তবে কি প্যালেস্টাইনের দিকে জনসমর্থন এখন ক্রমশ ঘুরছে? গণমাধ্যমে সমীক্ষা বলছে, গাজ়ার উপর নির্বিচারে ইজ়রায়েলি বোমাবর্ষণকে যাঁরা এত দিন খোলাখুলি বা অনুচ্চারে সমর্থন করছিলেন, ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে মানুষ মরতে দেখে ইজ়রায়েলের প্রতি তাঁদের বিরক্তি ও নিন্দা আর চাপা থাকছে না।
বস্তুত, এই পরিস্থিতিতে ফ্রান্সের প্যালেস্টাইনকে রাষ্ট্রের মর্যাদাপ্রদান ছিল নেহাতই সময়ের অপেক্ষা। গত এপ্রিলে মিশরের গাজ়া সীমান্তে প্যালেস্টাইনিদের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখে আসেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ। তখনই তিনি এমন একটি সিদ্ধান্তের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। যদিও, ফ্রান্সের এই অবস্থানে ইজ়রায়েল ও আমেরিকা যারপরনাই রুষ্ট।
তবে, ফরাসি বামপন্থীরা খুশি। তাঁদের দাবির কাছে প্রেসিডেন্টের নতিস্বীকারের প্রমাণ হিসেবে তাঁরা একে দাখিল করতে চান। তাঁরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক নীতি মেনে দুই রাষ্ট্রের দাবি এতে আরও পোক্ত হবে। তাঁদের আশা, আজ না হোক কাল, ইউরোপের অন্যান্য শক্তিধর দেশ এবং কানাডা অচিরেই ফ্রান্সকে অনুসরণ করবে। এবং যে ইজ়রায়েল প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক আইনকে পদদলিত করছে, তার উপর যুদ্ধ বন্ধের জন্য চাপ তৈরি হবে। অপর পক্ষে, মাকরঁ ইসলামি জঙ্গিবাদের সমর্থক— এই ধুয়ো তুলে ফরাসি উগ্র দক্ষিণপন্থী শিবিরে এখন গেল-গেল রব।
কিন্তু প্রশ্ন হল, যুদ্ধবিধ্বস্ত প্যালেস্টাইন, যার রাষ্ট্রযন্ত্রের কলকব্জা বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, তার পক্ষে কি রাষ্ট্রের দাবিদার হওয়া সম্ভব?
উত্তর হল, এখনই সম্ভব না হলেও ভবিষ্যতেও যে হবে না, জোর দিয়ে তা মোটেই বলা যায় না। তবে অনেকের ধারণা, এর ফলে আন্তর্জাতিক স্তরে প্যালেস্টাইন-বন্ধু শিবিরের কাছে হয়তো ফ্রান্সের মুখ কিছুটা উজ্জ্বল হবে, একতরফা ইজ়রায়েল তোষণের অপরাধ-বোধ থেকে তার হয়তো খানিক নিষ্কৃতি মিলবে। কিন্তু আশঙ্কা এই যে, গাজ়ায় তা আরও বিপদ না ডেকে আনে। ফ্রান্স যত বর্তমান অবস্থানে অনড় থাকবে, গাজ়া আর ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক থেকে প্যালেস্টাইনিদের সমূল উৎপাটন ও ওই অঞ্চলকে নিজ ভূখণ্ডের অঙ্গীভূত করার ব্যাপারে ইজ়রায়েল তত মরিয়া হয়ে উঠবে।
তবে, ভবিষ্যতে যা-ই হোক, ফ্রান্সের পক্ষে প্যালেস্টাইন ও ইজ়রায়েলের দ্বন্দ্বকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। যে হেতু উভয়ের সঙ্গেই তার গাঁটছড়া বহু দিনের। উনিশ শতকে এই ফ্রান্সেই ঘটেছিল সেই ইহুদি-বিদ্বেষী দ্রেফ্যুস কাণ্ড। যে ঘটনার ফলে বেড়ে উঠেছে আজকের এই বিষবৃক্ষ। ইহুদিদের ‘প্রতিশ্রুত দেশ’-এর পৌরাণিক গল্পের চারাগাছ থেকে যাকে পশ্চিম এশিয়ার ঊষর মাটিতে প্রথম রোপণ করা হয়েছিল। তাকে ফুলেফলে ভরিয়ে দিতে চেয়েছিল বিশ্বযুদ্ধোত্তর ফ্রান্স। অবশ্য সেই মরূদ্যান-বিলাস মন থেকে বেশ নির্দয় ভাবেই ঝেড়ে ফেলেছিল পরবর্তী দ্য গোল সরকার। কারণ, উত্তর-ঔপনিবেশিক সে কালখণ্ডে নিপীড়িত আরব জনগোষ্ঠীর মন পাওয়া আরও জরুরি মনে করেছিলেন কর্তারা।
তবে ইজ়রায়েল ও ফ্রান্সে বসবাসকারী ইহুদিদের মধ্যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বন্ধন শুধুমাত্র অটুট থাকাই নয়, পারিবারিক পালাপার্বণের মাধ্যমে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ইজ়রায়েলে ফরাসি-ভাষীর সংখ্যা পাঁচ লক্ষের অধিক, তার মধ্যে এক লক্ষ আবার ফ্রান্সের নাগরিক। অতএব, ফরাসি গণমাধ্যমের উপর ইজ়রায়েলের সরাসরি প্রভাব যথেষ্ট। জেরুসালেম পোস্ট-এর ফরাসি সংস্করণে নিয়মিত ইজ়রায়েলি সরকার ও রাষ্ট্রের মতামত প্রতিফলিত হয়। এ ছাড়া ইহুদিদের আছে বিভিন্ন কমিউনিটি রেডিয়ো।
অন্য দিকে, প্যালেস্টাইনের সঙ্গে ফ্রান্সের গাঁটছড়াটি কেমন? ৯/১১-র ঘটনার পর রেজিস দ্যব্রে একটি লেখায় বলেছিলেন, “এই নিরীহ প্রাণের হত্যাযজ্ঞ আমাদের মধ্যে যে সমব্যথা জাগ্রত করছে তাকে কিন্তু মোটেই নিরীহ বলা যায় না, এবং এই অবিচার আমাদের মধ্যে যে সংহতির জন্ম দিয়েছে, তার মধ্যেও কোথাও একটা অবিচার লুকিয়ে আছে।” দ্যব্রে আসলে পূর্ব ও পশ্চিম— এই দুই সভ্যতার মধ্যিখানে সুগভীর এক ফাটলের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছিলেন। এক দিকে, সম্পদের জোরে একদল লোক নিজেদের রক্তপাত ও যন্ত্রণাকে সবার চোখের সামনে ফলিয়ে মেলে ধরতে, নিজেদের হত্যাগুলিকে নিখুঁত গোপন করতে পারছে। আর অন্য দিকে, পৃথিবীর হতভাগ্যের দল— ‘চুপিচুপি একা-একা’ মরে যাওয়াই যাদের ললাটলিখন।
এইখানে প্যালেস্টাইন এক ব্যতিক্রম। কী ভাবে যেন সে পশ্চিমি ক্যামেরার ফ্রেমে বার বার ঢুকে পড়েছে। এর একটা কারণ ইতিহাস তাকে বাধ্য করেছে ইজ়রায়েলের নিয়তির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিতে। পশ্চিমি গণমাধ্যম পশ্চিম এশিয়ায় ইজ়রায়েলের কাণ্ডকারখানা যত তুলে ধরেছে, প্যালেস্টাইনও তত উন্মোচিত হয়েছে বিশ্বের সামনে। যদিও নিপীড়কের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই উন্মোচনের মধ্যে মিশে আছে গভীর ছলনা। দ্বিতীয় কারণ হয়তো, আরব-ইজ়রায়েল সংঘাতের পিঠে চেপেই বিগত তিন দশক যাবৎ আল-জাজিরার মতো স্যাটেলাইট-বাহিত টিভি চ্যানেলের উত্থান— যারা নিপীড়িতের বাস্তবতাকে এক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুলে ধরছে। তা হয়তো হুবহু নিপীড়িতের দৃষ্টিভঙ্গি নয়, আবার নিপীড়কেরও নয়।
বস্তুত, প্যালেস্টাইন-ইজ়রায়েল সংঘাতের ইতিহাস মোটেই নিরবচ্ছিন্ন নয়। যুদ্ধ-শান্তি-যুদ্ধ— অনেকটা ঢেউয়ের ওঠাপড়ার মতো। যেমন, ১৯৯৩-এর ১৩ সেপ্টেম্বরের হেমন্ত। হোয়াইট হাউস-এর বাগিচা। অসলো শান্তি প্রয়াসের একখণ্ড চিত্র। ইয়াসের আরাফাত ও ইতজ়াক র্যাবিন এক ফ্রেমে বন্দি। যুযুধান দুই দেশের নেতার করমর্দনের নাটক। বিক্রি হচ্ছে স্বপ্ন। এর সমান্তরাল আবার নানা দুর্ঘটনাও ঘটেছে। নমাজ পড়াকালীন একদল মুসলমান কচুকাটা হলেন ইহুদিদের হাতে, ইজ়রায়েল প্রধান র্যাবিন হত হলেন ঘাতকের হাতে। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক করমর্দন, তার পর আরাফাতের গাজ়ায় প্রত্যাবর্তন, বিজয় সম্মেলন— এই ছবিগুলিই চিরতরে ফ্রেমে বাঁধাই হয়ে গেল ফরাসি মানসপটে।
কিন্তু এই আপাত-শান্তি ও বাস্তবের মধ্যে যে ফাটলের দাগ ছিল তা-ই খাদে পরিণত হল বর্তমান সহস্রাব্দে এসে। প্যালেস্টাইনে শুরু হল গণঅভ্যুত্থান— ইন্তিফাদা। ফরাসি গণমাধ্যমের চোখে যা কার্যত হয়ে দাঁড়াল স্থিতাবস্থা ও শান্তির বিরুদ্ধে প্যালেস্টাইনি অভ্যুত্থান। তারা মানতে রাজি নয় যে, তথাকথিত শান্তির নীচে ঢাকা পড়েছিল এক নারকীয় বাস্তবতা। ঔপনিবেশিক শাসনের এক কদাকার চেহারা, তার ধ্বংসলীলা।
এই ক’মাস আগে গাজ়া সীমান্তে সরেজমিনে এই নরক-দর্শনের পর প্রেসিডেন্ট মাকরঁ এক সাক্ষাৎকারে আবেগাপ্লুত স্বরে বলেন, “গাজ়াকে ভুলে থাকার অধিকার আমাদের কারও নেই…।” তাঁর মুখ দিয়ে যেন ইতিহাস সত্য কবুল করল। এত দিন, তার মানে, গাজ়ার বাস্তব বিস্মৃতির গহ্বরে লুকিয়ে ছিল। অথচ, ১৯৬৭-তে জঁ পল সার্ত্র পরিচালিত পত্রিকা লে তঁ মদ্যার্ন-এ প্রকাশিত হয়েছিল মাক্সিম রদ্যাঁসঁ-র নিবন্ধ ‘ইজ়রায়েল কি ঔপনিবেশিক প্রভু?’ লিখেছিলেন, “শান্তির দেখা মিলবে না যত দিন অবধি আরবদের বলা হবে, প্রভুর নামগান করা তাদের কর্তব্য। কারণ, প্রভুর জাত আরও ‘উন্নত’। কারণ এই প্রভু বিপ্লবী ও সমাজতান্ত্রিক। এক কথায় সে ইহুদি।” তিনি সামনে তুলে ধরেছিলেন প্রতিটি মিথ্যাচার যা দিয়ে ফরাসি সমাজ সযত্নে চোখের আড়ালে রাখে ইজ়রায়েলি জ়ায়নবাদের দানবিক মূর্তি।
ফরাসি (এবং আরও অনেক দেশি) গণমাধ্যম সম্পর্কে এই উক্তি আজও একই ভাবে প্রাসঙ্গিক। এই বার কি খোলা হবে, চোখের ঠুলি?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)