নির্বাচনী উৎসবের নানা কর্মকাণ্ড থাকে, তার মধ্যে নতুন নতুন কর্মসূচির সূচনা অন্যতম। অগস্টের প্রথম সপ্তাহেই রাজ্যে শুরু হয়েছে ‘আমাদের পাড়া, আমাদের সমাধান’। রাজ্যে নেতা-মন্ত্রী ও আমলাদের মধ্যে এক ধরনের ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে। দিনের শেষে পাড়ায় কত লক্ষ টাকার সমস্যার সমাধান হয়েছে, তার এক দীর্ঘ ফিরিস্তি প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রকল্পের নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে— চোদ্দো বছরের উন্নয়নের জোয়ারে এখনও পাড়ায় কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে, রাজ্যের প্রায় আশি হাজার বুথে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। এই প্রকল্পের ঘোষিত উদ্দেশ্য— ধামাচাপা পড়ে থাকা স্থানীয় কিছু সমস্যার দ্রুত সমাধান। আসলে এই ছাইচাপা আগুনের তেজ কতটা, তা মেপে নিতেই এই প্রকল্প।
গত তিনটি মেয়াদে রাজ্য সরকার নানা ধরনের জনকল্যাণমূলক, বিশেষ করে সরাসরি নগদ সহায়তা প্রকল্পে— যেমন কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডার, স্বাস্থ্য সাথী— জোর দিয়েছে। এই প্রকল্পগুলিকে কেন্দ্র করে এসেছে অভাবনীয় নির্বাচনী সাফল্য। তবে একই সময়ে গ্রামাঞ্চলের রাস্তা, জল জমে থাকা, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় এলাকা পুনর্গঠন বা নদীভাঙনের মতো কিছু পরিকাঠামোগত সমস্যার সমাধান অধরাই থেকে গেছে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি অনেক সময় ধামাচাপা পড়ে যায়। বেশির ভাগ সমস্যাই লাল ফিতের ফাঁসে আটকে থাকে।
নতুন এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য— স্থানীয় সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করা, যেগুলো এত দিন মূলধারার প্রকল্পে উপেক্ষিত ছিল। প্রচার করা হচ্ছে, ভারতবর্ষে এই ধরনের প্রকল্প এই প্রথম। তবে এই প্রকল্পের বীজ লুকিয়ে আছে পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থার মধ্যে, যেখানে ভারতের সংবিধানে বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা হয়েছে। এক সময় পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সারা দেশে প্রশংসিত ছিল, কিন্তু এখন তা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
‘আমাদের পাড়া, আমাদের সমাধান’ প্রকল্পের মূল ভাবনা এসেছে গ্রামসভা থেকে, যা ১৯৯২ সালের ৭৩তম সংবিধান সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত। গ্রামসভা এমন একটি জায়গা, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের মতামত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে স্থানীয় সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়, পরিকল্পনা ও বাজেট অনুমোদন হয়, এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জবাবদিহি করতে বাধ্য করা যায়। অথচ গত চোদ্দো বছরে পশ্চিমবঙ্গের একদা প্রশংসিত পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থা কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। বর্তমান সরকারের বেশিরভাগ প্রকল্প বাস্তবায়নে পঞ্চায়েতের ভূমিকা নেই বললেই চলে। তাই পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে খানিকটা পাশ কাটিয়ে, সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মানুষের কাছে পৌঁছনোর জন্য একের পর এক নতুন প্রকল্প এনেছে।
সচেতন নাগরিকদের মনে থাকবে, এর আগে ‘দিদিকে বলো’, ‘সিএমও অভিযোগ কেন্দ্র’, ‘দুয়ারে সরকার’, ‘পাড়ায় সমাধান’— এই ধরনের একাধিক উদ্যোগ করা হয়েছিল। তা হলে এ বার নতুনত্ব কী? ভারতের মতো দেশে, যেখানে অগণিত মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করেন, সেখানে এই ধরনের কল্যাণমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা সমস্যা থাকে। দুর্নীতির দীর্ঘ ছায়াও অনেক ভাল উদ্যোগকে প্রশ্নের মুখে ফেলে, যেমন ফেলেছে বাড়ি তৈরির প্রকল্প, রাস্তা সংস্কার ইত্যাদি নিয়ে। তিন দফায় ক্ষমতায় থাকলে স্বাভাবিক ভাবেই শাসকবিরোধী হাওয়া তৈরি হয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বছর না ঘুরতেই আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন। এই আবহে বর্তমান সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার এক পরীক্ষিত পথেই হাঁটতে চাইছে।
‘রাজা কান দিয়ে দেখেন’— এই পুরনো প্রবাদটি আপ্ত বাক্য হিসাবে মেনে নিয়ে মানুষের কথা শুনতেই মাঠে নেমেছে। চতুর্থ বারের জন্য ক্ষমতার দিকে এগোতে থাকা সরকার জনমতের চাপ স্পষ্ট ভাবে অনুভব করছে। তাই এই প্রকল্প আগামী নির্বাচনের আগে জনমত বোঝার একটি কৌশল হিসাবেই চালু হয়েছে। প্রতীচী ইনস্টিটিউটের গবেষণা বলছে— এই ধরনের প্রকল্পের মাধ্যমে মানুষের মনের কথা সরাসরি শোনা যায় এবং তা নীতিনির্ধারণে সাহায্য করে। যেমন, ‘সিএমও অভিযোগ কেন্দ্র’ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ‘পথশ্রী’, ‘দুয়ারে সরকার’, ‘বাংলা সহায়তা কেন্দ্র’ এই প্রকল্পগুলি পরিকল্পিত ও বাস্তবায়িত হয়েছিল। এর মধ্যে ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্প সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে— মানুষকে তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছে, বহু পুরনো সমস্যা যেমন জাতিগত শংসাপত্রের দ্রুত সমাধান করেছে। এই প্রকল্পে নারীদের যোগদান ছিল উল্লেখযোগ্য। এই প্রকল্প সরকারি জটিলতা কমিয়ে সরাসরি পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টাও করেছে।
তবে প্রশ্ন উঠছে, এই ধরনের ক্যাম্প আয়োজন করতে বিশাল ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হয়, এবং সরকারি অর্থে চাপ পড়ে। তাই খরচ-সুবিধা বিশ্লেষণ জরুরি। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়তো এই যে ‘আমাদের পাড়া, আমাদের সমাধান’ কি সত্যিই গ্রামবাসীদের নিজস্ব সমস্যা তুলে ধরার সুযোগ দেবে? তাঁরা কি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর হিংসার প্রভাব, কর্মসংস্থানের অভাব, বা পাড়ার স্কুলে শিক্ষকের ঘাটতির মতো বাস্তব সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে পারবেন? না কি এই প্রকল্প কেবল সরকার নির্ধারিত বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকবে?
গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শক্তি হল প্রশ্ন করার অধিকার। নীতি রূপায়ণে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার প্রশ্ন তুলতে পারার কাজটা কি এই প্রকল্প পারবে?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)