Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Afghanistan

বাঙালির কাবুলামি: সামনে পুজো, ভবানীপুরের ভোট, রহমত আপাতত নিজের দেশ সামলাক

বাঙালি বিশ্ববাসী। তাই সিঙ্গাপুরী কলা থেকে কাবুলি ছোলা, সব কিছুতেই আমাদের বিদেশ যোগ।

বাঙালির বিশ্বচর্চা তার পরচর্চার মতোই উৎকৃষ্ট।

বাঙালির বিশ্বচর্চা তার পরচর্চার মতোই উৎকৃষ্ট। গ্রাফিক— সনৎ সিংহ।

সুদীপ দত্ত এবং শুভময় মৈত্র
শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৭:১১
Share: Save:

বাঙালি বিশ্ববাসী। তাই সিঙ্গাপুরী কলা থেকে কাবুলি ছোলা, সব কিছুতেই আমাদের বিদেশ যোগ। আর তার সঙ্গে রাজনীতি কিংবা ফুটবল থাকলে তো কথাই নেই। কিছু দিন আগেই কোপাতে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচ ঘিরে বাংলাদেশের এক গ্রামে তুমুল লাঠালাঠি হয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে আফগানিস্তান কিংবা কাবুল নিয়ে আমাদের আলোচনা চলবে। পঞ্জশির গোছের নতুন কিছু জায়গার নামও আমরা শিখব। তাই ক্যালিফোর্নিয়াতেই থাকি কিংবা কলকাতায়, বাঙালি হিসেবে আমাদের কাবুল নিয়ে কচকচির অধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না।

পূর্বপাঠের পুনরালোচনা

তখনও আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে বিশেষ ধারণা হয়নি। আফগানিস্থান (মাঝে মাঝেই ‘ত’ স্থলে ‘থ’ করা আমাদের মজ্জাগত)-এর স্থান ভারতের ডানে না বাঁয়ে, উপরে না নীচে, কে জানে! তালিবান, মুজাহিদিন, সোভিয়েত, মার্কিন— এ সব কচকচানি তো অনেক দূরের ব্যাপার! বড়দের হাত ধরে মাঝে মধ্যে পাড়ার মোড়ে আলু-কাবলি আর ধর্মতলায় আফগানি গিলতাম, কিন্তু সেগুলোর ব্যুৎপত্তি নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করিনি। ‘কাবুলিওয়ালা’ ছোটগল্পও বোধহয় পড়া হয়েছে অনেক পরে। তবু সিনেমাতে ছবি বিশ্বাস অভিনীত রহমতের মধ্যে দিয়েই আমাদের প্রথম আফগানিস্তান ভ্রমণ। তখন আফগান বলতে নৃশংস, সশস্ত্র, নারী নিষ্পেষণকারী তালিবান নয়, নিজ-কন্যা থেকে বিচ্ছিন্ন অথচ সুদূর হিন্দুস্তানে কন্যাসম এক বালিকার মমতায় মিশে যাওয়া এক মানুষকে চিনেছিলাম। পরবর্তী কালে ওই হিন্দুকুশ পাহাড় ঘেরা দেশটা নিয়ে উৎসাহ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হল, যখন তার ইতিহাস জানতে শুরু করলাম। গোটাটাই লালমোহনবাবু অনুভূত সেই কাশীর গলির মতো, গা ছমছম করা রোমাঞ্চ এবং রহস্যাবৃত। এক কালে আফগানিস্তান ছিল হিন্দুশাসিত সাম্রাজ্যের অধীন, এবং পরবর্তী কালে রাজপাট বদলে বৌদ্ধ এবং অবশেষে ইসলাম। হিন্দুকুশে হিন্দু তো থাকতেই হবে, সঙ্গে আজকের অতিবাম হিন্দুরা কেন যে আফগানিস্তানে মুসলিম মৌলবাদ নিয়ে বেদম চেঁচাচ্ছেন না, তা নিয়ে বিজেপি-র প্রশ্ন তোলার ক্ষেত্রেও জোর কম। সে আলোচনায় শব্দ বাঁচলে ফেরা যাবে।

আপাতত মনে করিয়ে দেওয়া যাক, আফগানিস্তানে প্রত্যেকটি হাতবদলই রক্তরঞ্জিত, বাংলায় পালবংশের পালিয়ে যাওয়ার মতো আগোছালো গল্প নয়। কাবুলনামা চন্দ্রগুপ্ত থেকে কনিষ্ক, তৈমুর থেকে অধুনা আহমেদ শাহ মাসুদ, বিভিন্ন রোমহর্ষক বীরগাথায় গাঁথা। এমনিতেই বঞ্চিত বা দুর্বলদের প্রতি সহমর্মিতা বাঙালিদের এক চিরকালীন বৈশিষ্ট্য। তাই এ অভাগা দেশের কথা ছোট থেকে জানতেই হবে। একটু ভূগোলেও আসা যাক। এশিয়ার কেন্দ্রে কৌশলগত অবস্থান, খনিজ পদার্থের সম্ভার এবং সর্বোপরি কর্মঠ জনগোষ্ঠী। তবে সে সব সত্ত্বেও আজ মাথাপিছু আয়ে পৃথিবীর দরিদ্রতমদের মধ্যে অন্যতম। শেষ একশো বছরে ব্রিটেন, রাশিয়া, আমেরিকা— এ রকম কোন এক দেশের সেনার হাতে মার খেয়ে এবং তাদের পাল্টা মার দিয়ে, তার পর আবার লড়াই শুরু করতে হয়েছে অন্য এক শক্তির সঙ্গে। বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলো সুযোগ মতো লেজ গুটিয়ে বিদায় নিলেও আফগানরা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছে।

 আজ থেকে ৬০ বছর আগে দু’টি সমসাময়িক ছবির সদৃশ দুই বিদেশি চরিত্র বাঙালির মন জয় করেছিল। দু’জনেই ফেরিওয়ালা, এক জন আফগান, এক জন চিনা।

আজ থেকে ৬০ বছর আগে দু’টি সমসাময়িক ছবির সদৃশ দুই বিদেশি চরিত্র বাঙালির মন জয় করেছিল। দু’জনেই ফেরিওয়ালা, এক জন আফগান, এক জন চিনা।

বাঙালির বিশ্বচর্চায় আফগানিস্তান

শুরুতেই আমরা বিধিসম্মত সতর্কীকরণ দিয়ে রেখেছি যে, বাঙালির বিশ্বচর্চা তার পরচর্চার মতোই উৎকৃষ্ট। কিউবার বিপ্লব থেকে হংকং-এর আন্দোলন, বিন লাদেন এবং ডায়নার মৃত্যুর তুলনামূলক আলোচনা— কোনওটাই সিলেবাসের বাইরে নয়। এর মধ্যে অতি পরাক্রমী আমেরিকার বাহিনী মার খেলে তো পোয়াবারো। চুক্তি হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে। কিন্তু একেবারে যে সময়ে তৃণমূলের ত্রিপুরা অভিযান নিরীক্ষণ করতে কলকাতার আবালবৃদ্ধবনিতা ব্যস্ত, তখনই আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনার বিদায়। কিছু অত্যুৎসাহী অতিবাম সমর্থকের সৌজন্যে নেটমাধ্যমে চালাচালি শুরু হল বিপ্লবের গন্ধমাখা ‘বেশ হয়েছে’ শব্দবন্ধ। বিশ্লেষক মধ্যবামেরা কেউ কেউ ঘটনাটিকে আবার পুঁজিবাদের অবশ্যম্ভাবী পতনের সঙ্গে একই সরলরেখায় জুড়ে দিলেন। আটের দশকে তৎকালীন সোভিয়েত সেনাদের বিরুদ্ধে লড়তে আমেরিকার গুপ্তচরেরা টাকা-পয়সা-অস্ত্র দিয়ে মুজাহিদিনদের বলীয়ান করেছিল। মৌলবাদী তালিবান ব্যাটারা তাদেরই বংশধর। আল কায়দা তাদের সম্মানিত এবং সমাদৃত অতিথি। বাম ভাবনায় সত্তর এবং আশির দশকে আফগান সমাজে উন্নতি ছিল উল্লেখযোগ্য। প্রাথমিক শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের আধুনিকীকরণ থেকে মহিলাদের কাজের অধিকার— সব কিছুতেই উন্নয়ন দেখা যাচ্ছিল চোখে পড়ার মতো। বোরখাহীন, প্রাণোচ্ছল সেই আফগান তরুণীরা তৎকালীন উদারবাদের বিজ্ঞাপন হিসেবে আজও এই মুঠোফোন থেকে ওই মুঠোফোনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঘটনাপ্রবাহে ১৯৮৯-এ সোভিয়েতদের বিদায়, ২০০১-এ আমেরিকায় সন্ত্রাসবাদী হামলা এবং যুদ্ধ, আর ২০১১-তে লাদেন বধ। তার এক দশক পরে অবশেষে ২০২১-এর হুলুস্থুল। এর মধ্যে সামান্য হলেও পুঁজিবাদী ভাবনায় বলীয়ান বাঙালিরাও আছেন। তাঁদের মত হল, আমেরিকা যে আফগানিস্তানের উন্নয়নের চেষ্টার কসুর করেছিল, তা কিন্তু নয়।

সমাজতান্ত্রিক বনাম পুঁজিবাদী উন্নয়ন নিয়ে তত্ত্ব কথার তর্ক চলতে পারে। কিন্তু গত ১৫ বছরে উদারবাদী আফগানিস্তান বার বার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল। প্রচুর ঘটা করে মহিলাদের গাড়ি চালানো বা ফুটবল খেলার প্রচারও চলেছিল এক সময়। নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাইকে কেন্দ্রীয় চরিত্র সাজিয়ে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টাও হয়েছিল নতুন প্রজন্মকে। কিন্তু পরিশেষে নিট ফল সেই শূন্য। নিজের নাগরিকদের মতকে স্বীকৃতি দিয়ে আমেরিকা যখন বিদায় নিল, তখন আফগানিস্তান শিবঠাকুরের আপন দেশ। বিমানবন্দরের বাইরে হাজারে হাজারে জড়ো হওয়া উদ্বিগ্ন, শুকনো মুখগুলো মনে করিয়ে দিল জোর জবরদস্তি কুকুরের লেজ সোজা করা যায়নি। আফগানিস্তান আছে আফগানিস্তানেই। হাড় হিম করা তালিবানি সন্ত্রাস বোঝার জন্য বিমান থেকে ঝুলন্ত লোকগুলোই যথেষ্ট। মানুষ কতটা মরিয়া হলে উড়ন্ত বিমানের চাকা আঁকড়ে বাঁচতে চায়! ক্ষমতা দখলকারী কতটা হিংস্র হলে হেলিকপ্টারের তলায় দড়ি বেঁধে অন্য লোককে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমে অংশ নেওয়ানো যায়! যে মানুষগুলো স্বপ্নের বশে হলেও উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের আশা করেছিল, তাদের আবার সেই তালিবানদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা তো বটেই। আসলে না ব্রিটিশ, না সোভিয়েত, না আমেরিকা— কেউই আফগানিস্তানের আত্মার আত্মীয় হতে পারেনি। কোনও সমাজের পক্ষেই এক লাফে কয়েক ধাপ এগিয়ে যাওয়া দুষ্কর। নিরঙ্কুশ একদলীয় শাসনব্যবস্থার মধ্যে স্তালিন, মাও আংশিক ভাবে সফল হয়েছিলেন। পাশতুন, তুর্কি, হাজারা, তাজিক প্রমুখ বহু জাতি-উপজাতি খণ্ডিত এবং বহু উপ-সংস্কৃতি সংমিশ্রিত আফগানিস্তানে সেই পরীক্ষায় সাফল্য মেলা মুশকিল।

আফগানিস্তান আছে আফগানিস্তানেই। হাড় হিম করা তালিবানি সন্ত্রাস বোঝার জন্য বিমান থেকে ঝুলন্ত লোকগুলোই যথেষ্ট।

আফগানিস্তান আছে আফগানিস্তানেই। হাড় হিম করা তালিবানি সন্ত্রাস বোঝার জন্য বিমান থেকে ঝুলন্ত লোকগুলোই যথেষ্ট।

পররাষ্ট্রে তালিবান

অতএব তালিবান এই মুহূর্তে একমাত্র বিকল্প। তাদের শীর্ষনেতৃত্ব পৈশাচিক, কিন্তু দিনের শেষে তাদের এক বড় অংশ পাশতুন, তারা আফগান। দেশের অলিগলি, গুহা-গহ্বর, নদী-নালা, তাঁদের হাতের তালুর মতো চেনা। নারীর অধিকার এবং তার থেকেও বৃহত্তর ব্যক্তি স্বাধীনতা বর্তমানে তালিবানের অভিধানে নেই। সম্ভবত নেই আধুনিক সরকার পরিচালনার ন্যূনতম অভিজ্ঞতাও। কিন্তু তাদের শুধুমাত্র বর্বর বলে হেয় করা উইনস্টন চার্চিল বর্ণিত ভারতীয়দের মূল্যায়নের শামিল না হয়ে যায়! তাই সভ্য সমাজের ধৈর্য্য ধরে দেখা আর সময়ে সময়ে অত্যধিক অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ছাড়া হাতে রইল শিষভাঙা পেনসিল। এখানেই উৎপাদনের ভাগ নেওয়ার জন্যে চলবে বিভিন্ন দেশের উৎপাত। পাকিস্তান তো এই সুযোগে ভারতকে চিমটি কাটবেই। চিনের ভূমিকা হবে ফাঁক বুঝে দখলদারির। আফগানিস্তানের নীচে আছে প্রায় তিন লক্ষ কোটি ডলারের খনিজ পদার্থ। এর সঙ্গে নজরে থাকবে ১,২০০ মাইল প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইন এবং ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ প্রকল্পের জন্য অঢেল জমি। এগুলোর লোভে চিনও কি রাশিয়া আর আমেরিকার পথে হাঁটবে? নাকি ধুরন্দর বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যবসায়িক স্বার্থে আফগান সমাজকে আংশিক উন্নয়নের পথ দেখাবে? আজ থেকে ৬০ বছর আগে দু’টি সমসাময়িক ছবির সদৃশ দুই বিদেশি চরিত্র বাঙালির মন জয় করেছিল। দু’জনেই ফেরিওয়ালা, এক জন আফগান, এক জন চিনা। আজকের নীল আকাশের নীচে ওয়াং লু আর রহমত কী ভাবে নিজেদের মধ্যে এবং সর্বোপরি ভারতীয়দের সঙ্গে মিশ খাবে, ফেলুদার ভাষায় তা একমাত্র ‘মা গঙ্গাই জানেন’।

সব শেষে আবার বাঙালি। আমরা তো শুধুই নগর নকশাল নই, আমাদের মধ্যে রাষ্ট্রবাদী ভাবনাও জারিত হয়। সেখানে অবশ্যই আছে স্বদেশের সুরক্ষার প্রশ্ন, প্রাথমিক ভাবে যেখানে একেবারেই নিশ্চিন্তে থাকার জায়গা নেই। ভবিষ্যতের আফগানিস্তান মৌলবাদের আখড়া হিসেবে মাথা চাড়া দেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সে ক্ষেত্রে ভারতে গোলমাল পাকাবে বহির্দেশীয় উগ্রপন্থীরা। চিনের উস্কানিতে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের মদতপুষ্ট ভয়ঙ্কর মৌলবাদী হানাদারি আমবাঙালি খুব ভাল চোখে দেখবে না। সে ক্ষেত্রে উদারবাদী বঙ্গসন্তান প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার আখড়ায় মৃদু হিন্দুত্বের গন্ধ শুঁকতেই পারে। তবে, আপাতত এটুকুই। কারণ, সামনে পুজো। তারও আগে ভবানীপুরে ভোট। রহমত আপাতত নিজের দেশ সামলাক। খুব বড় কিছু না ঘটলে আমরা আবার ভাইফোঁটার পরে এই বিষয়টায় নজর দেওয়ার সময় পাব।

(সুদীপ দত্ত সানফ্রান্সিসকোতে কর্মরত প্রযুক্তিবিদ। শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Afghanistan taliban Bengali People digital essay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE