এ কাজ মেয়েদের নয়, কিন্তু মালো পুরুষদের সময় নেই সুতো পাকানোর। তাই ডান হাঁটুর কাপড় গুটিয়ে নিয়ে, নগ্ন ঊরু তুলে তুলে হাতের তেলোর ঘষা মেরে ঊরুতে টেকো ঘোরান মালো মেয়েরা। দশ বারের ঘুরানিতে এক বেড়ের সুতো পাকানো হয়ে যায়। তখন বুকের খানিকটা কাপড় তুলে ডান হাতের তেলোয় টেকোর ডাঁট ঘোরাতে হয়। বাঁ হাত টেকোর ঘাড়ে রেখে হেঁটে চলে তারা।
যুবতী মালো-বৌদের এমন বেআব্রু অবস্থায় দেখার লোভে মালোপাড়ায় ঘুরে বেড়াত তেলিপাড়ার একটা লোক। মালো মেয়েরা তার বদ উদ্দেশ্য টের পেয়ে এক দিন রাতে তাকে ঘরে ডেকে নেয়। তার পর বাছা বাছা জোয়ান মালো ছেলে তাকে গলা টিপে মেরে নৌকায় তুলে তিতাসের বার-গাঙে ছেড়ে আসে। তেলিরা এর প্রতিশোধ নিতে চায়। রজনী পালের ভাই প্রস্তাব দেয়, “যে-মাগী তাকে ডাকিয়া ঘরে নিয়াছিল, তাকে ধরিয়া নিয়া আস, কয়েক পাইট মদ কিন, তারপর নিয়া চল ভাঙা কালীবাড়ির নাটমন্দিরে।”
সে যাত্রা ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গেলেও “মালোপাড়ার সঙ্গে আর সব পাড়ার একটা মিলিত বিরোধের যে গোড়াপত্তন সেই দিন হইয়া থাকিল, তাহা আর উৎপাটিত হইল না।”
অনেকেরই হয়তো মনে পড়ে যাবে যে, অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম-এ রয়েছে এই আখ্যানটি। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত উপন্যাসটির বয়স সত্তর বছর হল, মেয়েদের নিগ্রহ করে প্রতিশোধ গ্রহণের, শাস্তি দেওয়ার গল্পটি পাল্টাল না তিলমাত্র। আর, সেই শাস্তি যদি দিতে হয় কোনও দলিতকে? সদ্য প্রকাশিত ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)-র তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে দলিতদের বিরুদ্ধে অপরাধের হার বেড়েছে। ৬০,০০০-এর কাছাকাছি অভিযোগ চিহ্নিত হয়েছে দলিতদের বিরুদ্ধে অপরাধ হিসাবে। আর, ২৮৩৫ জন দলিত মহিলার ধর্ষণ পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত হয়েছে ২০২৩ সালে।
মনে রাখতে হবে, এনসিআরবি-র তথ্য পুলিশে নথিভুক্ত অপরাধের সংখ্যাই দেখায়। যে সমস্ত অপরাধের কথা পুলিশে জানানোর সাহস পান না আক্রান্ত, অথবা পুলিশ যে সব অভিযোগের কথা শুনতে চায় না, সে সব অপরাধ এই রিপোর্টে ধরা পড়ে না। তাই, নথিভুক্ত অপরাধ বাড়ার অর্থ দু’টি হতে পারে— এক, সত্যি সত্যিই অপরাধ বেড়েছে। দুই, আক্রান্তরা আগের চেয়ে বেশি সাহস করে এগিয়ে এসে অভিযোগ জানিয়েছেন, বা পুলিশের মনোভাব বদলেছে। অতএব এনসিআরবি-র রিপোর্ট বেরোলেই অপরাধের বাৎসরিক বৃদ্ধির হার কষে ফেলাটা কোনও অর্থপূর্ণ কাজ নয়। রাজ্যে রাজ্যে অপরাধের হারের তুলনা করে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনোও ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন, মেয়েদের বিরুদ্ধে নথিভুক্ত অপরাধের হার বিহারের তুলনায় কেরলে বেশি। অথচ মানবোন্নয়নের অন্যান্য সূচকের নিরিখে কেরলের মেয়েরা অনেক এগিয়ে আছেন বিহারের মেয়েদের তুলনায়।
খবরের কাগজের পাঠকমাত্রেই জানেন যে, দেশে এ সময়ের সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম হল দলিতদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ। দিন কয়েক আগেই গাড়ির চালক হিসাবে আর কাজ করবেন না জানানোয় মধ্যপ্রদেশের ভিন্ড জেলার বাসিন্দা এক দলিত নাগরিককে মূত্রপান করতে বাধ্য করেন গাড়ির মালিক, দুই শাগরেদ-সহ। সাম্প্রতিক অতীতে এমন অত্যাচারের নজির অজস্র। ঘোড়ায় চড়ে বিয়ে করতে যাওয়ার সময়ে মার খান একই রাজ্যের প্রশান্ত সোলাঙ্কি। তামিলনাড়ুতে দু’জন দলিত পুরুষকে মেরে ফেলা হয় পায়ের উপরে পা তুলে বসার অপরাধে। দলিত-চর্চার গবেষকদের মতে, এই সব নৃশংসতার পিছনে অনেক ক্ষেত্রেই রয়েছে ‘দলিত অ্যাসার্শন’ বা দলিতদের মাথা তুলে দাঁড়ানো। চিরকালই বর্ণব্যবস্থায় পিছিয়ে থাকা মানুষদের উত্থানকে বিষনজরে দেখেছে উচ্চবর্ণের মানুষ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রতিশোধস্পৃহা যেন আরও সংগঠিত আকার ধারণ করেছে। আনন্দ তেলতুম্বডের মতে, এই হিংসা সংঘটিত হয় মিলিত ভাবে অনেকের দ্বারা, এবং এর চেহারা পৈশাচিক উৎসবের মতো— ‘গ্রোটেস্ক, সেলেব্রেটরি’।
সুমন দামেরা এবং এ চন্দ্রশেখর রেড্ডি লিখেছেন, তেলঙ্গানায় একটি অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দলিতদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সঙ্গে সমান তালে বেড়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার ঘটনা। গোটা দেশের চিত্র দেখলে অবশ্য তেলঙ্গানার তেমন কোনও বিশেষত্ব থাকে না। চার দশক আগে অন্ধ্রপ্রদেশের করমচেদু এবং সুন্দুর— দু’টি জায়গাই শিরোনামে আসে এই ধরনের অপরাধের কারণে। পদ্মারাও এবং বালগোপালের মতো দলিত অধিকার কর্মী এবং লেখকদের লেখায় জানা যায় যে, করমচেদুতে ছ’জন এবং সুন্দুরে আট জন দলিতকে গণহত্যা করা হয়।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, দু’টি ক্ষেত্রেই আক্রমণকারীরা ছিল নব্যক্ষমতাশালী জমির মালিক এবং কৃষিজীবী। দলিতদের উপরে তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে ব্রাহ্মণদের মতো বংশগত শুদ্ধতার দোহাই দিতে পারত না তারা। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার বলেই কাবু করতে হত দলিতদের। এ দিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দলিতরাও একটু একটু করে ক্ষমতাশালী এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছিলেন। তাঁদের সেই উত্থান রোধ করতেই শুরু হয়েছিল গণহিংসা। এমন দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে রয়েছে জাতিবিভক্ত দেশের প্রতিটি কোণে।
এই ধরনের গণহিংসার অন্যতম উপায় যৌন হিংসা। শত্রুকে ঢিট করার সবচেয়ে মোক্ষম উপায় তাঁদের ঘরের মেয়েদের সম্মানহানি ঘটানো। তেলতুম্বডে আলোচনা করেছেন, ২০০৬ সালের কুখ্যাত খৈরলাঞ্জি গণহত্যায় এক দলিত মহিলা এবং তাঁর মেয়েকে নগ্ন করে গ্রামের ভিতর দিয়ে হাঁটিয়ে, বার বার গণধর্ষণ করে খুন করা হয়। পরিবারের পুরুষ সদস্যদেরও খুন করা হয়। পরিবারটির পদবি ছিল ভোটমাঙ্গে। গ্রামে ক্রমশই প্রতিপত্তি বাড়ছিল ভোটমাঙ্গেদের। এক পুলিশকর্মীর সঙ্গে আত্মীয়তাও হয়েছিল বিবাহসূত্রে। ভোটমাঙ্গেদের সামাজিক উন্নতি মেনে নিতে পারেনি সেখানকার অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত কুনবি সম্প্রদায়। তাই যৌন হিংসা এবং খুন।
একটি-দু’টি জায়গার ঘটনার বিবরণ নয় শুধু, সারা দেশের নথিভুক্ত অপরাধের তথ্য বিশ্লেষণ করেও দেখতে পাচ্ছি, দলিতদের সঙ্গে বর্ণব্যবস্থায় উপরে থাকা সম্প্রদায়গুলির আর্থিক ফারাক যেখানে কমছে, তাঁদের বিরুদ্ধে ঘটে চলা নৃশংসতার ঘটনাও সেখানে বাড়ছে। এ কথাও ভুললে চলবে না যে, জাতিগত হিংসার পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে যৌন হিংসা। ধর্ষণের খবরে বহু ক্ষেত্রেই ধর্ষক এবং ধর্ষিতার জাতি বা বর্ণ জানানো হয় না। হলে এ কথা আরও স্পষ্ট হত। এই অসম্পূর্ণ তথ্য পরিবেশন নিছক ভুল, না কি এর পিছনেও কোনও সচেতন সিদ্ধান্ত আছে, তা অবশ্য অজানা।
মনে পড়ে আর্টিকল ১৫ ছবির পূজাকে। দুই ধর্ষিতা বান্ধবীর মতো তাকে মেরে গাছে ঝুলিয়ে দিতে পারেনি মন্ত্রী রামলাল নাহারিয়ার ছেলে, এলাকার প্রোমোটার অংশু। তিন টাকা মজুরি বাড়াতে বলেছিল এই মেয়েরা। দলিত মেয়েদের এই স্পর্ধা সহ্য হয়নি অংশু নাহারিয়ার। তাদের পুরো সমাজকে শিক্ষা দিতেই ধর্ষণ এবং খুন। অভিযোগ গ্রহণ করতে, তদন্ত করতে প্রবল অনীহা পুলিশ অফিসার ব্রহ্মদত্ত এবং জাতবের। অয়ন রঞ্জন নামের এক সৎ আইপিএস অফিসার এবং ভীম সংঘর্ষ সেনার নেতা নিষাদের উদ্যোগে খুঁজে পাওয়া যায় পূজাকে। বাস্তবে অয়ন রঞ্জনরা না থাকলে পূজার মতো মেয়েদের পরিবার বিচার পাওয়া তো দূরের কথা, পুলিশের খাতায় অভিযোগই লেখাতে পারে না। অভিযোগ জানাতে গিয়ে ধর্ষিতা দলিত মেয়ে পুলিশের দ্বারাই আবার ধর্ষিতা হয়েছেন, এমন নজিরও রয়েছে দেশের সাম্প্রতিক অতীতে।
এনসিআরবি-র রিপোর্ট তেমন বহু মেয়ের খোঁজ দেয় না। তাই রিপোর্ট বেরোতেই অপরাধ-সারণিতে কোন রাজ্য কতখানি এগোল আর কারাই বা পিছিয়ে গেল, সেই হিসাব কষা অর্থহীন। সংবাদমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের কাজ এখন অয়ন রঞ্জন এবং নিষাদের পাশে দাঁড়ানো, ব্রহ্মদত্ত আর জাতবদের পথ কণ্টকাকীর্ণ করা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)