মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত প্রায় দেড়শো বছর আগের সাধারণ এক বাঙালি যুবক। জীবনসংগ্রামের বিড়ম্বনা তাঁকে যখন নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছে আত্মহননের চরম সিদ্ধান্তে, ঘুরতে ঘুরতে তখনই ঠিক তিনি এসে পৌঁছলেন আর এক বাঙালির কাছে। তিনি কেতাবি চেহারার ধোপদুরস্ত কোনও ভদ্রলোক নন; দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো প্রভাবশালীর ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে ব্রাহ্মসমাজে ‘বাবু’ সাজতে অস্বীকার করেছিলেন নির্দ্বিধায়। কামারপুকুরের এক পল্লিপটে তাঁর আবির্ভাব। তাঁর আটপৌরে দিনযাপন সাধারণ হয়েও অসাধারণ। কারণ, তিনি মানুষের মধ্যে জাগরিত করেছেন জীবনের মৌলিক জিজ্ঞাসা। ‘আমি’ কে? কোথা থেকে ‘আমি’ এসেছি? কী উদ্দেশ্যে এই জীবনধারণ? অদ্ভুত সাধনলব্ধ প্রজ্ঞায় সে রহস্য সেই সাদাসিধে লোকটি অনাবৃত করেছেন। আর তা মেলে ধরেছেন জগতের কল্যাণে।
আত্ম-অন্বেষণের পথ ঘিরেই জীবনে আসে প্রশান্তি। আত্ম-সমীক্ষণের অনভ্যাসে জন্ম নেয় অতৃপ্তি, বাড়ে জাগতিক অভিলাষ। তখনই সংসারক্লান্ত পথিকের প্রতিভূ হয়ে মহেন্দ্রনাথরা শ্রীরামকৃষ্ণের চরণে ভিড় করেন। আর অমৃতস্পর্শে ‘শ্রীম’ হয়ে ফিরে আসেন। আত্মহননের পরিবর্তে শুরু হয় আত্মদর্শনের পথে এক অরূপ অভিযাত্রা।
আসলে জীবনকে ইচ্ছেমতো লক্ষ্যে বেঁধে গুছিয়ে নিতে থাকি আমরা। এর পরেও অপূর্ণতা থাকেই। প্রাচুর্যের মধ্যেও মনে হয় জীবন নিরর্থক। বস্তুত সাধারণ দিনগত কর্মটির পিছনে একটা উদ্দেশ্য থাকা প্রয়োজন। নয়তো যে জীবনকে সুপরিচালিত বলে মনে করছি, তা আদতে কোনও উচ্চ আদর্শাভিমুখী না হয়ে উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়ে। বাইরের তথাকথিত বিশালতার যে বুদবুদ তা অন্তরের সৌন্দর্যকে স্পর্শই করতে পারে না, ফলস্বরূপ নিঃসঙ্গতা, অবসাদ, আত্মহত্যা, বিভিন্ন পারিবারিক ও মানসিক চাঞ্চল্য ক্রমে বৃদ্ধি পায়। আসলে বাহ্যিক উন্নতির মাপকাঠিতে অন্তরের উন্নতির পরিমাপ বিচার করে আনন্দে থাকা এক বিমূঢ় ভাবনা। প্রশ্ন জাগে, এই আত্মনিগ্রহই কি জীবনের স্থিতি, না কি জীবনের অন্য বৃহৎ অর্থ আছে! অতি তুচ্ছ দিনগত কর্মটির প্রয়োজনীয়তা কোথায়? তারও তো বিশেষ উদ্দেশ্য থাকা প্রয়োজন। সেই উদ্দেশ্য থেকেই প্রত্যয়ের জন্ম, যে প্রত্যয় মনের সংশয় দূর করে। শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলছেন, “কর্ম করতে গেলে আগে একটি বিশ্বাস চাই, সেই সঙ্গে জিনিসটি মনে করে আনন্দ হয়, তবে সে ব্যক্তি কাজে প্রবৃত্ত হয়। মাটির নিচে একঘড়া মোহর আছে এই জ্ঞান, এই বিশ্বাস প্রথমে চাই। ঘড়া মনে করে সেই সঙ্গে আনন্দ হয়— তারপর খোঁড়ে। খুঁড়তে খুঁড়তে ঠং শব্দ হলে আনন্দ বাড়ে। তারপর ঘড়ার কানা দেখা যায়। তখন আনন্দ আরও বাড়ে। এইরকম ক্রমে ক্রমে আনন্দ বাড়তে থাকে।” প্রচেষ্টা ও বিশ্বাসই গড্ডলিকা প্রবাহের অনুবর্তন কাটিয়ে জীবনকে আনন্দে বেড়ে উঠতে আহ্বান জানায়।
আবার নিজেকে খুঁজতে গিয়ে যে জগৎকে উপেক্ষা করতে হবে, তাও নয়। মানুষের ব্যথায় শ্রীরামকৃষ্ণের মতো কাতর আর কেউ নন। স্নেহপরবশ তিনি একদা দক্ষিণেশ্বরে মথুরবাবুর পুত্র ও তৎকালীন প্রধান ত্রৈলোক্যকে এক প্রতিবেশীর অন্নকষ্ট-প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “নিজের মেয়ের বিয়েতে হাজার হাজার টাকা খরচ— আর পাশের বাড়িতে খেতে পাচ্ছে না। তাদের দুটি চাল দিতে কষ্ট— অনেক হিসেব করে দিতে হয়।… আমি আর আমার বাড়ির সকলে ভাল থাকলেই হল। মুখে বলে সর্বজীবে দয়া।” এই উদ্বেগে আছে সংহতি, সহমর্মিতা। আর পাঁচ জন তথাকথিত বেদান্তবাদী সাধুর মতো সাধারণ মানুষের জীবনের অস্তিত্ব তিনি অস্বীকার করেননি। তাই তো লাটু, বিনোদিনী, বৃন্দে ঝি, চিনু শাঁখারি, রসিক মেথর— সবাইকে অনায়াসে আপন করে নিতে পারেন। ব্যক্তিসত্তার অস্তিত্ব যখন কেউ বৃহৎ পরিসরে অনুভব করে, তখনই তা হয়ে ওঠে ‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’।
শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের অন্তরের মধ্যে জীবন-জিজ্ঞাসার দীপটি প্রজ্বলিত করতে চেয়েছেন, যেখানে মূল কৌশল হল বিচার— অপূর্ণ জীবনের মূল্যায়ন। চমৎকার উদাহরণে শিখিয়েছেন আত্ম-বিশ্লেষণের পাঠ: “চাল কাঁড়ছ, একলা বসে কাঁড়তে হয়। এক-একবার চাল হাতে করে তুলে দেখতে হয়, কেমন সাফ হল।” এই প্রয়াসে উত্তীর্ণ হলে নিজের ভিতর প্রসন্নতার প্রবাহিনী উথলে ওঠে। তাঁর কথামৃত-এর পাতায় পাতায় আত্মানুসন্ধানের এই প্রসঙ্গই ছড়িয়ে রয়েছে।
রয়েছে ত্যাগের কথাও: ক্ষুদ্র কামনা বাসনা লোভ ত্যাগ। আবার ত্যাগের সঙ্গে সম্পৃক্ত সামাজিক স্থিতিশীলতা ও সুস্থ জীবনবোধের ধারণা। ত্যাগ মানে কতকগুলো সুযোগ-সুবিধা থেকে নিজেকে প্রতিহত করা নয়, ত্যাগ মানে নেতিবাচকতাকে সরিয়ে ইতিবাচকতায় নিজেকে উন্নীত করা। বৃহত্তর স্বার্থে আমিত্বের ক্ষুদ্র স্বার্থ প্রত্যাহারই ত্যাগ। লোভ, আসক্তি মানুষকে উদ্দেশ্যহীন, বদ্ধ ও যান্ত্রিক করে তোলে। তাই যারা অন্তর থেকে নিজেদের বিচার করতে জানে, তারাই জীবনের উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে পারে, পায় মুক্তির স্বাদ। আজকের সমাজে যখন মানুষের সাফল্য টাকা-বাড়ি-গাড়ি-উঁচুপদের মানদণ্ড-নির্ভর, তখন শ্রীরামকৃষ্ণ তুলে ধরেন জীবন-জিজ্ঞাসার সূত্রটি। ত্যাগের আদর্শ ও শুভচেতনার স্ফুরণ ঘটাতেই তাঁর আত্মপ্রকাশ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)