কিছু দিন ধরেই দেখা যাচ্ছে, আত্মহত্যার খবর খুব বেশি। কোথাও প্রথমে হত্যা, তার পর আত্মহত্যা। হত্যা সন্তান বা প্রিয়জনকে, চরম অপমান থেকে নিজেকে বাঁচাতে, বা পারিবারিক সম্মান রক্ষায়। পরিবারের কেউ, বিশেষত নারী, সমাজবিধি লঙ্ঘন করলে প্রথমে তা গোপন করার চেষ্টা করা হয়, আবার কখনও পরিবারই কঠোরতম শাস্তি বা মৃত্যুর বিধান দেয়। সম্মান রক্ষার্থে হত্যা বা ‘অনার কিলিং’ শুধু পরিবার অননুমোদিত প্রেম, বিয়ে বা সম্পর্কের ক্ষেত্রেই ঘটে না, অপরিশোধ্য ঋণ বা আর্থিক দুর্গতি কেন্দ্র করেও হতে পারে। ফল: হত্যা বা আত্মহত্যা।
ব্যক্তিগত ও সামাজিক অনুশাসন নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের ব্যাখ্যায় অনার কিলিং বহু যুগ ধরে এ দেশের সর্বত্র ছিল, এখন বিশেষ কিছু গোষ্ঠীতে এসে ঠেকেছে। এর বলি সাধারণত পরিবারের অল্পবয়সি মেয়েরা। তাদের ‘অপরাধ’: পরিবার-নির্দেশিত বিয়েতে অমত, অত্যাচারী স্বামীকে ডিভোর্সের ইচ্ছা, লেখাপড়ার চেষ্টা; ধর্মীয় গোঁড়ামি মেনে চলায় আপত্তি, পরিবার অননুমোদিত পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা, বিয়ে। এ ছাড়া আছে স্বধর্মে অবিশ্বাস, ধর্মান্তরণ। এক কথায়, নারী যখনই তাঁর পরিবারের পুরুষ সদস্যদের নিছক পারিবারিক সম্পত্তি বিবেচিত হতে অস্বীকার করেছেন, তখনই তিনি অনার কিলিং-এর লক্ষ্য।
মনোবিদ রবার্ট স্যাপলস্কি বলছেন, বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এ ধরনের হত্যা আর পাঁচটা গার্হস্থ হিংসার থেকে আলাদা। প্রথমত, বিবাহ-বিচ্ছেদকামী নারীটিকে হত্যা করে তাঁরই পুরুষ সঙ্গী, তার নিজেরই সিদ্ধান্তে। অন্য দিকে, অনার কিলিং-এ ঘাতক ‘বলিপ্রদত্ত’ নারীটির পরিবারেরই পুরুষ সদস্য, পরিবারের সম্মতিক্রমেই সে হত্যাকাণ্ড ঘটায়। দ্বিতীয়ত, অনার কিলিং কোনও স্বতঃস্ফূর্ত তাৎক্ষণিক আবেগের বশে ঘটে না। এটি পূর্বপরিকল্পিত, পরিবার-অনুমোদিত সিদ্ধান্ত। তৃতীয়ত, অনার কিলিংকে ধর্মীয় সমর্থন দিয়ে যুক্তিসঙ্গত করে তোলা হয়, তাই এতে কোনও অনুতাপ থাকে না। চতুর্থত, এই হত্যা গোপনীয়তা পছন্দ করে না। অনেক সময়েই তা ঘটানো হয় প্রকাশ্যে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসাব, শুধু পশ্চিমেই বছরে অন্তত কুড়ি হাজার সম্মান রক্ষায় হত্যা ঘটে থাকে। ‘সম্মান’-এর অর্থ তবু পূর্ব-পশ্চিম ভেদে ভিন্নতর, কিন্তু যেখানে দেশ-দেশান্তরে ভেদ নেই তা হল পরিশোধে অপারগ ঋণগ্রস্ত মানুষটির আত্মগ্লানি ও অসহায়তা, এবং তার জেরে হত্যা এবং/অথবা আত্মহত্যা। যেমন দেখা যাচ্ছে সম্প্রতি প্রচারমাধ্যমের শিরোনামে।
পিটার তুরচিনের মতো পপুলেশন বায়োলজিস্টদের মতে, হত্যা, আত্মহত্যা বা নানা ধরনের অপরাধপ্রবণতার কারণ নিহিত আমাদের সমাজ-কাঠামোয়— সামাজিক মূলধন বা পুঁজির (সোশ্যাল ক্যাপিটাল) অনটনে। সামাজিক পুঁজি বলতে বোঝায় মানুষের পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতা। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, একটি জনগোষ্ঠীর সামাজিক পুঁজি কত, তা প্রধানত দু’টি প্রশ্নের মীমাংসায় জানা যায়: নিকট প্রতিবেশীরা বিশ্বাসযোগ্য কি না, এবং এক জন মানুষ একই সঙ্গে কতগুলি সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। সংগঠন নানা ধরনের হতে পারে, পাড়ার ক্লাব, ইউনিয়ন, ভাড়াটেদের সংগঠন, সমবায় ব্যাঙ্ক ইত্যাদি। যে সমাজে মানুষ যত বেশি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, সে সমাজ তত বেশি সফল, নির্ভরযোগ্য; তত স্বচ্ছ।
আসলে, কথাটা হল, যে সমাজে আয়ের বৈষম্য বেশি, সেখানে সামাজিক মূলধন কম। আস্থা-বিশ্বাস পারস্পরিকতার উপর নির্ভরশীল, পারস্পরিকতা নির্ভর করে সামাজিক সাম্যের উপর। সমাজ ‘হায়ারার্কিক্যাল’ হলে সেখানে থাকে কর্তৃত্বের বাড়াবাড়ি। তা ছাড়া, ভোগ্যপণ্যও যে সমাজে অসমবণ্টিত, সেখানে ক্ষমতার টানাটানি বেশি; কম আয়ের লোকেরা ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে প্রায়-অদৃশ্য। অনেকের মতে, যে সমাজে আয়ের বৈষম্য যত বাড়ে, নির্বাচনের সময় সেখানে ভোটদানের সংখ্যা ততই কমতে থাকে, কেননা ভোটের ফলের উপর কম আয়ের মানুষদের ভাগ্য নির্ভর করে না। এক কথায়, আয়ের বৈষম্য প্রবল, আবার সামাজিক মূলধনও খুব বেশি, এমন সমাজ পাওয়া যাবে না। পশ্চিমে গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণত যে সমাজে আয়ের বৈষম্য যত বেশি, সেখানে পারস্পরিক সহযোগিতার অভ্যাস তত কম।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকিরো কাওয়াচি একটি সমাজমনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বলছেন, আয়ের অসাম্যের কারণে সামাজিক পুঁজি কমে যায়, ফলে মানুষের মানসিক স্ট্রেস বেড়ে যায়। মনের উপর নিয়ন্ত্রণ কমতে থাকে, হতাশা যথাযথ প্রকাশপথ পায় না। মানুষের ‘স্ট্রেস রেসপন্স সিস্টেম’ অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রবার্ট ইভান্স ও মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের জর্জ কাপলানের নিয়ো-মেটিরিয়ালিস্ট ব্যাখ্যা— দেখা গেছে, সমাজে গড়পড়তা মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার মান বাড়াতে চাইলে সাধারণ পণ্যদ্রব্যের জন্য সরকারি খরচ বাড়ানো হয়। ভাল যানবাহন ব্যবস্থা, রাস্তা, পরিস্রুত পানীয় জল, স্কুল, সার্বিক স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য ধনীরা কর দিতেও রাজি থাকে। কিন্তু আয়ের বৈষম্য যত বাড়তে থাকে, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক ফারাকও তত বাড়ে। আর সর্বসাধারণের জন্য সরকারি পরিষেবা থেকে ধনী লোকদের বিশেষ সুবিধাও ক্রমশ কমতে থাকে। তাই তারা কর বাবদ বেশি খরচেও রাজি হয় না। যে সব দেশে আয়ের বৈষম্য বেশি, তারা অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রধান অস্ত্র যে শিক্ষা, তাতেই খরচ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে বাড়ে অশিক্ষা, কুশিক্ষা।
গবেষণা বলছে, অসাম্য ও স্বাস্থ্য-পরিষেবার মধ্যে এ ভাবেই একটা সূক্ষ্ম ও জটিল সম্পর্ক স্থাপিত হচ্ছে, যা সমাজে জন্ম দিচ্ছে অপরাধ ও হিংসার। দারিদ্র সরাসরি অপরাধপ্রবণতা ডেকে আনে না; অপরাধ বৃদ্ধি পায় তখন, যখন একটি সমাজে প্রাচুর্যের মধ্যেই দারিদ্র খুব বেশি। সারা বিশ্বে, বিশেষত শিল্পোন্নত দেশগুলিতে, যেখানেই মানুষের আয়ের সমতা নেই, সেখানেই হত্যা, আত্মহত্যা ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। এর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় রবার্ট স্যাপলস্কি বলছেন, অসাম্য, বৈষম্য মানেই পারস্পরিক বিশ্বাস ও সহযোগিতা তথা সামাজিক পুঁজির হ্রাস। আত্মরক্ষার চেয়ে আত্মহত্যা, পারস্পরিক রক্ষার চেয়ে পারস্পরিক নিধন ক্রমশ আরও বেশি করে সামাজিক সত্য হয়ে উঠেছে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)