বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের খবর করতে গ্রামে গ্রামে ঘুরছি। জামুই জেলার এক বাজারে কথা হল বছর চল্লিশের এক ব্যক্তির সঙ্গে। জিজ্ঞাসা করলাম, এ বার কাকে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে দেখতে চান? ভদ্রলোক একটুও না ভেবে বললেন, যিনি আছেন, তিনি ঠিকই আছেন। উনিই ফিরুন। বললাম, কিন্তু প্রশান্ত কিশোর তো বলছেন যে, নীতীশবাবুর এখন বয়স হয়ে গিয়েছে, তাঁর আর মুখ্যমন্ত্রী হওয়া উচিত নয়? ভদ্রলোক এ বার পাল্টা প্রশ্ন করলেন। বললেন, “আপনার নিশ্চয়ই গাড়ি আছে?” স্বীকার করলাম, আছে। তখন উনি বললেন, “ধরুন, আপনার গাড়িতে কোনও সমস্যা হচ্ছে, ঠিকঠাক চলছে না গাড়িটা। তখন কী করবেন? সার্ভিসিংয়ে দেবেন তো? যা গোলমাল হচ্ছে, সেগুলো সারিয়ে নেবেন তো? না কি, সেই গাড়িটা ফেলে দিয়ে এমন একটা গাড়ি নেবেন, যেটার সম্বন্ধে আপনার কোনও ধারণাই নেই? যার উপরে ভরসা নেই, তাকে কেমন ভাবে ক্ষমতায় নিয়ে আসব?”
নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হওয়ার পর মনে হচ্ছে, ‘যিনি আছেন, তিনিই ঠিক আছেন’— এই বিশ্বাসের কোনও পাল্টা অবস্থান বিরোধীরা তৈরি করতে পারলেন না বলেই এমন ফল হল। কার্যত টানা কুড়ি বছর শাসনক্ষমতায় রয়েছেন নীতীশ। তার পরও তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ‘অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি’-র হাওয়া তৈরি হল না বিহারে। নীতীশের প্রতি রাজ্যবাসীর ভরসা এখনও প্রবল। কাজেই, গোড়ায় সহজ সত্যটা স্বীকার করে নেওয়া যাক— এই নির্বাচন নীতীশ কুমারের ছিল। ২০২৫-এর বিহার নির্বাচনকে যদি কোনও বড় ব্যানারের বলিউড ছবি বলে ভাবেন, তবে তার এক এবং একমাত্র সুপারস্টার ছিলেন নীতীশ কুমার। তিনি ছাড়া এই নির্বাচনে আর যত নাম শোনা গিয়েছে, তাঁরা সবাই বড় জোর বিভিন্ন মাপের পার্শ্বচরিত্র— এবং, এই কথাটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে মাথায় রেখেই বলছি।
বিহারে প্রথম বার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নীতীশ কুমার রাজ্যের মহিলাদের একটি স্বতন্ত্র এবং বিশেষ ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে দেখতে শুরু করেছিলেন। ২০০৯ সালে নীতীশের সরকার স্কুলছাত্রীদের মধ্যে সাইকেল বিতরণ করেছিল। এই নির্বাচনের আগে, অক্টোবরের গোড়ায়, তিনি বিহারের সদ্য তৈরি হওয়া মুখ্যমন্ত্রী মহিলা রোজগার যোজনায় নাম নথিভুক্ত করানো ২৫ লক্ষ মহিলার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দশ হাজার টাকা করে ট্রান্সফার করলেন। রাজ্য সরকারের খরচ হল আড়াই হাজার কোটি টাকা— নীতীশের কতখানি লাভ হল, সে হিসাব চোখের সামনে। বিহারের নির্বাচনে মহিলা ভোটব্যাঙ্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে।
নির্বাচনের ফলাফল এত দিনে সবারই জানা, তবু এক বার সংখ্যাগুলো উল্লেখ করি। নীতীশ কুমারের জেডি(ইউ) মোট ৮৫টি আসন পেয়েছে; প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে প্রচারের প্রধান মুখ হিসাবে ব্যবহার করে বিজেপি পেয়েছে ৮৯টি আসন। তবে চমকে দিয়েছেন প্রয়াত রামবিলাস পাসোয়ানের পুত্র, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী চিরাগ পাসোয়ান— গত নির্বাচনের ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে এসে এ বার তাঁর দল এলজেপি (আরপি) পেল মোট ১৯টি আসন। উপেন্দ্র কুশওয়হার রাষ্ট্রীয় লোক মোর্চা চারটি এবং জিতনরাম মাঝির হিন্দুস্থানি আওয়াম মোর্চা (সেকুলার) পেল পাঁচটি আসন। গত নির্বাচনেও রাজ্যে জয়ী হয়েছিল এনডিএ— এবং তার পরও এই নির্বাচনে জোটের সব শরিক দলেরই আসনসংখ্যা বেড়েছে। এনডিএ-র কোনও শরিক দলকেই মানুষ ফেরায়নি— নীতীশের প্রতি জনতার বিশ্বাসের সুফল তাঁরা পেয়েছেন। অন্য দিকে, বিরোধী মহাগঠবন্ধন কার্যত ধুয়ে সাফ হয়ে গিয়েছে। আরজেডি পেল মাত্র ২৫টি আসন, কংগ্রেস পেল ছ’টি। সিপিআই(এমএল) দু’টি এবং সিপিএম একটি আসন পেয়েছে।
এনডিএ-র দুই প্রধান শরিক বিজেপি ও জেডি(ইউ) সমান সংখ্যক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল— বিজেপির চেয়ে চারটি আসন কম পেলেও নীতীশই এই নির্বাচনের নায়ক। বলতে পারেন, বিহারের মানুষ এই নির্বাচনে তাঁকে বিদায় সংবর্ধনা দিল। ২০২০ সালের নির্বাচনের আগে নীতীশ বলেছিলেন যে, সেটাই তাঁর শেষ নির্বাচন। সে বার রাজ্যবাসী তাঁর কথায় বিশ্বাস করেননি। এ বার আর নীতীশ তেমন কিছু বলেননি। তবে, নির্বাচনের আগে গোটা রাজ্য ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলে বারে বারেই মনে হয়েছে যে, বিহারবাসী বিশ্বাস করছেন, আগামী নির্বাচনে নীতীশ আর ভোটে দাঁড়ানোর মতো অবস্থায় থাকবেন না। মানুষের আবেগের ঢল নেমেছিল নীতীশ কুমারের প্রতি। আর, বিজেপির চিরকালীন অস্ত্র তাদের মসৃণ নির্বাচনী মেশিনারি। তার জোর কতখানি, সে প্রমাণ মিলেছে এমন কিছু বিধায়কের ক্ষেত্রে, যাঁদের বিরুদ্ধে জনরোষ প্রবল ছিল— বিজেপি তাঁদের প্রত্যেককে জিতিয়ে এনেছে। এক দিকে রাজ্যস্তরে বিজেপির একমাত্র মুখ ছিলেন নরেন্দ্র মোদী; আর অন্য দিকে দলের অনবদ্য বুথ লেভেল ম্যানেজমেন্ট— এই জোড়া অস্ত্রকে সামলানোর উপায় বিরোধীদের জানা নেই।
অন্য দিকে, বিরোধীরা মাঠময়দান ছেড়ে সোশ্যাল মিডিয়াকে বেছে নিলেন রাজনীতির ক্ষেত্র হিসাবে। প্রথম দফার ভোটের কিছু দিন আগে অবধি মহাগঠবন্ধনের আসন সমঝোতা পাকা হল না। মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে কংগ্রেস তেজস্বী যাদবের নাম ঘোষণা করছিল না, তাই তেজস্বীও অভিমান করে ঘরে বসে রইলেন। নির্বাচনে শেষ অবধি একটি আসনেও জিততে পারলেন না যে মুকেশ সাহনি, তিনিও ভোটের আগে মর্মান্তিক চটে ছিলেন, কারণ জোট তাঁকে উপমুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী হিসাবে স্বীকার করেনি। মহাগঠবন্ধনের নেতাদের দেখে মনে হচ্ছিল, নির্বাচনের আগেই তাঁরা নিজেদের জয় সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন।
বাস্তব অবশ্য ভিন্ন ছিল। বিহারের মাঠেময়দানে এক দিকে বইছিল নীতীশ-আবেগ, আর অন্য দিকে বিজেপির নেতারা জান লড়িয়ে দিচ্ছিলেন। এক কথায় বললে, বিহারে মহাগঠবন্ধনের নেতারা আদৌ নির্বাচনে লড়েননি। হ্যাঁ, সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁদের রিল বিলক্ষণ ভাইরাল হয়েছে। বড় নেতারা ভিডিয়ো-বার্তা দিচ্ছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়— সংবাদমাধ্যমে প্রচুর সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন তাঁরা। হেলিকপ্টার ছাড়া নড়েননি। এবং, বিহারের মাটি বলছে, যাঁরা চিরকাল আরজেডি-কংগ্রেসের ভোটার, এই সব কারণেই তাঁদের অনেকে এ বার এনডিএ-কে ভোট দিয়ে এসেছেন।
নির্বাচনের শুরু থেকেই নীতীশ কুমারের পক্ষে যে হাওয়া ছিল, বিরোধীরা যদি তাকে যথাযথ ভাবে বুঝতে পারতেন, তা হলে তাঁদের উচিত ছিল তিন-চার গুণ বেশি পরিশ্রম করা। হল ঠিক উল্টো। নীতীশ ও মোদী মাঠ কামড়ে পড়ে রইলেন। নির্বাচন যত গড়াল, তাঁরা তত বেশি পরিশ্রম করলেন, তত বেশি মানুষের কাছে গেলেন। উল্টো দিকে, রাহুল-তেজস্বীকে দেখে মনে হল, তাঁরা যেন মাঠে নামতে হয় বলে নেমেছেন। নির্বাচনে জিততে গেলে যে লড়তে হয়, সে কথা যেন তাঁরা ভুলেই গিয়েছেন।
এনডিএ-র এই জয় কিন্তু তাদের জন্যও একটি সন্ধিক্ষণ। কারণ, পরিস্থিতি পাল্টাতে চলেছে। ধরে নিচ্ছি, আগামী দু’বছর নীতীশই মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে থাকবেন। কিন্তু তার পর জেডি(ইউ)-বিজেপিকে নতুন মুখ খুঁজতে হবে, যিনি বিহারের উন্নয়নের গতি অব্যাহত রাখবেন, নীতীশের উন্নয়নের মডেল বজায় রেখে তার পরবর্তী পথ খুঁজবেন।
দ্বিতীয়ত, এই নির্বাচনে স্পষ্ট যে, রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল আরজেডির প্রতি মানুষের আস্থা নেই। অর্থাৎ, বিরোধী পরিসরে এখন একটি শূন্যতা রয়েছে। প্রশান্ত কিশোরের জন সুরাজ পার্টি কিন্তু এই শূন্যতা ভরাট করতে তৈরি। এটা সত্যি যে, এই দলের কোনও বিধায়ক এ দফায় বিধানসভায় থাকবেন না। কিন্তু, সরকারের ভ্রান্ত নীতির বিরোধিতা করার জন্য তাঁরা রাস্তায় নামবেন, এটা বলে রাখতে পারি। আমার ধারণা, আগামী দিনে জন সুরাজ পার্টি এনডিএ সরকারের কঠিন প্রতিপক্ষ হয়ে উঠবে। এই দলের প্রতি বিহারের মানুষ আশাবাদী।
লালু প্রসাদ যাদব ক্ষমতায় এসে রাজ্যের নিম্নবর্গের মানুষকে সামাজিক ক্ষমতার সিঁড়িতে অনেকখানি তুলে এনেছিলেন। তার পর নীতীশ কুমার রাজ্যের আধুনিকীকরণের পথে হেঁটেছেন। ভবিষ্যতে যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, তাকে মন দিতে হবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের উপরে। বিহারের উড়ান শুরু হয়েছে— এখন শুধু নতুনতর উচ্চতায় পৌঁছনো বাকি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)