রু মুসলমান অথবা শত্রু ইংরেজ ও শত্রু হিন্দু, এ ভাবেই সঙ্কীর্ণ উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কারবারিরা ক্ষেত্রবিশেষে ঔপনিবেশিক পর্বে শত্রুদের দেগে দিতেন। এখন ভারতের ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’-এ হিন্দু-মুসলমান একই রকম ভাবে সহজ ব্যবহারযোগ্য উপাদান হিসেবে থেকে গিয়েছে। ইংরেজের বদলে জায়গা নিয়েছে ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় বা রাজ্যওয়ারি শাসক দল— তাদের কাজের ব্যর্থতার সূত্রের বাইরে গিয়ে বিরোধী দল বা নাগরিক সমাজ কেউই এগিয়ে এসে এমন কোনও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারছেন না যা ক্ষমতাসীনদের অপ্রয়োজনীয় করে তুলে সমাজের মঙ্গল সাধন করবে। “আজিটেশনের মধ্যে একটা ভাব এই লক্ষ হয় যে, আমাদের নিজের কিছুই করিবার নাই, কেবল পশ্চাৎ হইতে মাঝে মাঝে গবর্নমেন্টের কোর্তা ধরিয়া যথাসাধ্য টান দেওয়া আবশ্যক।” (‘নব্যবঙ্গের আন্দোলন’, সমাজ) এই ‘কোর্তা’র টানই এখনও চোখে পড়ে, আর চোখে পড়ে একই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া— এক দল এ দিকে মন্দির বানালে অন্য দল আর এক দিকে মন্দির বানায়, এক দল এক ধর্মকে ভোটের স্বার্থে ব্যবহার করলে অন্য দল আর এক ধর্মকে ভোটের স্বার্থে ব্যবহার করে।

রবীন্দ্রনাথ পরাধীন ভারতবর্ষে শত্রু-নির্মাণের ও শত্রু-নিপাতের জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করে লিখেছিলেন, “দেশহিতৈষীরা কেহ বলেন, দেশের উন্নতির জন্য জিম্‌ন্যাস্টিক করো, কেহ বলেন সভা করো, আন্দোলন করো, ভারতসংগীত গান করো, কেহ বলেন মিথ্যা বলো, মিথ্যা প্রচার করো, কিন্তু কেহ বলিতেছেন না সত্যকথা বলো, ও সত্যানুষ্ঠান করো।” (‘সত্য’, সমাজ) এই সত্যকথা ও সত্যানুষ্ঠানের ভাবনা থেকেই রবীন্দ্রনাথের গঠনমূলক স্বদেশির পরিকল্পনা— পল্লিপুনর্গঠনের বিস্তৃত সুপরিকল্পিত কাজে হাত দেওয়া। এই সাংগঠনিক পরিকল্পনা কোনও কল্পিত বা বাস্তব প্রতিপক্ষের ক্রিয়াকলাপের উপর নির্ভর করে তাৎক্ষণিক উত্তেজনা পোহানোমাত্র ছিল না।

এখনও নাগরিক সমাজের দায়িত্ব এ রকমই হওয়া উচিত। বস্তুত সমাজমাধ্যমে ও অন্যত্র প্রতিক্রিয়ার রাজনীতিতে শব্দবাজির ইন্ধন জোগানোর বাইরে এখনও নাগরিক সমাজের মানুষ যেখানে যেটুকু গঠনমূলক কাজ করছেন তা-ই সামাজিক মঙ্গলের উপায় হয়ে উঠছে, তাই ভরসা জাগাচ্ছে— বিন্দু থেকেই তো সিন্ধু হতে পারে।

বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Rabindranath Tagore Politics

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy