গত ৭ অগস্ট সাংবাদিক সম্মেলনে রাহুল গান্ধী কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন (ইসিআই)-এর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন— শাসক দল বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে কমিশন গত লোকসভা ভোটে হেরফের করেছে। কর্নাটকে দশ লক্ষেরও বেশি ভুয়ো ভোটের ‘প্রমাণ’ হিসাবে তুলে ধরেছেন জাল ভোটার, ভুয়ো ঠিকানা, বাতিল ছবি। এরই জেরে নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা, বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নে আবারও ধাক্কা খেয়েছে নির্বাচন কমিশন।
মনে রাখা দরকার, জাতীয় নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে এ-হেন পক্ষপাতের অভিযোগ নতুন নয়। গত এক দশকে অনেক রাজনৈতিক দল ও নাগরিক গোষ্ঠী উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নানা বিষয়ে: ইভিএমে হেরফের, ভোটের সময়সূচি পরিবর্তন, ভোটার-তথ্যে অস্বচ্ছতা। ২০১৪-র সাধারণ নির্বাচন ইস্তক কথা উঠছে ইভিএমের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে— বিরোধী নেতাদের মধ্যে অনেকেই আঙুল তুলেছেন ইভিএম হ্যাক হওয়ার আশঙ্কার দিকে, দাবি করেছেন ব্যালট ফেরানোর। ভিভিপ্যাট চালু করা হলেও ঝঞ্ঝাট এড়ানো যায়নি। অনেক নির্বাচনী এলাকায় ভিভিপ্যাট ও ইভিএমের ভোট-গণনায় গরমিলের খবর এসেছে, তেমন কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি।
কমিশনের ভোটের সময়সূচি শাসক দলের নির্বাচনী প্রচারের সুবিধা করে দিচ্ছে, এই সমালোচনাও কম হয়নি। গত দু’টি লোকসভা ভোটেই বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, কমিশন এমন ভাবে নির্বাচনসূচি ঘোষণা করছে যাতে আদর্শ নির্বাচনবিধি চালু হওয়ার ঠিক আগে প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ প্রচার-র্যালিগুলো হয়ে যায়। ২০২৪-সহ আগের অনেক নির্বাচনেই দেখা গিয়েছে ভোটের শেষ প্রহরে অভূতপূর্ব ভোটার-উপস্থিতি। মহারাষ্ট্র ও পশ্চিমবঙ্গে ভোট দেওয়ার সময় পেরিয়ে গেলে দেখা গেছে, এমন ভোটার-উপস্থিতি বেড়েছে ১০-১২ শতাংশ। যে আসনগুলোয় সমানে-সমানে লড়াই, সেখানে ভোট পড়ার ঘোষিত সংখ্যাকে এই পরিস্থিতিতে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা চলে কি? কমিশনও এর স্বচ্ছ, যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা বা রিয়াল-টাইম নির্বাচনী তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে। লোকের বিশ্বাস তো কমবেই! যত ভোট পড়েছে, গণনায় পাওয়া গেছে তার চেয়েও বেশি ভোট— এমন ঘটনাও ঘটেছে।
এ ধরনের মারাত্মক ব্যাপার তো কোনও মতেই মেনে নেওয়া যায় না। নির্বাচন কমিশন কিন্তু একে স্রেফ ‘গণনার ভুল’ বলেই খালাস। ভোট গণনার মতো স্পর্শকাতর প্রক্রিয়ায় এ-হেন ভুলের জের অনেক সময় সাংঘাতিক হয়ে দাঁড়ায়। ২০২২-এর বিধানসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের কিছু নির্বাচনী এলাকায় স্বাধীন পর্যবেক্ষকেরা এ ধরনের অসঙ্গতি নজরে এনেছিলেন, কিন্তু দ্বিতীয় বার নির্বাচন বা গণনা, কোনওটাই হয়নি।
এখন ব্যাপক হইচই প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক ও নথিভুক্ত ভোটারের সংখ্যায় গরমিল নিয়ে। অনেক নির্বাচনী এলাকায় এই ফাঁকটি ব্যাখ্যাহীন: তালিকায় অনেক ভোটারের নামই নেই, আবার ভুয়ো ভোটারদের নাম জ্বলজ্বল করছে। কর্নাটকের মহাদেবপুরায় এক লক্ষেরও বেশি ভুয়ো ভোটারের অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ উঠেছে; একই ভোটারের নাম তালিকায় একাধিক বার, আছে ভূতুড়ে ভোটারও। এই বিষয়টিতে নজর দেওয়া না হলে সর্ষের মধ্যে ভূতের উপস্থিতি নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধতে বাধ্য।
নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ পদ্ধতির সাম্প্রতিক সংশোধনও চিন্তা উদ্রেক করার মতো। আগে এই নিয়োগ হত কলেজিয়াম-এর মাধ্যমে, সেখানে থাকতেন প্রধানমন্ত্রী, ভারতের প্রধান বিচারপতি ও বিরোধী দলের প্রধান। সম্প্রতি আইনি পরিবর্তন করে প্রধান বিচারপতিকে বাদ দেওয়া হয়েছে, মানে কমিশনার নিয়োগে এখন শাসক দলেরই একচ্ছত্র ক্ষমতা। ইসিআই-এর স্বাধীনতাই এতে প্রশ্নের মুখে পড়বে। পদে-পদে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কাও থাকছে।
বিহারে নভেম্বরে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে এই এসআইআর-এর জেরে সংসদ অচল হয়েছে। বিরোধীরা বার বার এ নিয়ে বিতর্ক আহ্বান করেছেন, সরকার আলোচনা এড়িয়েই যাচ্ছে। যতই বলা হোক ‘ডুপ্লিকেট’ ও অযোগ্য ভোটার বাছতেই এই সংশোধন, সন্দেহ নেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে প্রান্তিক, সংখ্যালঘু ও গ্রামীণ মানুষকে বিপাকে ফেলাই এর লক্ষ্য। ভোটার তথ্য যাচাইয়ে কমিশন চাইছে পাসপোর্ট, জন্মের শংসাপত্র, কাস্ট ও রেসিডেন্স সার্টিফিকেট ইত্যাদি, গ্রামীণ ও অল্প-রোজগেরে মানুষদের পক্ষে যা জোগাড় করা মুশকিল, প্রায় অসম্ভব। আধার বা রেশন কার্ড, কমিশনেরই ‘এপিক’ পরিচয়পত্র নেওয়া হচ্ছে না। কমিশন-স্বীকৃত এপিক যদি কমিশন নিজেই প্রত্যাখ্যান করে, তা কি তার কর্তৃত্ব ও মর্যাদারই হানি নয়?
এসআইআর-মডেল এ বার অন্য রাজ্যেও চালু করার কথা হচ্ছে। কড়া নজর না দিলে নানা বিধানসভা ও লোকসভা ভোটের আগে বিহার মডেলেই ভোটার বাতিলের কাজ চলতে পারে। প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত্তি, নথি যাচাইয়ের নামে তার অস্বীকৃতি সেই অধিকারের চরম লঙ্ঘন। গণতন্ত্রের ঘোর বিপদ আজ এ দেশে।
সাধারণ সম্পাদক, অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লক কেন্দ্রীয় কমিটি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)