E-Paper

সেলিম, আমিনার দেশ

ধর্মান্ধের হাতে নিহত হওয়ার ক’দিন আগে ২৬ জানুয়ারি ভারত ও পাকিস্তানের উদ্দেশে মহাত্মা গান্ধীর আবেদন ছিল, খণ্ডিত হলেও আমরা যেন ভাই, বন্ধু হয়ে পরস্পরের পাশে দাঁড়াই, বাইরের দুনিয়ার কাছে এক থাকি।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০২৫ ০৬:৫৮
ভারতবাসী: এ দেশ ছেড়ে যাননি সেলিম, সিকন্দররা।

ভারতবাসী: এ দেশ ছেড়ে যাননি সেলিম, সিকন্দররা। গরম হাওয়া ছবির দৃশ্য।

সে ছিল এক সময়ান্তরের কাহিনি। সঙ্কট তখনও কম ছিল না। তবু একটা বিশ্বাস ছিল— দাঙ্গা, হিংসা, রক্তপাত, বৈষম‍্য যা-ই থাক, গান্ধীজির আত্মবলিদান ব‍্যর্থ হবে না। এম এস সথ্যুর গরম হাওয়া ছবিটিতে অদম‍্য আশাবাদী সেলিম মির্জ়াও (বলরাজ সাহনি) জোর গলায় এটাই বলতেন। অর্ধ শতকেরও আগে, ১৯৭৪-এর এপ্রিলে নানা টানাপড়েনের মধ্যে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। এই ২০২৫-এ নানা কারণেই তা মনে পড়ে।

তবে গরম হাওয়া কোনও কালেই খুব সহজপাচ‍্য নয়। ছবিটির মুক্তির আগে লালকৃষ্ণ আডবাণী দি অবজ়ার্ভার-এ লিখলেন, এ ছবি তো পাকিস্তানের টাকায় তৈরি হয়েছে। বাল ঠাকরেও সংশয়ে ছিলেন। তবু তখনকার ভারতবর্ষে জাঁদরেল রাজনীতিবিদরাও কিছুটা ভুল স্বীকারের ধক রাখতেন। ছবিটি দেখে অনেকেই প্রকাশ্যে মত পাল্টেছিলেন। আবার দেশ পত্রিকায় এ ছবির কাটাছেঁড়ায় সমালোচক মশায়ের ‘ধর্মনিরপেক্ষতার অভাব’ দেখে সত‍্যজিৎ রায় পীড়িত হয়েছিলেন। মুসলমান সমাজের প্রতি এ ছবির ‘সংবেদী দৃষ্টিক্ষেপ’ নিয়ে সপাটে চিঠি লেখেন তিনি। এ ছবির জেরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার শঙ্কায় প্রথমে বেঁকে বসেছিল সেন্সর বোর্ডও। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হস্তক্ষেপে জট কাটে। অস্কারে, কানে ভারতের প্রতিনিধিত্বও করে একটি মুসলিম পরিবারের এই কাহিনি। জরুরি অবস্থার ঠিক আগে ইন্দিরার জমানাতেই গরম হাওয়া জাতীয় সংহতির পুরস্কারও পেয়েছিল। তবু কোনও মুসলমান প্রোটাগনিস্টের ঘা খাওয়া, মুখ থুবড়ে পড়া এবং দেশকে ভালবেসে ফের ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনি আজকের ভারতের পটভূমিতে শাসকের পছন্দ হত কি না, বা হলেও চিত্রনাট্য কোন খাতে বইত, সে বিষয়ে খটকা থেকে যায়।

গত বিধানসভা ভোটের আগে ‘সেকুলার’ বা দেশের সমন্বয়ী সংস্কৃতিতে বিশ্বাসীদের লাগাতার পাকিস্তানে পাঠানোর হুমকির মুখে একটি গান বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। ‘আমি অন‍্য কোথাও যাব না, ভারতবর্ষে থাকব’! গরম হাওয়া-র সেলিম মিয়া এবং তাঁর ছোট ছেলে সিকন্দরের (ফারুখ শেখ) মতো বহু মুসলমান এ কথাগুলোর চরম হকদার। দেশভাগের অব‍্যবহিত কাল পেরিয়ে মুসলমানদের পাকিস্তানমুখী হওয়ার হিড়িকে যাঁরা এ দেশে থাকতে চান তাঁরা চরম সঙ্কটে পড়েছিলেন। ব্যাঙ্ক বা বিশ্বস্ত মহাজন ঋণ দিতে অপারগ। আগরায় সেলিমদের জুতোর কারখানা তাই লাটে ওঠে। দেশভাগ ঘিরে মুসলিম পরিবারগুলির অন্দরেও তখন ভাঙন ধরছে। পরিস্থিতির চাপে প্রেমিকাকে ছেড়ে প্রেমিক দেশান্তরি হচ্ছে। আবার কোনও প্রতারণা ঘটিয়ে পিঠ বাঁচাতেও কেউ কেউ পাকিস্তানে আশ্রয় নিচ্ছেন। ইতিহাসের ক্রান্তিকালে ব‍্যক্তিগত সম্পর্ক, বন্ধুতা, প্রেম ভাঙার প্রেক্ষাপটে সেলিম মিয়া এবং তরুণ সিকন্দর তবু দু’টি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেশের মাটি আঁকড়ে ধরছিলেন।

ফতেপুর সিক্রি, তাজমহল, সেলিম চিশতির দরগার এই জন্মভূমি ছেড়ে কোথাও যেতে চাননি সেলিম। নানা বিপর্যয়ের ঝাপটাতেও এ দেশে তাঁর শত্রুর থেকে বন্ধুই ঢের বেশি বলে বিশ্বাসে স্থিত তিনি। আর শত্রু বা বন্ধুর গায়ে কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের তকমা থাকে না। গরম হাওয়া-য় দুর্বিপাকে পড়া সেলিমের পিঠে যাঁরা ছুরি মারেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই তাঁর স্বধর্মের আত্মীয়-পরিজন।আবার তাঁর কারখানার কর্মচারী পরম সুহৃদ পেয়ারেলাল, বা করাচিতে অনেক কিছু হারিয়ে এ দেশে আসা উদারমনা সিন্ধি ব‍্যবসায়ী আজমানি সাহেবকেও এ দেশের বাস্তুতন্ত্রের অংশ বলে চিনে নেন সেলিম।পাশাপাশি, যোগ‍্যতা সত্ত্বেও চাকরি না পাওয়া শিক্ষিত যুবা সিকন্দরও মনে করে, পাকিস্তানে যাওয়াটা মুশকিল আসান নয়। এ দেশে থেকে আর সবার সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে নিজের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়াটাই বাঁচার মন্ত্র। পাকিস্তান বা বাংলাদেশের পটভূমিতে কোনও সংখ্যালঘু পরিবারের ভাঙন-কাহিনি উঠে এলেও হয়তো কিছুটা একই রকম টানাপড়েনের গল্প প্রকাশ পাবে। ঋত্বিক ঘটকের ছবির উদ্বাস্তু বাঙালি পরিবারের প্রোটাগনিস্টদের সব খুইয়ে এ দেশে এসে সবার সঙ্গে মিশে যাওয়ার জীবনসংগ্রাম আর ইসমত চুগতাইয়ের কাহিনি-ভিত্তিক গরম হাওয়া-র পরিবারটির লড়াই কোথাও এক বিন্দুতে মিশে যায়।

ঋত্বিকের সুবর্ণরেখা, মেঘে ঢাকা তারা-র আখ্যানে পর পর নাটকীয় সমাপতনে আমরা বিভিন্ন চরিত্রের জীবনে অনিবার্য ভাবে খারাপটাই ঘটতে দেখি। ইতিহাসের অভিঘাতে ধ্বস্ত, বৈষম্যে ভরপুর সামাজিক ব‍্যবস্থায় যা অমোঘ পরিণতি। মেঘে ঢাকা তারা-র নীতা, সুবর্ণরেখা-র সীতার মতো গরম হাওয়া-র আমিনাও (গীতা সিদ্ধার্থ) তিলে তিলে নিঃশেষ হতে থাকে। নিজের পরিবারটিকে বাঁচাতে সর্বস্ব উজাড় করে নীতা প্রেমিকের কাছে প্রতারিত হবে। বাগদি বৌ কৌশল্যার ছেলে অভিরামের সঙ্গে জাতে উঁচু সীতার সংসার দুর্বিপাকে চুরমার হবেই। তেমনই গরম হাওয়া-য় দেশ-ভাঙার রাজনীতি পর পর দু’জন প্রেমিক এবং আমিনার মাঝখানে অনতিক্রম্য প্রাচীর গড়ে তোলে। আমিনার বিয়ের চেলি জড়িয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন, মৃত্যুর আধারেই পূর্ণতা পাবে। ইতিহাস, রাজনীতি এ ভাবেই গ্রিক ট্র্যাজেডির নিয়তির মতো ব্যক্তির জীবন শাসন করে। পাকিস্তানে বা বাংলাদেশে ছিটকে পড়া অনেক পরিবার ও তাঁদের ভারতীয় স্বজনের জীবনে যা আজও ঘটে চলেছে।

গরম হাওয়া ছবির শেষে সস্ত্রীক সেলিম এবং সিকন্দর পাকিস্তানের ট্রেন ধরার পথে পা বাড়িয়েও পিছিয়ে এসেছিলেন। নাটকীয় অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্সের ঢঙে একটি লাল পতাকাধারী মিছিলে শামিল হন বাবা, ছেলে। পিতা-পুত্রের মুসলমান পরিচয় ছাপিয়ে ভারতীয় সত্তার উন্মোচন ঘটে।

পঞ্চাশ বছর আগের ভারতের অভিজ্ঞানে সথ্যুর ছবি ভারতীয় হওয়া বলতে রাজনীতির শরিক বা অধিকার বুঝে নেওয়া লড়াইয়ের হিস্‌সাদার হওয়া বুঝিয়েছিল। আজকের ভারতে রাজনীতি ও ধর্মকে আলাদা করাই মুশকিল। মূলধারার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি সকলেই মন্দির রাজনীতিতে ব‍্যস্ত। হিন্দুত্ব বা হিন্দুয়ানির কড়া পাক, নরম পাকে মশগুল। আজকের ভারতীয় মুসলমানদের সামনে অতীতের সেই পাকিস্তান নামক ‘ড্রিমল্যান্ড’ সুদূর অতীত। কিন্তু মন্দির, গোরক্ষা, হিজাব থেকে শুরু করে ওয়াকফ-রাজনীতি বারে বারে মুসলমানকে শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার টোপ দিয়ে চলেছে। সেই সঙ্গে রাজনীতির পরিসরে সংসদে বা বিধানসভায় ভোটে জিতে আসা মুসলমানের অস্তিত্বটুকুও মুছে ফেলা হচ্ছে। গরম হাওয়া-র সিকন্দর বা সেলিমের লড়াইটা তাই আজকের ভারতে আমরা আরও জটিল, ঘোরালো হয়ে উঠতে দেখি।

ঘৃণার রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে সিনেমাকে ব‍্যবহারের মোক্ষম কার্যকারিতাও সম্ভবত দেশের আগের কোনও শাসক-শিবির এ ভাবে উপলব্ধি করেনি। দ‍্য কাশ্মীর ফাইলস থেকে ছাওয়া করমুক্ত করতে তাই বিজেপি-শাসিত রাজ‍্যগুলিতে হিড়িক পড়ে যায়। নির্বাচনী সভায় দ‍্য কেরালা স্টোরি-র জঙ্গিবাদ প্রচার মেলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। আজ কে বলবে রুপোলি পর্দার চরম বাণিজ্যিক বিনোদনের ভারতেও একদা রবীন্দ্রনাথের গোরার মতো গুলিয়ে যেত নায়কের ধর্মীয় পরিচিতি! অমর আকবর অ্যান্টনি-র অতিবাস্তব প্লটও গড়ে তুলত সম্প্রীতির সৌধ! আশৈশব বিচ্ছিন্ন তিন ধর্মের তিন সহোদর ভাইয়ের রক্তে চোখ মেললেন যে অসুস্থ জন্মদুঃখিনী মা, তিনি তো আসলে রক্তমাংসের দেশমাতৃকাই। সত‍্যজিতের শতরঞ্জ কে খিলাড়ি থেকে বলিউডের উমরাও জান বা পাকিজ়া-ও উর্দু, ঠুংরি, খেয়াল, কত্থকে মুসলিম সমাজের সংস্কৃতি চর্চায় সবার মধ্যে গর্ববোধ সঞ্চার করত। আজকের সিনেমায় মুসলিম চরিত্রের পনেরো আনাই রক্তলোলুপ মধ্যযুগীয় শাসক বা নৃশংসতম জঙ্গি। সেলিম, সিকন্দরদের মতো খেটে খাওয়া গেরস্ত মুসলমান খুঁজতে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ রাখতে হয়।

সদ‍্য দেশভাগোত্তর ভারতেও পাকিস্তানি চর সন্দেহে মুসলমানদের অনর্থক হেনস্থা হওয়ার নমুনা আছে গরম হাওয়া-য়। কিন্তু মিথ্যা অভিযোগে হয়রান হলেও হিন্দু সহনাগরিক বা ভারতীয় সমাজের প্রতি সেলিমের আস্থা টাল খায় না। আজকের ভারতে কিন্তু আমরা কোনও মুসলিম জঙ্গি কি দুর্বৃত্তের নিষ্ঠুর অপরাধের ভার যে কোনও মুসলিমের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার চল দেখি। সমাজের মধ্যে চলে লাগাতার বিভাজনের উস্কানি। ভিন ধর্মীর দোকানপাট ভাঙচুর, হিংসা থেকে শুরু করে আপাত-নিরীহ খোঁচায় স্কুলে, অফিসে, বাজারে, ডাক্তারখানায় ভিন ধর্মীর মুখটা ম্লান করে দেওয়ার সংস্কৃতিতে আমরা অভ‍্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। মুসলমানও তার নিজস্ব বলয়ের কোটরে সেঁধিয়ে একলা হচ্ছে। কখনও বা মৌলবাদের ফাঁদেও পড়ছে।

আট দশক আগে দেশভাগের প্রাক্কালে ভবিষ‍্যতের ভারতকে এই ধরনের বৈষম‍্য নিয়েই বার বার সতর্ক করছিলেন গান্ধী। দেশভাগ অনিবার্য বোঝার পরেও নিজেকে ‘যতখানি পাকিস্তানের, ততখানিই ভারতের’ বলে মনে করতেন তিনি। ধর্মান্ধের হাতে নিহত হওয়ার ক’দিন আগে ২৬ জানুয়ারি ভারত ও পাকিস্তানের উদ্দেশে মহাত্মা গান্ধীর আবেদন ছিল, খণ্ডিত হলেও আমরা যেন ভাই, বন্ধু হয়ে পরস্পরের পাশে দাঁড়াই, বাইরের দুনিয়ার কাছে এক থাকি। আজ ভারত, পাকিস্তান সম্পর্কের বিষ কমা দূরে থাক, দেশের ভিতরেই ধর্মে ধর্মে চরম শত্রুতা। সবাইকে নিয়ে চলার রাজনীতিটাই ‘সেকুলার’ তকমায় প্রান্তিকায়িত। গান্ধীর আত্মশক্তিতে বিশ্বাস রাখব ভরসাটা তাই ক্ষীণ হতে থাকে। আবার বিশ্বাসটুকু ছাড়া কোন পেনসিল হাতে রাখি, সেটাও প্রশ্ন বটে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Communal harmony Secularism

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy