সম্প্রতি ভারতীয় বন সর্বেক্ষণ দেশের বন সম্পর্কে তাদের দ্বিবার্ষিক রিপোর্ট ২০২৩-এ জানিয়েছে, ভারতে ‘ফরেস্ট কভার’ বা ‘বন আচ্ছাদন’ নাকি বেড়েছে। এ বছর ‘ফরেস্ট কভার’ ২০২১ সালের চেয়ে মাত্র ১৫৬ বর্গকিমি বেড়েছে, অন্য দিকে ‘ট্রি কভার’ বা ‘গাছ আচ্ছাদন’ বেড়েছে ১২৮৯ বর্গকিমি। প্রশ্ন হল, সত্যিই কি বনের বৃদ্ধি হয়েছে, না কি এগুলো পরিসংখ্যানের কারসাজি? এই বনবৃদ্ধি কতটা কার্বন প্রতিরোধে সক্ষম?
গত দু’বছরে ৩৯১৩ বর্গকিমি ঘন জঙ্গল— গোয়ার থেকেও বড় এলাকা— নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আবার গত দুই দশকে ১৫,৫৩০ বর্গকিমি অ-বনভূমি ও খুব কম বনভূমি এলাকা ঘন জঙ্গল ও খুব ঘন জঙ্গল এলাকাতে পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এত কম সময়ের মধ্যে প্রাকৃতিক জঙ্গল তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। তাঁদের মতে, প্রাকৃতিক জঙ্গল ধ্বংসের ক্ষতি পূরণ করা হয়েছে এক বা দুই প্রজাতির গাছ লাগিয়ে। ‘বন আচ্ছাদন’ বা ‘গাছ আচ্ছাদনের’ সংজ্ঞা লক্ষ করলেই বনবৃদ্ধির ব্যাপারটা বোঝা যাবে। ভারতে ‘বন আচ্ছাদন’ হল যে কোনও মালিকানা ব্যতিরেকে এক হেক্টর ও তার বেশি এলাকার শতকরা ১০ ভাগ আচ্ছাদিত গাছের ভূমি। অন্য দিকে, ‘গাছ আচ্ছাদন’ বলতে এক হেক্টর ও তার কম বন এলাকা বোঝায়। শতকরা ৪০ ভাগ বা তার বেশি আচ্ছাদিত গাছের ভূমি এলাকাকে ধরা হয় ঘন জঙ্গল। বনভূমির দ্বিবার্ষিক মূল্যায়নে স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহারে খুব ছোট এলাকার (এক হেক্টরেরও কম) সবুজ জমিও ধরে ফেলে। ওই ভূমি বাস্তবে বন কি না, তা যাচাই না করেই বন হিসাবে ধরা হচ্ছে। ২০২৩ রিপোর্টে স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করার ফলে অল্প কিছু গাছ-সহ ছোট এলাকা, এমনকি শহরের সবুজ এলাকাকেও বন হিসাবে ধরা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, রাস্তার ধারের গাছ, বড় সরকারি সবুজ জমি, সংসদের আশেপাশের সবুজ এলাকা বা নারকেল, কফি, রবার গাছের প্লান্টেশনকেও বনভূমি ধরা হয়েছে। জমিতে তথ্য মিলিয়ে না দেখলে স্যাটেলাইট দিল্লির মোগল গার্ডেন্স বা নিউ টাউনের ইকো পার্ককেও ‘বন’ বলে দিতে পারে। ফরেস্ট কভারের সংজ্ঞাতেই নারকেল, কফি, রবার বাগান বা বাঁশঝাড়কে ধরা হয়েছে, অথচ সেগুলো মূলত বাণিজ্যিক প্লান্টেশন, জৈববৈচিত্রপূর্ণ জঙ্গল নয়। নথিভুক্ত বনের আওতার বাইরে প্লান্টেশনের মাধ্যমে ফরেস্ট কভার বাড়ানো হচ্ছে।
সংশোধিত বন সংরক্ষণ আইন ২০২৩ বেসরকারি উদ্যোগকে নথিভুক্ত বনের আওতার বাইরে বাণিজ্যিক প্লান্টেশনে উৎসাহ দিচ্ছে। ২০২৩ সাল থেকে অসমে সরকারের সহায়তায় একটি বেসরকারি সংস্থা ৩,৭০,০০০ হেক্টর জমিতে পাম তেল প্লান্টেশন শুরু করে দিয়েছে। এ দিকে পাম তেল প্লানটেশন শুধুমাত্র জৈববৈচিত্র নষ্ট করে না, এটা মাটির গুণাগুণকে নষ্ট করে দেয়। ফলে ওই জমি পুনরায় ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে।
রিপোর্ট বলছে, পরিবেশগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ‘ইকো সেন্সিটিভ জ়োনস’ ও ম্যানগ্রোভ অঞ্চলেও বন আচ্ছাদন কমেছে। সারা ভারতে ম্যানগ্রোভের অঞ্চল ২০২১ সালের তুলনায় ৭.৪৩ বর্গকিমি কমেছে। সবচেয়ে বেশি কমেছে গুজরাতে, যার পরিমাণ ৩৬.৩৯ বর্গকিমি। পশ্চিমবঙ্গে ঘন ম্যানগ্রোভ জঙ্গল প্রায় একই আছে। শুধুমাত্র ২০১৭-২০১৮ সালেই ৪৯৬ বর্গকিমি বনভূমি নষ্ট করা হয়েছে উন্নয়নের নামে। তথ্য বলছে, শুধুমাত্র খননকার্য ও তাপবিদ্যুতের জন্য ৪.৪ লাখ হেক্টর বনভূমি ব্যবহার হচ্ছে। বনভূমি যেটুকু বৃদ্ধি হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে, তা মূলত নষ্ট বনভূমি বা ‘ডিগ্রেডেড ল্যান্ড’। ভাল বনভূমি বৃদ্ধি পায়নি। মূলত বাণিজ্যিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ ইউক্যালিপটাস, অ্যাকাসিয়া বা রবার দিয়ে পুনর্বনায়ন করা হচ্ছে। অর্থাৎ একই রকম প্রজাতির বন তৈরি করা হচ্ছে।
প্রাকৃতিক জঙ্গল ধ্বংস জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। একটি হিসাব অনুযায়ী, ‘মোনোকালচার’ প্লান্টেশনের কার্বন ধরে রাখার ক্ষমতা প্রাকৃতিক বন বা জঙ্গলের তুলনায় মাত্র আড়াই শতাংশ। এবং কৃষিবনের ক্ষমতা জঙ্গলের ক্ষমতার সাত ভাগের এক ভাগ। জৈববৈচিত্র বাতাসের কার্বন শোষণে স্বল্পমূল্যে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে। পৃথিবীর উষ্ণায়ন ১.৫ ডিগ্রির নীচে রাখতে গেলে বছরে ২ লক্ষ কোটি টন কার্বন ধরে রাখার ক্ষমতাসম্পন্ন জঙ্গল প্রয়োজন, কিন্তু ‘মোনোকালচার’ প্লান্টেশনের দ্বারা মাত্র ১৬০০ কোটি টন কার্বন ধরে রাখা যাবে। ফলে যে বাণিজ্যিক প্লান্টেশনের দ্বারা ফরেস্ট কভার বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে, তা কার্যকর ‘কার্বন সিঙ্ক’ নয়।
জঙ্গলের গুণগত মানকে গুরুত্ব না দিয়ে ‘ফরেস্ট কভার’ বাড়ানোর প্রয়াস আসলে প্যারিস জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি পালন ও কার্বন ক্রেডিট থেকে প্রচুর টাকা রোজগার করার প্রচেষ্টা। কমিউনিটি ল্যান্ড বা সমষ্টিগত জঙ্গলকে বেসরকারি পুঁজির হাতে তুলে দিয়ে বাণিজ্যিক প্লান্টেশনকে উৎসাহ দেওয়া এবং ফরেস্ট কভার বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় কোনও ভাবেই ‘কার্বন সিঙ্ক’ তৈরির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব নয়। এই পদ্ধতি এক দিকে যেমন জলবায়ু পরিবর্তনে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারছে না, বনক্ষয়ের প্রবণতা বাড়াচ্ছে, অন্য দিকে জৈববৈচিত্রহীন প্লান্টেশন জঙ্গলের উপরে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর জীবনধারণও দুর্বিষহ করছে।
ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)