E-Paper

কাকে বলব ভারতীয়

রতন থিয়াম এনএসডি-র ১৯৭৪-এর গ্র্যাজুয়েট, ইম্ফলে ফিরে ১৯৭৬-এ তৈরি করেন কোরাস রেপার্টরি থিয়েটার। এত দীর্ঘ শারীরিক ট্রেনিং যে তাঁদের অভিনেতা না বলে পারফর্মার-এর বিস্তৃতি দেওয়া ভাল।

ঈপ্সিতা হালদার

শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০২৫ ০৬:৪৬

সে প্রায় ত্রিশ বছর আগে। পত্রিকার পাতায় একটা নাটকে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধশেষে যুধিষ্ঠিরের বিলাপের ছবি দেখে স্তম্ভিত হয়েছিলাম। যুধিষ্ঠিরের চোখে কালো চশমা, বুকে জড়িয়ে আছেন পুত্রদের মৃতদেহ। সেগুলি বড় বড় কাপড়ের পুতুল, কাপড়ে মোড়া শবদেহের মতোই অগোছালো, বীভৎস। স্ফীত উলের মতো লাল দড়ি প্যাঁচানো রয়েছে রক্তের ধারা বোঝাতে। সে ছিল রতন থিয়ামের অন্ধা যুগ-এর আলোচনা। এই ছবি দেখে মফস্‌সল থেকে কলকাতায় পড়তে এসে শীতকালে নান্দীকার উৎসবের টিকিটের লাইনে দাঁড়ানো জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে পড়ে।

তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের এমএ ক্লাসে ‘থিয়েটার অব রুটস’-এর আলোচনা রতন থিয়ামে এলে প্রতি বার এই দৃশ্য দিয়ে আমাদের কথা শুরু হয়। তার বিবরণ দিতে গিয়ে প্রতি বার সেই প্রথম বারের মতোই গায়ে কাঁটা দেয়, আর রতন থিয়ামের সূত্রে ‘প্রাদেশিক’ ভাষা থিয়েটার— ‘রুটস’-এর আবহে এক সামগ্রিক ভারতীয়ত্বের সন্ধান আমাদের জন্য অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। ভাষা-অঞ্চল-জাত-এথনিসিটি-ধর্মে বহুস্তরী ও বহুস্বরী এই রাষ্ট্রকে স্বাধীনতা-উত্তর কী ভাবে এক তানে বেঁধে নেওয়া যাবে যাতে তার বৈচিত্র-বিবিধতা ক্ষুণ্ণ না হয়, আবার বহুজনপদের নানাত্ব রাষ্ট্রকে ভিতর থেকে স্ববিরোধেও ভেঙে না ফেলে, সেই ভাবনায় তৈরি হতে থাকে নানা জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান। সঙ্গীত নাটক অকাদেমি ও সাহিত্য অকাদেমি শুরু হয় সেই পঞ্চাশের দশকেই। আজ জেনে নিলে সুবিধা— স্বাধীন রাষ্ট্রকে বি-উপনিবেশিত চেতনায় নিয়ে যেতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এই ভারতীয়ত্বের খোঁজ হিন্দু জাতীয়তাবাদের থেকে আলাদা ছিল।

রতন থিয়াম আমাদের সেই সময়ে নিয়ে যান, যখন তিনি ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-য় পড়াশোনা শুরু করেছেন। সঙ্গীত নাটক অকাদেমির সচিব সুরেশ অবস্থীর ‘থিয়েটার অব রুটস’ ধারণাটি নিয়ে উৎসাহের জোয়ার তখন, যার সামনে আছেন এনএসডি-র তৎকালীন ডিরেক্টর ইব্রাহিম আলকাজ়ি। কী ভাবে নাটক লেখা হবে; উপনিবেশিক রাজনৈতিক আগ্রাসনের পর দেশভাগ-দাঙ্গায় যে হিংসার বীজ বপন হল তা নিয়ে, স্বাধীন রাষ্ট্রে চিন্তাচেতনা গড়তে কোন বিষয়ে কথা বলা জরুরি, ভারতীয় আধুনিকতার সন্ধানে ভারতের অতীতকে কী ভাবে দেখা যেতে পারে, এই সব আলোচনা তখন চলছিল প্রতিষ্ঠানের ঘেরাটোপে।

বাস্তবতাবাদের একমুখী চর্চায় ভারতীয় অভিজ্ঞতার বিপুল বিস্তার খর্ব হতে থাকবে, তা বুঝে প্রসেনিয়ামে ধরা আদ্যন্ত অসম্ভব উপাদানগুলিকে নানা গোষ্ঠীর রিচুয়াল থিয়েটার থেকে নিয়ে এসে, প্রসেনিয়ামের মধ্যে অনুষ্ঠেয় শরীরকে সংলাপের অভিপ্রায়ের বাইরে এনে পেশ করছিলেন যাঁরা, রতন থিয়াম তাঁদের মধ্যে এক জন। তিনি আমাদের নিয়ে যান থিয়েটারের রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিকতার ইতিহাসের দিকে, যেখানে প্রতিষ্ঠানের আবহেই হাবিব তনভির, গিরিশ কারনাড, এম কে রায়না, সত্যদেব দুবেকে দেখতে পাওয়া যায়। জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে আগ্রাসী ‘এক জাতি এক ধর্ম’-এর রাষ্ট্রচেতনা, তার বাইরে যে অন্য ভারতীয়ত্বের সন্ধান করা যায় ও তার শ্রমসাধ্য নির্মাণ হতে পারে— এখন তা অবাস্তব মনে হলেও তখন সেটা ভাবাই যেত। ‘থিয়েটার অব রুটস’ বার বার আগ্রাসী রাষ্ট্রধারণা ও ভারতীয় হওয়ার একমাত্রিক সংজ্ঞার দিকে প্রশ্ন ছুড়েছে। রতন থিয়ামের থিয়েটার হয়ে উঠেছে উপদ্রুত মণিপুরের রাজনৈতিক ভাষ্য। এও মনে রাখার, যে কোনও প্রাতিষ্ঠানিকতা নির্মাণের নিজস্ব গ্রহণ-বর্জন রীতি থাকে। যেমন, মণিপুরের আর এক বিশ্রুত ব্যক্তিত্ব কানহাইলাল হেইসনামের থিয়েটার রাজনীতি ও শিল্পভাষা না মনে করে শুধু রতন থিয়ামের উল্লেখ করা চলে না।

ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যকে শৈলীর মতো করে সাজাতে ও থিয়েটারকে দৃশ্যকাব্যের কাঠামোয় বুঝতে ভরতের নাট্যশাস্ত্রের বিশেষ প্রয়োগ দেখা যায় রুটস আন্দোলনে। কিন্তু ভারতের শিকড় এখানে এক-এক অঞ্চলের নাট্যজনের তার্কিক বিশ্লেষণে এক-এক রকম। রতন থিয়ামের নাটকে মঞ্চের পর্দা উঠলেই দেখা যায়, কুশীলবরা মেইতেই বৈষ্ণব চালে খোল বাজিয়ে চলেছেন বৃত্তে। যেমন বোলের গতি বাড়ে, খোলবাদকরা মাটি থেকে লাফিয়ে উঠে ঘুরন্ত চক্র বানিয়ে স্টেজে দু’পায়ের ভরে ফিরে আসেন। রতনের শৈলীতে শরীর বাচিক ভাষা থেকে আলাদা, স্বতন্ত্র একটি মাধ্যম। শরীরকে সংলাপের অতিরিক্ত ভাষা হিসেবে তৈরি করতে স্তরে স্তরে যোগ হয়েছে প্রাক্‌-বৈষ্ণব মণিপুরি আদি রাজ্য কাংলেইপাক-এর মার্শাল আর্ট ‘থাং তা’; নাট্যশাস্ত্রবিধির সূত্রধরের সঙ্গে মিলে গেছে মণিপুরি মৌখিক কাহন ‘ওয়ারি লিবা’-র কথক। মেইতেইদের অতীত যৌথ যোদ্ধা-জীবনের আবেগ, অস্ত্রশস্ত্র-নির্ভর শারীরিক অভ্যাস অন্তরঙ্গ ভাবে মিশেছে জাপানি নোহ নাটকের অঙ্গভঙ্গিমার সঙ্গে। খোল, ঢাক, শিঙা, বাঁশি, করতাল, তারের বাজনা দিয়ে তৈরি হয়েছে অবিশ্বাস্য এক সাউন্ডস্কেপ।

রুটস-এর শুরুর দিকের এক প্রধান প্রবক্তা কে এন পানিক্কর যখন কথাকলি শৈলীতে কালিদাস, ভাস ও শেক্সপিয়র মঞ্চস্থ করেন, তখন তার সরণ রিচুয়াল-আঙিনা থেকে প্রসেনিয়ামে এলেও তা কথাকলি। রতন থিয়ামের ক্ষেত্রে এই ফর্মগুলি একত্র, সংমিশ্রিত শারীরিক কোড। এই শারীরিক ভাব-ভাষা ইউরোপীয় আধুনিকতা থেকে আলাদা এক (প্রাদেশিক) আধুনিকতাকে পেশ করে, সংলাপকে সরাসরি ব্যক্ত করার বদলে দর্শকের মনে এক আবেগসঞ্জাত প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। নাটক চলাকালীন যখন আমরা মণিপুরি ভাষা বুঝতে পারি না, এই শরীরী কোডগুলি থেকে আমরা অর্থ নির্মাণ করতে পারি। সংলাপ যখন ধ্বনিতে পরিণত, তখন তার ধ্বনিগুণ থেকে, আবহসঙ্গীত-সূত্র থেকে মানে বুঝে নেওয়া যায়।

লক্ষ করা যেতে পারে, রতন থিয়াম কী ভাবে শরীরভঙ্গিকে তার প্রথা থেকে সরিয়ে অন্য কোনও অর্থে নিয়ে আসছেন। উত্তরপ্রিয়দর্শী নাটকে হাতিতে চড়ে মঞ্চের পটভূমি থেকে সৈন্য-সহ চণ্ডাশোকের আবির্ভাবে বিস্মিত হতে হয়— কী কুশলতায় স্পেস ডিজ়াইন করলে অশোককে পিঠে নিয়ে হাতির অবয়ব, এক সারি ক্রূর যোদ্ধা ও তাদের হাতে অস্ত্র, উঁচু পতাকা ব্যাকস্টেজে আঁটিয়েও সামনে অঢেল খোলা পরিসরের ভাব তৈরি করা সম্ভব। সামনে তখন এক দল ভীত বৌদ্ধ ভিক্ষু। এই যুদ্ধ ঠেকাতে না পারার গ্লানি তাঁরা জোরালো বিক্ষেপে প্রকাশ করেন হাতের লাঠি মাটিতে ঠুকে। কর্ণভারম্-এ কর্ণ যে ধনুকে (অদৃশ্য) ছিলা পরিয়ে গুণ টানেন, সেটি একটি মনুষ্যশরীর: ধনুক টেনে ধরার জোর যেমন বাড়ে, অভিনেতার শরীর তেমনই বক্র হয়ে যায়। এই ‘সিঙ্ক্রোনি’ তাজ্জব করে।

রতন থিয়াম এনএসডি-র ১৯৭৪-এর গ্র্যাজুয়েট, ইম্ফলে ফিরে ১৯৭৬-এ তৈরি করেন কোরাস রেপার্টরি থিয়েটার। এত দীর্ঘ শারীরিক ট্রেনিং যে তাঁদের অভিনেতা না বলে পারফর্মার-এর বিস্তৃতি দেওয়া ভাল। রেপার্টরিতে একত্রবাস ও অনুশীলন সেই সত্তর দশকেই থিয়েটারকে কমিউনিটি লিভিং-এ পরিণত করে।

রতন থিয়ামের নাটকের সূত্র হিসেবে এসেছে ধর্মবীর ভারতীর কাব্যনাট্য অন্ধা যুগ, হিন্দিভাষী কবি অজ্ঞেয়র নাটক উত্তরপ্রিয়দর্শী, ভাস-এর সংস্কৃত কর্ণভারম্ ও ঊরুভঙ্গম্। ইম্ফল ইম্ফল ও চিংলন মাপান তাম্পাক আমা, এই দুই মূল মেইতেই নাটকের সঙ্গে শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ, ইবসেন-এর হোয়েন উই ডেড অ্যাওয়েকেন, জঁ আনুই-এর আন্তিগোনে মণিপুরের পটভূমিতে নিয়ে আসেন তিনি। এর মধ্যে দিয়েই আমাদের খেয়াল করার থাকে যে, ভারতীয়ত্বের শিকড় বলতে কোনও আর্যতা বা উল্টে কোনও আদিমতা দাবি করা হচ্ছে না। এই প্রাদেশিক আধুনিকতা ‘নেটিভিস্ট’ নয়, তা ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ভাষা-সাহিত্য থেকে আহরণ করছে যেমন, তেমনই বহির্বিশ্ব থেকেও।

অন্ধা যুগ মঞ্চস্থ হয়েছে নানা ভাষায়। এ থেকে ভারতীয় আধুনিকতার আন্তঃপ্রাদেশিক কসমোপলিটান গড়নটি বুঝে নেওয়া যায়। প্রসঙ্গত, ইব্রাহিম আলকাজ়ির ১৯৭৪-এর অন্ধা যুগ-এ যুযুৎসুর চরিত্রে ছিলেন রতন থিয়াম। আলকাজ়ির আর এক প্রখ্যাত ছাত্র সেলিম আরিফ তাঁর স্মৃতিচারণায় পুরানা কিলার সিঁড়িতে অন্ধা যুগ-এ রতন থিয়ামের থাং তা-দক্ষতার কথা লিখেছেন। না উল্লেখ করলেই নয়, রতন থিয়াম এনএসডি-র অধিকর্তা হয়ে (১৯৮৭-৮৮) স্বল্প সময়ের মধ্যেই বারো বছরের বকেয়া সমাবর্তন এক সঙ্গে আয়োজন করেন, আমন্ত্রিত ইব্রাহিম আলকাজ়ি সবার হাতে ডিগ্রি তুলে দেন। ইব্রাহিম আলকাজ়ি, সত্যদেব দুবে, এম কে রায়না, রতন থিয়াম, কানহাইলাল, গিরিশ কারনাডের বহুভাষিক যোগ আমাদের কাছে ভারতীয়ত্ব বলতে প্রাদেশিক ভাষা-সাহিত্য ও নাটকের আঙুলে আঙুল জড়ানো একটা ছবি নিয়ে আসে। সেই বন্ধন আন্তর্জাতিকতার বৈভবে সমৃদ্ধ।

অন্ধা যুগ দেখার সুযোগ ঘটেনি। কিন্তু স্মৃতি তস্য স্মৃতিতে ফিরে ফিরে বলার থাকে, কারণ আমাদের হাতে আর্কাইভ কোথায়? কলকাতার নাটকের আর্কাইভে গেলে শোনা যায় আর্কাইভিস্ট পদ খালি বলে স্ক্রিনিং হওয়া মুশকিল। অনেক আগেই রতন থিয়াম বলেছিলেন, রাজ্য স্তরে এনএসডি-র মতো প্রতিষ্ঠান দরকার। মণিপুরের এই কঠিন পরিস্থিতিতে দাবি করেছিলেন, রাষ্ট্রের নীরবতা ভঙ্গ হোক। দাবি করেছিলেন। কিন্তু শোনে কে। দিল্লি দূর অস্ত্।

তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Ratan Thiyam Indian Theatre theatre artist Manipur

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy