E-Paper

কোন আইন, কিসের যুক্তি

১৯৫০ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আইনের ২১(১) ও ২১(২) ধারা অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচন অথবা কোনও উপনির্বাচনের আগে নির্বাচনী কেন্দ্রের ভোটার তালিকা সংশোধন করে।

প্রসেনজিৎ বসু

শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০২৫ ০৫:০২
উদ্যোগপর্ব: বিহারের নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকার বিশেষ সংশোধন কার্যক্রম শুরু, বৈশালী, ৪ জুলাই।

উদ্যোগপর্ব: বিহারের নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকার বিশেষ সংশোধন কার্যক্রম শুরু, বৈশালী, ৪ জুলাই। ছবি: পিটিআই।

ভারতের নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ভোটার তালিকার স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়া বিধানসভা ভোটের আগে বিহারে ২৫ জুন থেকে শুরু হয়ে গেছে। কমিশনের নির্দেশ, ভোটার তালিকার বিশুদ্ধতা রক্ষার উদ্দেশ্যে এই প্রক্রিয়া ক্রমে সমগ্র দেশেই চালানো হবে।

কমিশন আরও জানিয়েছে, ১৯৫২ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে বিভিন্ন রাজ্যে মোট ১৩ বার এমন নিবিড় সংশোধন হয়েছে; বিহারে শেষ বার এমন সংশোধন হয়েছিল ২০০৩ সালে। কিন্তু ২০২৫-এর এই নিবিড় সংশোধনী প্রক্রিয়ায় বিএলও বা বুথ স্তরের আধিকারিকরা প্রত্যেক ভোটারের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাগরিকত্ব যাচাই করছেন। অসম ও জম্মু-কাশ্মীর ব্যতীত ভারতের অন্যান্য রাজ্যে এ-হেন ভোটার তালিকা সংশোধন প্রক্রিয়া অভূতপূর্ব।

এই প্রক্রিয়ার আইনি ভিত্তিটিই সন্দেহজনক। ১৯৫০ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আইনের ২১(১) ও ২১(২) ধারা অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচন অথবা কোনও উপনির্বাচনের আগে নির্বাচনী কেন্দ্রের ভোটার তালিকা সংশোধন করে। এই ধারায় নির্বাচন কমিশনকে যে কোনও বছরেই ভোটার তালিকা সংশোধনের অধিকার দেওয়া আছে। এই আইনের ২১(৩) ধারা অনুযায়ী, কমিশন যে কোনও সময়ে কোনও কেন্দ্র বা তার অংশবিশেষে, কারণ দেখিয়ে, ‘বিশেষ সংশোধন’-এর নির্দেশ দিতে পারে। কিন্তু ‘নিবিড়’ সংশোধনের কথা আইনের কোথাও লেখা নেই।

নির্বাচন কমিশনের ২৪ জুনের প্রেস বিবৃতিতে এই বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে দ্রুতগামী নগরায়ণ, ক্রমাগত অভিবাসন, নতুন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার প্রাপ্তি, মৃত ব্যক্তিদের নাম তালিকায় থেকে যাওয়া এবং বিদেশি অনুপ্রবেশকারীদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়াকে কারণ হিসাবে দেখানো হয়েছে। বাস্তবে এর প্রতিটিই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা গত সাত দশক ধরেই নির্বাচন কমিশন নিয়মিত করে এসেছে। এর জন্য দেশ জুড়ে কোনও বিশেষ নিবিড় সংশোধনী প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয়নি।

একমাত্র নতুন যুক্তি, ‘বিদেশি অনুপ্রবেশকারী’দের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি। অথচ বিহারে বা জাতীয় স্তরে ভোটার তালিকায় বিশাল সংখ্যক বিদেশিদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, এমন প্রমাণ কিন্তু নির্বাচন কমিশন দেখায়নি। এ বিষয়ে কিছু রাজনৈতিক দল গুজব ছড়ায় ঠিকই, কিন্তু সাংবিধানিক গণতন্ত্রে সরকারি প্রক্রিয়া আইন এবং তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে চলা উচিত— গুজব বা রাজনৈতিক অপপ্রচারের ভিত্তিতে নয়।

গত ২৫ জুন থেকে বিহারে ৯৮,৪৯৮ জন বিএলও বা বুথ স্তরের আধিকারিক ৭.৮৯ কোটি ভোটারের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছেন। প্রত্যেককে একটি ছাপানো ‘এনুমারেশন ফর্ম’ দেওয়া হচ্ছে, যা পূরণ করে ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে জমা দিতে হবে। পূরণ করা ফর্ম ও প্রয়োজনীয় নথিসমেত হয় বিএলও-র মাধ্যমে বা নিজেকেই ইসিআইনেট পোর্টালে আপলোড করতে হবে।

যাঁরা সময়সীমার মধ্যে ফর্ম ও নথি জমা দিতে পারবেন না, ১ অগস্ট তারিখে খসড়া ভোটার তালিকা থেকে তাঁদের নাম বাদ পড়বে। এক বার বাদ পড়ে গেলে অগস্ট মাসের মধ্যে নতুন ভোটারের অন্তর্ভুক্তির ফর্ম ভরে নথি-সহ জমা করতে হবে, যার সময়সীমা ১ সেপ্টেম্বর।

এই ফর্মের সঙ্গে যে নথি জমা দিতে হবে, সেটাই সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়। প্রত্যেক ভোটারকে নিজের জন্মের তারিখ ও জন্মস্থানের প্রমাণ দেখাতে হবে। যাঁরা ১ জুলাই ১৯৮৭ থেকে ২ ডিসেম্বর ২০০৪-এর মধ্যে জন্মেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে শুধু নিজের নয়, সঙ্গে বাবা অথবা মায়ের কোনও এক জনের জন্মতারিখ ও ভারতে জন্মানোর প্রমাণ জমা দিতে হবে। ২ ডিসেম্বর ২০০৪-এর পরে জন্ম হলে, পিতামাতা উভয়ের তথ্যপ্রমাণ জমা দিতে হবে।

এই শর্তাবলির মাধ্যমেই স্পষ্ট যে, নির্বাচন কমিশন আসলে ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন অনুযায়ী প্রত্যেক ভোটারের নাগরিকত্ব যাচাই করতে চাইছে। কমিশনের ২৪ জুনের নির্দেশিকায় নির্বাচনী নিবন্ধন আধিকারিকদের উদ্দেশে বলা হয়েছে যে, কোনও ভোটারকে ‘বিদেশি’ সন্দেহ হলে তাঁরা যেন নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি রেফার করেন।

২০০৩ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের সাংবিধানিকতা এখনও সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। এই বিতর্কিত সংশোধনী আইনে উদ্বাস্তু সমেত বৈধ কাগজ নেই এমন সকল অভিবাসীকে ‘ইললিগাল মাইগ্র্যান্ট’ বা অনুপ্রবেশকারীর সংজ্ঞা দেওয়া হয়। এমনকি তাঁদের সন্তানদের ২০০৪-এর ডিসেম্বরের পরে ভারতে জন্ম হলেও জন্মসূত্রে ভারতের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়।

জনসংখ্যা রেজিস্টার বা এনপিআর থেকে সন্দেহভাজনদের নাম বাদ দিয়ে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি চালু করার সূত্রপাত এই সংশোধনী আইনের মাধ্যমেই হয়। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে এই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের নোটিফিকেশন হওয়ার অনেক আগে, ২০০৩ সালে এই আইনের নিয়মাবলি বা সিটিজ়েনশিপ রুলস-এর বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছিল। এই গোলমেলে আইন আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। অসম রাজ্যে এনআরসি প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ২০১৯ সালে সারা দেশে নাগরিকপঞ্জি চালু করতে চাইলেও দেশব্যাপী প্রতিবাদ এবং গণতান্ত্রিক প্রতিরোধের মুখে সেটা স্থগিত করতে বাধ্য হয়।

কিন্তু একটি বিতর্কিত ও এখনও কার্যকর না হওয়া আইনের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন কী ভাবে একটি রাজ্যের ভোটার তালিকাভুক্ত সমগ্র নির্বাচকমণ্ডলীর নাগরিকত্ব যাচাই করতে পারে? বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে, রাজনৈতিক দলসমূহ বা ভোটারদের সঙ্গে কোনও রকম আলাপ-আলোচনা না করে, আচমকাই এমন প্রক্রিয়া শুরু করে দেওয়া হল কী করে? নির্বাচন কমিশনের মতো বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কাছে এটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত।

আইনি প্রশ্ন ছাড়াও আছে বাস্তবায়নের বিশাল সমস্যা। বিহারের মতন একটি বৃহৎ রাজ্যের পরিসরে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার মতো পরিকাঠামো নির্বাচন কমিশনের আদৌ আছে কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। বিহারে ৭.৮৯ কোটি ভোটারের নাগরিকত্ব যাচাই করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য মোটে ৬৮ দিনের সময়সীমা ধার্য করা হয়েছে।

অথচ, ২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের আদেশের পর অসম রাজ্যের এনআরসি প্রক্রিয়ায় ৩.৩ কোটি আবেদনপত্র অনলাইনে জমা করতে সময় লেগেছিল ৯০ দিন। সমস্ত নথি যাচাই করে চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি তৈরি করতে লেগে যায় চার বছর। এর পর ২০১৯ সালের অগস্টের শেষে চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি প্রকাশিত হলে অসম সরকার সেটা ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বলে প্রত্যাখ্যান করে। ১৬০০ কোটি টাকার সরকারি ব্যয় পুরোটাই জলে যায়। বিহারের ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়ার ফলাফল একই রকম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর নির্বাচন কমিশন বিহারের ২৪৩ বিধানসভা কেন্দ্রে ছড়িয়ে থাকা নাগরিকদের মধ্যে কেএপি-এন্ডলাইন সার্ভে নামের একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। সেই সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী, ৪১,৯১৩ জন উত্তরদাতার মধ্যে কেবলমাত্র ২৭ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক স্তর বা তার বেশি। এঁদের মধ্যে ৩৩ শতাংশ নিরক্ষর, ৪১ শতাংশ মোবাইলেও ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না, ২৯ শতাংশ টিভি দেখেন না, এবং ৫৩ শতাংশ খবরের কাগজ পড়েন না।

বিহারের নির্বাচকমণ্ডলীর বৃহৎ অংশই অতি অনগ্রসর বা তফসিলি জাতির দরিদ্র চাষি বা দিনমজুর, যাঁদের পক্ষে ভোটার তালিকার বিশেষ সংশোধনের জটিল প্রক্রিয়ায় নাগরিকত্ব প্রমাণ করা শুধু কঠিনই নয়, দুঃসহ।

ফর্ম এবং নথি জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে অধিকাংশ ভোটারকেই নির্ভর করতে হবে বিএলও-দের উপর। এই বিএলও-রা কোনও ভুল করলে তার ফল ভোগ করতে হবে ভোটারদের। ৩০ দিনের মধ্যে প্রত্যেক বিএলও-কে গড়ে প্রায় ৮০০ জন ভোটারের ফর্ম জমা করতে হবে, তার ফলে প্রচুর ভুল হওয়া স্বাভাবিক। আর ১ অগস্টে প্রকাশিত হওয়া খসড়া তালিকায় যদি বড় সংখ্যক ভোটারের নাম বাদ পড়ে যায়, তা হলে প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচন আধিকারিকদের উপর নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্তির অত্যধিক চাপ পড়বে।

আরও বড় সমস্যা ভোটারদের অভিবাসন— উত্তরপ্রদেশ এবং বিহার থেকেই সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ অন্য রাজ্যে কাজ করতে যান। বিহার সরকারের ২০২২-এর জাতিভিত্তিক সমীক্ষা অনুযায়ী, বিহারের মোট ১৩.০৭ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৫৩.৭ লক্ষ, অর্থাৎ প্রায় ৪% মানুষ রাজ্যের বাইরে থাকেন। এঁদের অনেকেই সময়মতো নথি দিতে বা অনলাইনে ফর্ম জমা করতে পারবেন না।

২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিহারে মাত্র ৫৬ শতাংশ ভোট পড়েছিল, যেখানে জাতীয় স্তরে ভোটদানের গড় হার ছিল ৬৬%। বিহারের ভোটদানের হার সব সময়েই অন্যান্য বড় রাজ্যের তুলনায় কম। ভোটারদের সচেতন করে ভোটদানের হার বাড়ানোর বদলে নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকার সংশোধনের নামে ভোটারের সংখ্যা বড় মাত্রায় কমিয়ে দিলে সেটা গণতন্ত্রকে দুর্বলই করবে। সেটাই কি কাম্য?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Election Commission of India bihar election

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy