সম্প্রতি দিল্লি-সংলগ্ন গুরুগ্রামে ‘বাংলাদেশি’ তকমায় বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের ব্যাপক মাত্রায় ধরপাকড় করা হয়। তীব্র রাজনৈতিক সমালোচনা ও প্রতিবাদের ফলে এই নাগরিকতা যাচাই অভিযান সাময়িক ভাবে স্তিমিত হলেও বন্ধ হয়নি।
১৫ থেকে ২১ জুলাই গুরুগ্রামে প্রায় ২৫০ পুরুষ শ্রমিককে নানা ডিটেনশন সেন্টারে আটকে রাখা হয় এবং নানাবিধ অত্যাচার করা হয়। এক সপ্তাহ শেষে গুরুগ্রাম প্রশাসন এঁদের ছেড়ে দিলেও ১০ জনকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। ভয়ে গুরুগ্রামের ২.৫ লক্ষ বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকের প্রায় ৮০% তৎক্ষণাৎ বহু বছরের রোজগার, ঘরবাড়ি, বাচ্চাদের লেখাপড়া ছেড়ে, নিজেদের গ্রামে ফিরে যান। এঁরা নানা অনগ্রসর জাতির মানুষ, কিছু অসমের, কিছু পশ্চিমবঙ্গের।
এঁদের বেশির ভাগই এখনও ফিরে আসার কথা ভাবছেন না। ওঁদের ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। কোনও আইনি ভিত্তিতে নয়, এই যাচাই অভিযান চালানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের একটি ‘গোপন’ নির্দেশিকার উপর ভিত্তি করে। এই নির্দেশিকায় সমস্ত রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির জেলা প্রশাসনকে সম্ভাব্য অবৈধ বাংলাদেশি বা রোহিঙ্গা নাগরিকদের আটক করতে বলা হয়।
কোন ভিত্তিতে সন্দেহ করা উচিত, কোন পদ্ধতিতে এঁদের নাগরিকত্ব যাচাই করা উচিত এবং কোন পরিচয়পত্র নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবে গণ্য হবে, তার স্পষ্ট উল্লেখ এই নির্দেশিকায় নেই। আমরা গুরুগ্রামে গিয়ে পুলিশকে প্রশ্ন করায় তারা নির্দ্বিধায় বলে যে, যাঁরা সাধারণ মজদুর, বাংলায় কথা বলেন, যাঁদের নাম শুনে মুসলমান মনে হয়, তাঁদেরই বাংলাদেশি হওয়ার সম্ভাবনা, কাজেই সে রকম লোকদেরই আটক করা হয়েছে।
এঁদের অনেকের কাছে ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, এমনকি অসম এনআরসি সূত্রে পাওয়া নাগরিকতার পরিচয়পত্র ছিল, তাও এঁদের আটক করা হয়। নাগরিকতা যাচাই করে ছাড়ার সময়ে কোনও বিশেষ প্রমাণপত্র গুরুগ্রাম প্রশাসন জারি করেনি। সুতরাং আবার ভবিষ্যতে তাঁদের আটক করা হতে পারে। উল্লেখ্য, যে দশ জনকে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, তাঁরা আদৌ বাংলাদেশি কি না, তার কোনও প্রমাণ প্রশাসন দেয়নি। এঁদের পরিচয় সরকার জনসমক্ষে আনেনি। সম্প্রতি দেখা গেছে যে, ভারত সরকার অনেক ভারতীয় নাগরিককে অনুপ্রবেশকারী ঘোষণা করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই দশ জন কোনও ভুলের শিকার কি না,তা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
গুরুগ্রামের ঘটনার পরে-পরেই কিছু উকিল এই গোপন নির্দেশিকাটিকে জনসমক্ষে আনেন। সুপ্রিম কোর্টে এই নির্দেশিকা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে এবং এই চ্যালেঞ্জ হয়তো ফলপ্রসূও হবে। কিন্তু এই নির্দেশ জারি হওয়া অতীব উদ্বেগজনক।
জ্ঞানত কেবলমাত্র বিদেশি নাগরিক হওয়ার সন্দেহে মানুষকে আটক করার নিদর্শন স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে পাওয়া যায় না। ভারতের কোনও আইন শুধুমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে তথাকথিত বিদেশিদের আটকে রাখার অনুমতি দেয় না। ১৯৪৬-এর বিদেশি আইনের (ফরেনার্স অ্যাক্ট ১৯৪৬, ৩(২)(ছ) ধারা, কোনও নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই আটক রাখার অনুমতি দেয়, কিন্তু সন্দেহভাজন বিদেশি বলে সেখানে কিছু বলা নেই। অর্থাৎ এই সরকারি নির্দেশিকা এক অর্থে বেআইনি। তা ছাড়া, এটি প্রশাসনকে বিশাল বিচারক্ষমতা প্রদান করে, যা কিনা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতির পরিপন্থী।
বিভিন্ন মহলের প্রশ্ন: হঠাৎ কেন এই যাচাইকরণ? অনেকেই একে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন ও বিজেপির মেরুকরণের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন। আবার কেউ মনে করেন যে, এতে তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ের সম্ভাবনা বাড়ে, অর্থাৎ এটি বিজেপির ভুল। যদিও এই সংযোগগুলি বেশ বাস্তব, এই যাচাই প্রচেষ্টাকে শুধু নির্বাচনী রাজনীতির প্রতিফলন হিসেবে দেখা ভুল হবে। এটি শ্রমজীবী মানুষ, মুসলমান সম্প্রদায় এবং হিন্দিভাষী অঞ্চলের বাইরের ভাষাগত গোষ্ঠীগুলির অধিকারের উপর হিন্দুত্ব রাজনীতির সামগ্রিক আক্রমণেরই অংশ। অর্থাৎ, যে সম্প্রদায়গুলিকে হিন্দুত্ববাদী শক্তি এখনও নিজের অধীনে আনতে অক্ষম, তাদের উপর এক ধরনের হামলা।
অ-বিজেপি সরকারগুলির বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণের পাশে বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে বসবাসকারী ওই সব রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষদের বিজেপি সরকার ক্রমাগত হয়রান করে চলেছে। উদাহরণ দিল্লি ও সংলগ্ন গুরুগ্রাম-নয়ডা থেকেই পাওয়া যায়। কিছু বছর ধরে ভিন্নমতাবলম্বী অঞ্চল ও সম্প্রদায়ের পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘর বুলডোজ়ার দিয়ে ভাঙা, ভোটার লিস্ট থেকে তাঁদের নাম কাটা, তাঁরা বাংলাভাষী হলে নির্বাসনের হুমকি দেওয়া— এই করে চলেছে বিজেপি।
২০২৩ সালে জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের আগের মাসগুলিতে শ্রমিকবস্তি ধ্বংসের গতি বৃদ্ধি পায়। তখন দিল্লিতে আপ সরকার, আর কেন্দ্রে মোদী সরকার। বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের নানা সংস্থা, যেমন ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ (এএসআই), রেলওয়ে, দিল্লি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ডিডিএ) ইত্যাদি, এই ধ্বংসলীলা চালায়। হাউজ়িং অ্যান্ড ল্যান্ড রাইটস নেটওয়ার্ক-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০২৩ সালে সারা দেশে ৫ লক্ষ বস্তি উচ্ছেদের ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে ২.৮ লক্ষ ঘটনাই ঘটে দিল্লিতে। উচ্ছেদ হওয়া মানুষের বেশির ভাগই বিধিসম্মত পুনর্বাসন পাননি, যদিও দিল্লি সরকারের নিয়ম বলে, সরকার স্বীকৃত বস্তির মানুষদের পুনর্বাসন না দিয়ে উচ্ছেদ করা যাবে না।
এই বছরের শুরুতে দিল্লি রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাজ্য জুড়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়েছে। নতুন সরকারের প্রথম চার মাসে ৮টি এলাকায় বুলডোজ়ার চলে এবং প্রায় ৩০,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হন। এই বাস্তুচ্যুত মানুষদের বর্ণ ও ধর্মীয় জনসংখ্যার বিস্তারিত হিসাব না থাকলেও, একটি নকশা স্পষ্ট। দিল্লিতে যে ৫৭ লক্ষ মানুষ বস্তিতে থাকেন, তাঁরা মূলত মুসলমান, দলিত, অনগ্রসর বর্ণ গোষ্ঠী এবং যাযাবর সম্প্রদায়ের মানুষ। এঁরা দিল্লির জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ, এবং এঁদের সম্মিলিত ভোটের ভাল জোর আছে। প্রথমে কংগ্রেস এবং তার পর কেজরীওয়ালের আপ-এর সঙ্গে এই বস্তিগুলির গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এদের ভোট ও লোকবল এক সময় এই দলগুলিকে দিল্লিতে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করে। ক্ষমতাসীন-বিরোধী মনোভাব এবং অন্যান্য কারণের সংমিশ্রণে এঁদের একটি অংশ ২০২৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে ভোট দেন, যার ফলে নির্বাচনটি বিজেপির পক্ষে ঝুঁকে পড়ে, কিন্তু বিজেপি এঁদের বিশ্বস্ত ভোটার হিসাবে গণ্য করে না।
আপ ও কংগ্রেস দুই দলই এই অংশের সমর্থনের সিংহভাগ এখনও ধরে রেখেছে এবং বিজেপি তা জানে। এই এলাকাগুলিতে নানা জাতি ও ধর্মের মানুষ মিলেমিশে থাকেন। বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতির আবেদন এঁদের কাছে সীমিত। আবার অন্য দিকে, বিজেপির মুখে আপের ভর্তুকি ও কল্যাণবাদের সমালোচনাও এঁরা পছন্দ করেন না। বুলডোজ়ার রাজ এঁদের রাজনৈতিক ভাবে দমন করার এবং শহুরে জমি বড় পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার এক পদ্ধতি। ঘর ভাঙার সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের ফর্ম ৭ ব্যবহারের মাধ্যমে অনেককে ভোটার তালিকা থেকে বার করে দেওয়া হয়েছে।
তীব্র প্রতিরোধে এই ধংসলীলা সাময়িক ভাবে স্থগিত হলেও ২০ জুন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী রেখা গুপ্ত জানান যে, মুম্বইয়ের ধারাভির পুনর্নির্মাণ মডেল শীঘ্রই দিল্লিতে গৃহীত হবে, যা এই ধ্বংসযজ্ঞের পথ আরও প্রশস্ত করবে। ধারাভি মডেল একটি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেল, যার সঙ্গে আদানি গ্রুপ জড়িত। এই আদানি প্রমুখ প্রাইভেট ডেভলপারদের সুবিধার্থে বিশাল রিয়াল এস্টেটের দরজা খুলে দিচ্ছে। অন্য দিকে, দরিদ্ররা হচ্ছেন গৃহচ্যুত; ব্যাহত হচ্ছে তাঁদের জীবিকা, ধ্বংস হচ্ছে এঁদের সামাজিক জীবন।
দিল্লি-গুরুগ্রামের ঘটনা ব্যতিক্রম নয়। মুম্বই, আমদাবাদ, জয়পুর, সুরাত, খরগোন, প্রয়াগরাজ, লখনউ ইত্যাদি বিজেপি-শাসিত উত্তর ও পশ্চিম ভারতের নানা শহরে চলছে বুলডোজ়ার লীলা এবং নাগরিকতা যাচাইয়ের কার্যধারা। নাগরিকতার পরীক্ষা গুরুগ্রামের মতো বড় আকার না নিলেও, এই সব শহর থেকে বাঙালি গ্রেফতারের খবর আসতেই থাকে।
বিহারের এসআইআর। অসমের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল। এ বারের নাগরিকতা যাচাই ও বুলডোজ়ার ধ্বংসলীলা। এক সঙ্গে মিলে শ্রমিক শ্রেণি এবং রাজনৈতিক ভাবে অ-বিজেপি সম্প্রদায়ের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করার ত্রিমুখী কৌশল। এগুলি ক্রমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করলে ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে যেতে পারে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)