তা হলে একটা ‘বৃত্ত’ সম্পূর্ণ হল। প্রায় সাতাশ বছরের ‘খরা’ কাটিয়ে দিল্লি রাজ্যের রং ফের গেরুয়া। গত দু’বার, অরবিন্দ কেজরীওয়ালের নেতৃত্বে ‘আপ’ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান দল বিজেপিকে একার দাপটে দিল্লি বিধানসভার ৭০টি আসনের মধ্যে ২০১৫-তে মাত্র ৩টি ও ২০২০-তে ৮টির মধ্যে বেঁধে রেখেছিল, এ বার তারা চল্লিশ আসন হারিয়ে নেমে গেছে ২২টিতে! বিজেপির ঝুলিতে ৪৮। দুই শতাংশ ভোট বাড়িয়েও কংগ্রেসের ভাঁড়ার শূন্য। ৭০টির মধ্যে মাত্র তিনটিতে তাদের জামানত বেঁচেছে। কিন্তু নিজেদের ‘নাসিকা কেটেও’ তারা আপ-এর যাত্রা ভঙ্গ করেছে! প্রায় ১৪টি আসনে আপ-এর বহু নেতা-মন্ত্রী বিজেপির কাছে যে সামান্য ব্যবধানে হেরেছেন, যার মধ্যে কেজরীওয়াল ও মণীশ সিসৌদিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতাও আছেন, কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট তার চেয়ে বেশি। ফলে, কেজরীওয়ালের ফের দিল্লি মসনদে বসার স্বপ্ন ‘দূর অস্ত্’ করে দিয়েছে কংগ্রেস!
এক বছরেরও কম সময়ে, লোকসভা ভোটে যে-আপ’এর সঙ্গে কংগ্রেস জোট বেঁধেছিল, এ বার তাদের মধ্যেই তিক্ত বিরোধ বুঝিয়ে দিল, গত লোকসভা ভোটে বিজেপি-বিরোধীদের যে ‘ইন্ডিয়া’ মহাজোট, বিপুল আশা জাগিয়েছিল তার ভিত্তিটি শক্ত পাথরের উপর নয়, ‘বালুচর’-এই গাঁথা হয়েছিল! লোকসভার পর, যে সব রাজ্যে বিধানসভার ভোট হয়েছে, তার মধ্যে ঝাড়খণ্ড ও জম্মু-কাশ্মীরের মতোই, বিরোধীরা হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রেও বিজেপিকে হারানোতে আশাবাদী ছিলেন। দু’জায়গাতেই বিরোধীরা ছত্রভঙ্গ হয়েছেন। এ বার সেই তালিকায় দিল্লিও যুক্ত হল। এ বছরের শেষ দিকে বিহারের ভোট, সামনের বছর মাঝামাঝি পশ্চিমবঙ্গে। বিহারে নীতীশকুমার বিজেপির সঙ্গে জোট-সরকার চালাচ্ছেন। তবে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এখনও সাংগঠনিক দুর্বলতা আর নেতৃত্বের অন্তর্দ্বন্দ্বে সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। তবু, লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের পর অনেকটা চুপসে যাওয়া বিজেপির ‘বুকের ছাতি’ ফের ছাপান্ন ইঞ্চি ছুঁইছুঁই করছে!
দিল্লির সঙ্গে অবশ্য গেরুয়া শিবিরের সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। বস্তুত, দেশের অন্যান্য জায়গায় শক্ত ঘাঁটি গড়ার বহু আগেই দিল্লিতে, বিজেপির উত্তরসূরি, সাবেক জনসঙ্ঘের জনপ্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতো— যার মুখ্য কারণ, দেশভাগের পর পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে ভিটেমাটি খুইয়ে দিল্লিতে আসা পঞ্জাবি (হিন্দু ও শিখ) উদ্বাস্তুদের উপচে পড়া ভিড়, যাঁরা দেশভাগের জন্য কংগ্রেস দল ও সরকারকেই দায়ী মনে করতেন। সঙ্গে ছিল, অপরিচিত রাজধানীতে জীবিকা ও বাসস্থান জোগাড় করতে পদে পদে নাকাল হওয়ার অভিজ্ঞতা। প্রথম সাধারণ নির্বাচনের (১৯৫১) আগে, হিন্দু মহাসভা থেকে বেরিয়ে এসে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘে (আরএসএস) প্রচারক বলরাজ মাধোকের সহায়তায়, ‘ভারতীয় জনসঙ্ঘ’ প্রতিষ্ঠা করলে, তা উদ্বাস্তু কলোনির বাসিন্দা ও ছোটখাটো দোকান চালিয়ে দিন গুজরান করা দিল্লির গরিষ্ঠসংখ্যক পঞ্জাবিদের প্রতিবাদের মঞ্চ হয়ে উঠল। পশ্চিমবঙ্গও তখন উদ্বাস্তুদের সমস্যায় জর্জরিত। ফলে, প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জনসঙ্ঘের হয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কলকাতা দক্ষিণ-পূর্ব কেন্দ্র থেকে সহজেই জেতেন। মাত্র এক বছর পর তাঁর প্রয়াণ হলে, বাংলায় হিন্দু উদ্বাস্তুদের মধ্যে জনসঙ্ঘের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে, তাঁরা যোগ দিতে থাকেন কংগ্রেস-বিরোধী বামপন্থী আন্দোলনে।
দিল্লিতে অবশ্য জনসঙ্ঘের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। প্রথম দিকে হিন্দু মহাসভা ও আর্য সমাজ জনসঙ্ঘের পক্ষে উদ্বাস্তুদের সমর্থন গড়ায় বিশেষ ভূমিকা নিলেও, ক্রমে আরএসএস এই দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়। এর পর থেকে দিল্লি-জনসঙ্ঘের সব বড় নেতাই আরএসএস-এরও সদস্য। বিজয়কুমার মলহোত্র থেকে কেদারনাথ সাহনি, মদনলাল খুরানা, লালা হংসরাজ গুপ্ত থেকে সাহেব সিংহ বর্মা, অরুণ জেটলি, ডা. হর্ষবর্ধন প্রমুখ দিল্লি থেকেই জনসঙ্ঘ/বিজেপির জাতীয় নেতা। এই জনভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই, ১৯৬৭ সালে চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনে, দিল্লির ৭টি লোকসভা আসনের ৬টিই জনসঙ্ঘের ঝুলিতে যায়। দিল্লি মেট্রোপলিটন কাউন্সিল ও মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনেও দীর্ঘ দিন তাদেরই আধিপত্য বজায় ছিল।
দিল্লিতে কংগ্রেস-বিরোধী রাজনীতির এই প্রেক্ষিতেই, অণ্ণা হজারের নেতৃত্বে ২০১১ সালে, দুর্নীতি-রোধে লোকপাল বিল প্রণয়নের জন্য তদানীন্তন কংগ্রেসের বিপক্ষে যে জনআন্দোলন তীব্র হয়ে উঠেছিল, তার পিছনেও বিজেপি-আরএসএস’এর সমর্থন ছিল। তাই, পরিচিত ‘বন্দেমাতরম্’ বা ‘জয় হিন্দ’-এর বদলে মুহুর্মুহু ধ্বনি উঠেছিল সঙ্ঘ-পসন্দ ‘ভারত মাতা কি জয়’! পরে এই জনআন্দোলনকে, রাজনৈতিক দল ‘আপ’-এ রূপান্তর ঘটিয়েও কেজরীওয়াল সেই স্লোগান ছাড়েননি। ‘নরম হিন্দুত্ব’-এর পরিধি আরও সম্প্রসারিত হয়েছে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফ বাহিনীর উপর হামলা, বা লাদাখে চিন-ভারতের সীমান্তে সেনাবাহিনীর সংঘাতের সময়। এমনকি, আপ সরকার সাধারণ নাগরিকদের জন্য ভাল সরকারি স্কুল, চিকিৎসার জন্য ‘মহল্লা ক্লিনিক’, বিনা মূল্যে গরিবদের বিদ্যুৎ পরিষেবা, মহিলাদের জন্য বিনা ভাড়ার বাস ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক প্রকল্প চালানোর পাশাপাশি, প্রবীণ দিল্লিবাসীদের জন্য হিমালয়ের ‘চার ধাম’-এ নিখরচায় তীর্থভ্রমণও করিয়েছে। তবু শেষ রক্ষা হল না, যা ফের প্রমাণ করল, ‘নরম’ হিন্দুত্ব দিয়ে শেষ পর্যন্ত সঙ্ঘ পরিবারের প্রবল হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মোকাবিলা করা যায় না।
আর একটা নতুন ভাগাভাগিও শুরু হয়েছিল। লোকসভায় দিল্লিবাসী বেছে নিচ্ছিলেন কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপিকে, কিন্তু দিল্লি বিধানসভায় কেজরীওয়ালকে। চালু কথায়, ‘উপরে মোদী, নীচে কেজরীওয়াল’। এই আপাত-স্ববিরোধী ব্যবস্থা ভালই চলছিল। এ বারের নির্বাচনে তাও ভেঙে গেল। তার মুখ্য কারণ, গত বছর দুয়েক, কেজরীওয়াল, মণীশ সিসৌদিয়া-সহ আপ-এর সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দকে ‘দুর্নীতি’র নানা অভিযোগে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির দীর্ঘ তদন্ত, এমনকি কারাবাসের মুখোমুখিও হতে হয়েছে। এতে, এত দিন ‘দুর্নীতি’র বিরুদ্ধে লড়াই করা আপ-এর শীর্ষ নেতৃবৃন্দের, বিশেষত, কেজরীওয়াল, সিসৌদিয়ার, অন্য রাজনীতিকদের চেয়ে ‘ভিন্ন’— এই ভাবমূর্তিতে আঘাত লাগে। অন্য দিকে, মহারাষ্ট্র নির্বাচনের সময় থেকেই আরএসএস বুথ স্তরে মানুষের দুয়ারে-দুয়ারে পুরনো যোগাযোগ ঝালিয়ে নিয়ে ফের আসরে নামে। দিল্লির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে।
বিজেপি-আরএসএস’এর রণনীতির তিনটি স্তর। প্রথমত, বিজেপির প্রথাগত ভোট যাতে ঐক্যবদ্ধ থেকে নিজেদের প্রার্থীদেরই ভোট দেয়, তা সুনিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, যাতে করদাতা মধ্যবিত্তদের যে বড় অংশ লোকসভা ও বিধানসভায় ভিন্ন ভিন্ন দলকে জেতাচ্ছিল, তাদের মধ্যে ফাটল ধরিয়ে যেন অনেকটা বিজেপির দিকে আনা যায়। তৃতীয়ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের মহিলারা, যাঁরা কেজরীওয়ালের ‘অন্ধ সমর্থক’, তাঁদের একটা অংশকে যাতে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজেপির দিকে টানা যায়। এর সঙ্গে, বিশ্লেষকদের মতে, দল ও সরকার চালনায় কেজরীওয়ালের ‘অপরিসীম ঔদ্ধত্য’ ও মুখ্যমন্ত্রীর আবাসটিকে ‘শিশমহল’-এ পরিণত করার মতো অপরিণামদর্শী তথা হঠকারী সিদ্ধান্তও এই ব্যর্থতার কারণ।
সাত দশক আগে, যে নিম্নবিত্ত উদ্বাস্তুদের উপর ভর করে জনসঙ্ঘ দিল্লিতে সংগঠনের ভিত গড়েছিল, ইতিমধ্যে সেই অংশটির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে, অনেকে উচ্চ মধ্যবিত্তে উন্নীত হয়েছে। এই হাই-টেক নব্য-উদারবাদী পুঁজিবাদের যুগে মধ্যবিত্তদের উচ্চাশা আকাশ-ছোঁয়া। তা বলে, প্রান্তিক মানুষের স্রোত দেশের রাজধানীতে কমেনি, বরং প্রতি দিন বাড়ছে। অন্য দেশ থেকে আসা ‘রিফিউজ়ি’ নয়, ভারতের নানা প্রান্ত থেকে আসা বিভিন্ন শ্রম ও বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত এই অগুনতি আমজনতাই দিল্লি-ভোটারদের তিন-চতুর্থাংশ, যাঁদের সঙ্গে দিল্লির বিত্তবান মানুষদের দূরত্ব আলোকবর্ষের। জনতার এই অংশ ও সংখ্যালঘুদের বহুলাংশ এখনও আপ-এর পাশেই আছেন। আপ-এর মুখ্য নেতৃত্ব যদি সমাজের এই বিপুল-সংখ্যক প্রান্তিক মানুষের অধিকারের লড়াইয়ের পাশে দাঁড়াতে পারেন, তবে কোনওদিন আবার সুযোগ জুটতে পারে ফিরে আসার। তবে সে কঠিন পথ। এবং তার কোনও শর্ট-কাট নেই।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)