কবি শামসুর রাহমানের পঁচাত্তরতম জন্মদিনে ঢাকা জাতীয় জাদুঘরের পাশে চারুকলা বিভাগের চত্বরে এক চমকপ্রদ অনুষ্ঠানের সাক্ষী ছিলাম। আক্ষরিক অর্থেই কাতারে কাতারে মানুষ আসছেন। ক্ষমতাবান বা প্রথম সারির মানুষ বাদ দিয়েও ধরা যাক ফরিদপুর আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র বা মাদারিপুর কচিকাঁচা দল— এমন অজস্র সংস্থার তরফ থেকে মঞ্চে উপবিষ্ট কবিকে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে। একটি ট্রাক ভরে উঠছে শুধু ফুলের উপহারে। খানিক ক্ষণের জন্য আলো চলে গেলে চার পাশে থাকা গাড়ির হেডলাইট জ্বলে উঠল এক মুহূর্তে। হতবাক আমি ভাবছিলাম, বাংলা ভাষার এক কবিকে কেন এ ভাবে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো হয়? পরে বুঝেছি হয় এই কারণে যে, ওই দেশে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে, মাতৃভাষা রক্ষার জন্য বহু সংখ্যক কবি, লেখক, বুদ্ধিজীবী অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে এসেছেন। সাধারণ মানুষের, ছাত্রদের আন্দোলনের পুরোভাগে থেকেছেন কবি লেখকরা। যে বার প্রথম সেগুনবাগিচায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রক্ষিত শহিদ গদ্যকার শহীদুল্লাহ কায়সার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, গোবিন্দচন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরী, সাংবাদিক জহির রায়হানদের ব্যক্তিগত ব্যবহারসামগ্রী, চিঠিপত্র দেখেছিলাম, বধ্যভূমিতে ফেলে রাখা শিলালিপি সম্পাদক, সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের পিছমোড়া লাশের ছবির সঙ্গে অগণিত অনামা করোটি হাড়ের স্তূপ দেখে বমি চাপতে হচ্ছিল, সে দিনই বুঝেছিলাম যে, অতি সরলীকরণে বাংলাদেশের মানসিকতা বিচার করলে ভুল হবে। ১৯৪৭ সালে যে দেশ আমরা অনেকেই ছেড়ে এসেছি, এ দেশ সেই দেশ নয়। নিজের ধর্মকে অস্বীকার না করেও তাকে পাশে সরিয়ে বাঙালি জাতি হিসাবে নিজের পরিচয় তৈরি করতে হয়েছে তাকে। এ বড় সহজ কাজ নয়।
ঢাকার জাতীয় কবিতা উৎসবের আমন্ত্রণে ঢাকা ক্লাবে প্রাতরাশ টেবিলে জমে উঠেছিল তুরস্কের এক কবি নাট্যকার বন্ধু ও তার এক মিশরীয় সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা। আরব বসন্তের সাক্ষী মিশরের সাংবাদিক নানা চিত্তাকর্ষক ঘটনার মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা শুরু করলেন। তুর্কি কবি বন্ধু যোগ দিলেন তাতে। উপমহাদেশের এক নেত্রী একটি ছোট দেশকে হেনরি কিসিঞ্জার কথিত ‘তলবিহীন ঝুড়ি’ থেকে তার সীমিত ক্ষমতার মধ্যে যথাসম্ভব সতর্কতায় ও কৌশলে উন্নয়নশীল দেশের দিকে নিয়ে চলেছেন, যেখানে মধ্য এশিয়া, আরব দুনিয়ার অপেক্ষাকৃত ধনী দেশগুলিতেও দীর্ঘস্থায়ী সুস্থিতি, গণতন্ত্র বলে কিছুই নেই। আপেক্ষিক ও তুল্যমূল্য বিচারেই তাঁদের এই মন্তব্য ধরে নিলেও এর সারবত্তা অস্বীকার করা যায় না। আমার কাছে তাঁরা এই কবিতা উৎসব বিষয়ে জানতে চাইলেন, যার সূত্রপাত এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। ছাত্রদের সঙ্গে সঙ্গে কবি লেখকরা সেখানেও সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, বেলাল চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, রফিক আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, আসাদ চৌধুরী, মুহম্মদ নুরুল হুদা থেকে তরুণ রুদ্র মহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ সামাদ, মোহন রায়হান, তারিক সুজাতরা এই আন্দোলন-জাত প্রতিবাদের কবিতা উৎসবে বিভিন্ন সময়ে জড়িত থেকেছেন। এই কবিতা উৎসবের সূচনায় আমরা কবি আসাদ চৌধুরীকে বলতে শুনেছি, অসাম্প্রদায়িকতা ও বাঙালিত্বের চেতনাকে লালন করে দেশের সব ক্রান্তিকালে সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছে তাঁদের কবিতা পরিষদ। আলোচকদের মুখে আমরা শুনেছি, উৎসবের পৃথক চরিত্রটি ধরে রাখতে কখনও কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। মুহম্মদ নূরুল হুদা স্পষ্ট করেছেন, স্মরণপূর্ব কাল থেকে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বাঙালি টিকে আছে নিদেনপক্ষে তার ব্যক্তিপরিচয়ে।
এর পরে আমরা শাহবাগে বড় মাপের ছাত্র-আন্দোলন দেখতে পেয়েছি, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের জঘন্যতম যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ায় ক্ষুব্ধ জনগণের নেতৃত্ব দিয়েছিল ছাত্ররা। রাষ্ট্রের শাস্তির পরোয়া না করা সেই তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলনের অভিঘাত সারা বিশ্ব দেখেছিল। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আবেগজাত অসংগঠিত আন্দোলনকে সুযোগান্বেষীরা ভুল পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং কখনও কখনও সফলও হয়। কিন্তু তার পাশে আবারও জায়গা করে নেয় অন্যায়ের প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদের শুভ ইচ্ছাকে আমরা খাটো করে দেখতে পারি না। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির বিচার নয়, নাগরিক সমাজ, ছাত্রদল ও বুদ্ধিজীবীর এই উপস্থিতি আমাদের আস্থা জোগায়।