—প্রতীকী চিত্র।
৩০ সেপ্টেম্বর থেকে বাতিল হয়ে যাবে দু’হাজার টাকার নোট। তত দিন অবধি পুরনো নোট পাল্টে নতুন নোট পাওয়া যাবে। এ বারের নোটবন্দির চরিত্র ২০১৬-র থেকে মৌলিক ভাবে আলাদা। আগের নোটবন্দি ছিল আকস্মিক। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর রাত আটটায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন যে, রাত বারোটা থেকেই ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট বাতিল, ছাপানো হবে নতুন ৫০০ আর ২০০০ টাকার নোট। জনগণকে সময় দেওয়া হল ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত, ব্যাঙ্ক আর ডাকঘরে এসে পুরনো নোট বদলে নতুন নোট সংগ্রহ করতে। নতুন নোট ছাপাতে অনেক দেরি হল। চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলায় জেরবার হলেন মানুষ। নোটবন্দি অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ভাবে কতখানি ক্ষতি করেছিল, এখনও তার কোনও যথাযথ পরিসংখ্যান দেখিনি। তবে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পালনিয়াপ্পন চিদম্বরমের উক্তি অনুযায়ী, এর ফলে ১.৫% জাতীয় বৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছিল। ১৫ কোটি মানুষের রুজিরোজগার ব্যাহত হয়েছিল। হাজার হাজার ক্ষুদ্র এবং মাঝারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ বারের নোটবন্দি কিন্তু অনেক আগে থেকে আটঘাট বেঁধে হচ্ছে। জনসাধারণও মানসিক ভাবে অনেক বেশি প্রস্তুত।
২০১৬-র ঝটিকা নোটবন্দিকে যতই গালমন্দ করি না কেন, এর একটি প্রভাব সাত বছর বাদে অনুভূত হয়েছে— বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, দেশে ডিজিটাল লেনদেন বেড়েছে। এখন প্রায় সব মুদির দোকানেই ইউপিআই পদ্ধতিতে টাকা দেওয়া যায়। আধার-এর তথ্যভান্ডারের মাহাত্ম্যে এখন যে কোনও ডিজিটাল লেনদেন থেকে ক্রেতা ও বিক্রেতার নাড়িনক্ষত্র পরিচয় জানা যায়, যা নগদ টাকায় হলে সম্ভব হত না। বৈদ্যুতিন লেনদেন করতে হলে ক্রেতা ও বিক্রেতা, উভয়েরই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকা প্রয়োজন। যত মানুষ ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন, অর্থনীতির ভাষায় ফাইনানশিয়াল ইনক্লুশন বা আর্থিক অন্তর্ভুক্তি তত বাড়বে। আইনসম্মত লেনদেনের গতি বাড়বে। ভারতে এখনও অসংগঠিত, অনথিভুক্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রচুর। এই ধরনের সংস্থাগুলি অসংগঠিত ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত বলে চিহ্নিত। এখানে নগদ লেনদেন বেশি হয়, কর্মচারীদের বেতনের কোনও লিখিত চুক্তি নেই। যার ফলে রাজস্ব পাওয়া যায় না। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়লে এই সংস্থাগুলির সংখ্যা হ্রাস পাবে। তার ফলে দেশে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং রাজস্ব সংগ্রহের হারও বাড়বে। স্টেট ব্যাঙ্কের একটি সমীক্ষা বলছে, প্রথম নোটবন্দির পর ২০১৮-২১’এর মধ্যে এই ধরনের অনথিভুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৩২% কমেছে।
এ ছাড়া বৈদ্যুতিন লেনদেন বাড়লে এর একটি প্রভাব ঋণের বাজারেও পড়বে, যদি না রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। টাকার ব্যবহার দৈনন্দিন যত কমবে, কাঁড়িকাঁড়ি টাকা সঙ্গে রাখার প্রয়োজনীয়তাও ফুরোবে। নগদ টাকাকে মানুষ আর সম্পদ হিসাবে গণ্য করবেন না। আমার দাদু তাঁর কষ্টার্জিত সঞ্চয়ের সিংহভাগ ট্রাঙ্ক আর আলমারিতে নগদে রেখে দিতেন। আমরা অবশ্য এখন আর তা করি না। যদি ভয় থাকে যে, পুরনো টাকা যে কোনও মুহূর্তে বাতিল হয়ে যেতে পারে, তা হলে আমি আমার দাদুর পদাঙ্ক আরওই অনুসরণ করব না। তা হলে কী করব? হয়তো সোনা কিনব, যার দাম চট করে পড়ে না। তবে সোনা কিনে সেটিকে নিরাপদ ভাবে মজুত রাখাও এক ঝকমারি! বাড়ি কিনে সেটিকে সম্পদ হিসাবে রাখা আর একটি পথ। কিন্তু তার জন্য যে অঙ্কের সঞ্চয় প্রয়োজন, তা অনেকের না থাকতে পারে। শেয়ার বাজারে বা মিউচুয়াল ফান্ডে টাকা খেলানো আর একটি পথ। তাতে আবার ঝুঁকি আছে। মধ্যবিত্ত আমজনতার কাছে সব থেকে ঝুঁকিহীন পদ্ধতি হল ব্যাঙ্কে টাকা রাখা অথবা সরকারি ঋণপত্র কেনা। ব্যাঙ্কে আমানত বাড়লে, ব্যাঙ্ক সেই টাকা ঋণ দিতে আগ্রহী হবে। সরকারি ঋণপত্র কেনার অর্থ, আমি সরকারকে ঋণ দিচ্ছি। এই দু’টি পথেই ঋণের সরবরাহ বাড়বে। ফলে বাজারে সুদের হার কমবে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতে প্রকৃত সুদের হার ২০১৬-তে ছিল ৬.২ শতাংশ। নোটবন্দির পর ২০১৮-তে সেটি ৫.৪ শতাংশে নেমেছে। সুদের হার কমলে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি প্রকল্পগুলি উপকৃত হবে। বিনিয়োগ বাড়বে, যার ফলে দেশের সমৃদ্ধিও বাড়বে। ২০২২-এ মূল্যস্ফীতির পর সুদের হার অবশ্য বেড়েছে।
নোটবন্দি যে শুধু ভারতেই হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। গত অক্টোবর ২৬, ২০২২ নাইজিরিয়ার সরকারও বেআইনি লেনদেন থামানোর জন্য তাদের ২০০, ৫০০ এবং ১০০০ নাইরার নোট বাতিল করতে উদ্যোগী হয়েছে। এই প্রকল্পটির নাম কারেন্সি রিডিজ়াইনিং। জনসাধারণকে এই বছরের জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছিল পুরনো নোট বদলানোর জন্য। এর ফলে সে দেশেও বিস্তর জলঘোলা হয়েছে। উভয় দেশেই নোটবন্দির ফলে কালোবাজারি কমার কথা। দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং আয়কর সংগ্রহ বাড়ার কথা। এগুলি সত্যিই ঘটবে কি না, তা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে সরকারের সৎ এবং বলিষ্ঠ উদ্যোগের উপর।
দ্বিতীয় নোটবন্দির এই উদ্যোগ ভারতে ডিজিটাল মুদ্রা চালু হওয়ার প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। সরকার প্রয়াসী হয়েছে একটি নগদহীন সমাজ তৈরি করতে। ব্যাপারটি অত সহজ হবে না। এখনও টাকার ব্যবহার বিপুল। বৈদ্যুতিন লেনদেন গ্রামের তুলনায় শহরে প্রায় তিন গুণ বেশি। এখনও ভারতের অনেক প্রত্যন্ত গ্রামে একটি এটিএম মেশিন বা ব্যাঙ্ক খুঁজতে বহু দূর হাঁটতে হয়। গ্রামীণ মানুষদের ডিজিটাল জ্ঞান, স্মার্টফোনের ব্যবহার ইত্যাদি শহুরে লোকেদের থেকে অনেক কম। এই ডিজিটাল অসাম্য দূর করতে জনসাধারণের অর্থনৈতিক সচেতনতা বাড়ানো, এবং সঠিক পরিকাঠামো তৈরির প্রয়োজন আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy