নেপালের ইতিহাসে যা কখনও ঘটেনি, তাই ঘটে গেল সেপ্টেম্বর মাসে— গোটা দেশ কেঁপে উঠল জেন-জ়ি আন্দোলনে। কুড়ির কোঠার মধ্যে যাদের বয়স, সেই তরুণ প্রতিবাদীদের আন্দোলন ফেলে দিল কে পি শর্মা ওলির সরকার, আগুন লাগিয়ে দিল বেশ কিছু ঐতিহাসিক ভবনে। তার মধ্যে ছিল বিংশ শতাব্দীর প্রাসাদোপম ‘সিংহ দরবার’ যা সরকারের প্রধান দফতর ছিল। এই ধরনের ঘটনা গত বছর ঘটেছিল বাংলাদেশে, ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায়। কিন্তু নেপালের ঘটনাটি একটু বিশেষ। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা সিংহ দরবারের ছবি ভাইরাল হতে দেখা গেল, প্রাসাদ কমপ্লেক্স-এর বড় গেটগুলির উপরে ঝুলছে একটা অন্য ধরনের পতাকা। তাতে আঁকা দন্তবিকশিত কঙ্কালের মুখ, যার মাথায় খড়ের টুপি। অনেকের কাছে এ ছবি বড়ই অদ্ভুত, কিন্তু নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিনস বা মাডাগাস্কারের জেন-জ়ি প্রতিবাদীদের কাছে এই ছবি অর্থপূর্ণ।
এ পতাকার উৎস একটি জাপানি মাঙ্গা সিরিজ়, যার নাম ‘ওয়ান-পিস।’ শিল্পী এইচিরো ওডা। ওডা-র এই সিরিজ় এক বীর-বাহাদুর জলদস্যুকে নিয়ে, যার নাম ক্যাপ্টেন মাঙ্কি ডি লাফি। আর রয়েছে তার খড়ের টুপি-পরা নাবিক-সঙ্গীরা, যারা সবাই বেখাপ্পা, বেমানান। তারা এক সঙ্গে সাগর পাড়ি দেয়, জাহাজের নিশানে আঁকা থাকে লাফির খড়ের টুপি-পরা হাসিমুখের ছবি, যা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার পরিচয়। ‘ওয়ান-পিস’ সিরিজ়ের ভক্তদের কাছে লাফির এই নৌযাত্রা হল স্বপ্নপূরণের যাত্রা, বিশ্ব সরকারকে হারিয়ে যা মুক্তি দেবে নিপীড়িত মানুষকে। লাফি ভয়শূন্য, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। চমৎকার উপস্থিত বুদ্ধিতে সে এড়িয়ে যায় তাকে পাকড়াও করার সব চেষ্টা। বিপক্ষকে ঘোল খাওয়ানোর কায়দা বার করতেও তুখোড় সে।
নেপালের প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল ওলির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে— সব রকম সমাজমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু তা নিয়ে ক্ষোভের পিছনে রয়েছে বহু বছরের ক্ষোভ— সরকারের দুর্নীতি, অপশাসন, স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক নেতা, ধনকুবের ব্যবসায়ী, বড় আমলাদের ছেলেমেয়েরা এক দিকে অসীম সুযোগসম্পদ ভোগ করছে, অন্য দিকে দেশের অধিকাংশ মানুষ কায়ক্লেশে বেঁচে থাকার লড়াই চালাচ্ছেন। দু’পক্ষের মধ্যে দূরত্ব বিপুল, আর প্রতি দিন তা যেন বেড়েই চলেছে। কর্তৃপক্ষ যখন খড়ের টুপি পরা লাফির ছবি আঁকা পতাকার নিন্দা করেন, তাকে জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী বলে আখ্যা দেন, তখন আরও বেশি সংখ্যায় তরুণতরুণীরা নেমে আসে রাস্তায়। প্রতিবাদীরা একে রাজনৈতিক হতাশা আর ক্ষোভের বৈধ প্রকাশ বলেই মনে করেন। নেপালের জেন জ়ি-র মধ্যে ক্রোধের এই প্রবাহ বয়ে গিয়েছে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিনস, মাডাগাস্কারের তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও। তা অনুভূত হয়েছে লন্ডন, প্যারিস, ইটালি, স্লোভাকিয়াতে। যে কারণে তারা নেমেছে রাস্তায়, সেই আপাত কারণটি হয়তো নানা দেশে আলাদা। কিন্তু প্রতিবাদের মুখ ছিল দুর্নীতি, অপশাসন, দৈনন্দিন ব্যয়ে অতিরিক্ত বৃদ্ধি, এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরাশা। নেপালে জলদস্যুর যে পতাকা দেখা গিয়েছে, সেটা কেবল প্রতীকী নয়। এটা তরুণ প্রজন্মের বার্তা, যে তারা দুর্নীতি আর অন্যায়ের সঙ্গে আর সমঝোতা করবে না। নেপালের প্রতিবাদীরা বলেছে যে, তারা জানে সারা বিশ্বেই জেন-জ়ি প্রতিবাদ করছে, তাই এমন প্রতীক ব্যবহার করেছে যা তাদের প্রজন্মের কাছে অর্থপূর্ণ। জলদস্যুদের পতাকা, ‘জলি রজার’, তাদের সকলের কাছে একই ভাষায় কথা বলে। বিশেষজ্ঞদের মতে জেন-জ়ি ‘অ্যানিমে’, অর্থাৎ জাপানের অ্যানিমেটেড টিভি শো বা চলচ্চিত্র থেকে, এবং অন্যান্য পপ সংস্কৃতি থেকে প্রতীক বেছে নিচ্ছে তাদের সমবেত পরিচিতির স্বাক্ষর রাখতে, তাদের প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা বোঝাতে। সাবেক রীতি মেনে রাজনৈতিক দলের পতাকার নীচে তারা জড়ো হচ্ছে না। কারণ তাদের দৃষ্টিতে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলি নিষ্কর্মা, দুর্নীতিগ্রস্ত। তরুণ প্রজন্মের কাছে যে বিষয়গুলি গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলির সঙ্গে দলগুলির কোনও সংযোগই নেই।
‘ওয়ান পিস’ সিরিজ় প্রশংসিত হয়েছে তার গল্পের জন্য, গল্পের প্রেক্ষিত হিসেবে এক বিশাল বিশ্ব রচনার জন্য, শিল্পকুশলতা, চরিত্রাঙ্কন আর কৌতুকময়তার জন্য। পাঠক, সমালোচক, সকলেই একে সর্বকালের সেরা ‘মাঙ্গা’ (জাপানি ভাষায় ‘কমিকস’) বলে মনে করেন। ২০২২ সাল অবধি ৫১ কোটিরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে এই কমিকসের, যা তাকে এ-যাবৎ সর্বাধিক বিক্রীত কমিকসের স্থান দিয়েছে। ইউনিসেফ-এর একটি সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, তরুণরা আরও সক্রিয় প্রতিবাদে আগ্রহী। এবং তারা আরও বেশি করে ঝুঁকছে ডিজিটাল মাধ্যমের দিকে, যাতে তারা দ্রুত তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে, সবাই এক সঙ্গে প্রতিবাদে নামতে পারে, রাষ্ট্রের চাপ এড়াতে পারে, আন্দোলনের খরচ কমাতে পারে। এর কিছুই নতুন নয়— তরুণরাই বুঝতে পারে, এমন ধরনের সাংস্কৃতিক সঙ্কেত ব্যবহার করে চলেছে ২০১২ সাল থেকে। তাইল্যান্ড এবং মায়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদীরা তিন-আঙুলের ‘স্যালুট’ দেখাতেন, যা ব্যবহৃত হয়েছিল হাঙ্গার গেমস ছবিতে। ডিজিটাল দুনিয়ার পপ সংস্কৃতি এবং গেমিং সংস্কৃতি থেকে তরুণরা তৈরি করছে তাদের শব্দভান্ডার। নেপালে প্রতিবাদীরা একটি অ্যাপ ব্যবহার করে চটজলদি সমীক্ষা করে ফেলেছিল, নেপালের স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হতে পারেন। অ্যাপটি গেম-খেলিয়েদের কাছে জনপ্রিয়।
এখন পপ সংস্কৃতির নানা চরিত্র, বা প্রতীক ব্যবহার করেন প্রতিবাদীরা, তাঁরা যে একটা লক্ষ্যে বিশ্বাসী, একই মূল্যবোধে বিশ্বাসী, তা বোঝাতে। দক্ষিণপন্থীদের অনলাইন মিম থেকে ‘পেপে’ ব্যাঙ গ্রহণ করেছিলেন ২০১৯ সালে হংকং-এর গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনকারীরা। চিলি এবং বেরুটে বিক্ষোভ প্রদর্শনকারীরা হলিউড ছবির ‘জোকার’-এর মুখোশ পরেছিলেন, দুর্নীতি এবং অসাম্যের বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান যাতে চটজলদি বোঝা যায়। এই প্রতীকগুলি সহজে চেনা যায়, গ্রহণ করা যায়, রাষ্ট্রের নিপীড়নের থেকে বাঁচাও সহজ হয়। তরুণদের কাছে রাজনীতি আর সংস্কৃতি অবিচ্ছেদ্য। এই ছবিগুলি সহজে রাষ্ট্রের সীমানা পার করে যায়, ক্ষোভ-দুঃখের বার্তা পৌঁছে দিয়ে সকলের সমর্থন সহজে আকর্ষণ করে। যারা এগুলি জানে-বোঝে, তাদের একজোটে আন্দোলনে যোগ দিতে প্রণোদিত করে।
সমাজমাধ্যমের ভিতরে বাস্তব জগৎ আর ডিজিটাল জগৎ মিলেমিশে যায়। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এর ফলে নিজেদের মতামত প্রকাশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ডিজিটাল বিনোদনের উপভোক্তা-সংস্কৃতি। তা হলে কী হবে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল আর তাদের পতাকার? ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব, আর ১৮৭১ সালের প্যারিস কমিউনের পর যত রাজনৈতিক প্রতিবাদ হয়েছে, তার একটা বড় অংশই হয়েছে লাল ঝান্ডার নীচে। কমিউনিস্টদের পতাকা আজও প্রাসঙ্গিক, কিন্তু অন্যান্য প্রতীকের উত্থান, আর পাশাপাশি রাষ্ট্র-সমর্থিত কমিউনিজ়মের অবনমনের জন্য লাল পতাকার ব্যবহার অনেক কমেছে।
ভারতের প্রেক্ষিতে দেখলে অবশ্যই মনে হয় যে, এমন বিচিত্র এক দেশ যেখানে গণতন্ত্র এমন প্রাণময়, শক্তিশালী, সেখানে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল খুব তাড়াতাড়ি প্রাসঙ্গিকতা হারাবে না। তবে এ দেশেও এখন যদি প্রতিবাদের মিছিলে দেখা যায় জেন-জ়ি ডিজিটাল বিনোদনের জগতের নানা চরিত্র বা প্রতীক নিয়ে এসেছে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার উপায় থাকবে না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)