কমলাকান্ত ফের কয়েকবার চোখ কচলে ভাবতে বসলেন, নেশায় কি কম পড়িতেছে? অহিফেনে ভেজাল? সেই যে ‘পতঙ্গ’ আলোর চার পাশে ‘চোঁ-ও-ও’ ‘বোঁ-ও-ও’ করে ঘুরে বেড়াত সে গেল কোথায়? তাকে দেখি না কেন?
হয়তো কাজটা ভুলই হয়েছিল, অমন ভারী ভারী সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক দার্শনিক বাক্সপ্যাঁটরা অতটুকু প্রাণীকে দিয়ে বওয়ানো ঠিক হয়নি। তার বদলে তাকে অহিফেন-প্রসাদের ছায়া-কাটানো চোখে আর একটু ভাল করে দেখলে কাজ দিত। কী যেন নাম তার! ‘পতঙ্গ’ও একটা নাম বটে, ‘পোকা’ বললেই যেন সবটা বলা হয়ে গেল— কিন্তু পতঙ্গ কি আর এক প্রকার? তিনিই তো ফুলের বিবাহসভায় হাজির কত প্রকারের রং-ঢং দেখেছিলেন, ঘটক ভ্রমর পাত্রের নানা গুণ গুন-গুন বর্ণনা করে বেড়ায়, ‘উচ্চিঙ্গড়ে’র নহবতে সানাই বাজানোর ভার পায় মৌমাছি, ঝাড়বাতি তুলে ধরে ‘খদ্যোত’। ‘আত্মদীপো ভব’ বচনের মূর্ত রূপ এই খদ্যোতই বা আজকাল কোথায় লুকোলো?
উত্তর খুঁজতে কোথায় যাবেন কমলাকান্ত? বিজ্ঞানরহস্য-র লেখক রাজনীতিকের চরিত্র বিচারে ব্যস্ত, নইলে তাঁর দরজায় যাওয়া যেত। এ দিকে, কেউ কেউ বলছে, পতঙ্গ না থাকলে তাঁর সান্ধ্য আফিম থেকে শুরু করে প্রসন্নর গাছের ফলফলারি, সব কিছুতেই টান পড়তে পারে। সবই পরাগমিলনের সৌজন্যে মেলে কিনা! সে দিন রঙ্গ-রসিকতায় মজে ফুলের বিবাহের দিকেও ঠিকঠাক নজর দেওয়া হয়নি, মনে পড়ে কমলাকান্তের।
সত্যিই পৃথিবী জুড়ে ফুলের ঘটকালির কাজে যারা ব্যস্ত ছিল তাদের আজ পাওয়া যাচ্ছে না, তাদের সংখ্যায় ধস নেমেছে। এর পরিণাম কৃষি উৎপাদনের হিসাবে যেমন ফুটে বেরোচ্ছে, বেরোচ্ছে ছোট কৃষকের হাহুতাশ থেকেও। হাতে করে পরাগমিলন ঘটানো— যার শুনতে ভাল নাম ফুল-ছোঁয়ানো, সেটা এই বাংলার কৃষকেরা রপ্ত করেছেন বেশ অনেক দিন। আজ আমেরিকা-চিনে কমলালেবুর বড় বড় উৎপাদকরা হাড়ে হাড়ে বুঝছেন, কাজটা কত কঠিন। যে কোনও সমস্যাকেই প্রযুক্তির হাতুড়িতে পিটিয়ে শায়েস্তা করার পুরোহিতরা লাফিয়ে নেমেছেন মাছির মতো রোবট তৈরির কাজে। একটা সেফটিপিনের মতো ওজনের উড়ুক্কু যন্ত্র, যে নিজেই ফুল খুঁজে নিয়ে পতঙ্গের কাজ হাসিল করবে। কমলাকান্তের অহিফেন এমন সমাধান বাতলাতে পারত কি না সন্দেহ, তবু একুশ শতকে এটা ঘোর বাস্তব। আপনার নিকটবর্তী ফলবাগানে রোবট-বাহিনী দেখা দিল বলে।
এক দিন মনে করা হত পতঙ্গকুল অশেষ। জীবসমাজে তাদের মতো সংখ্যাগুরু আর কে? অবাঞ্ছিত বাড়বাড়ন্ত আর নগণ্য গুরুত্ব, সবই ধরা আছে ‘পোকার মতো’ শব্দ দুটোয়। কমলাকান্ত জানতেন না, দশ লক্ষেরও বেশি ধরনের পোকার খোঁজ এরই মধ্যে মিলেছে; এবং আজও অদেখা অথচ রয়েছে এই গ্রহেই, এমন সমস্ত পতঙ্গ-প্রজাতির সংখ্যা, সতর্ক আন্দাজে, হয়তো বা এক কোটি। অর্থাৎ দশটার ভিতর প্রায় ন’টার পরিচয় আজও জানি না। সব ধরনের সমস্ত পোকা জড়ো করে পৃথিবীর মানুষকে বেঁটে দিলে এক-এক জনের ভাগে পড়বে প্রায় ১৪০০ কোটি কিলবিলে, উড়ুক্কু, লম্ফনপটু প্রাণী। অনেক মানুষেরই অত সৌভাগ্য সইবে না, কিন্তু জরুরি কথাটা হল— এই বিরাট সংখ্যাটা একটা অভাবিত সমস্যাকে আড়াল করছে।
প্রথমে গুঞ্জন, তার পর কোলাহলের মতো আছড়ে পড়ল যে বিপদবার্তা, তার শুরু বলতে গেলে ২০১৭ সালে। সে বছর, জার্মানিতে, পতঙ্গের পরিমাণের উপর নিয়মিত নজর রাখা এক সমীক্ষায় দেখা গেল, গত তিন দশকে তাদের জৈবভর (প্রতি পর্যবেক্ষণে সব পোকার মোট ভর) কমেছে ৭৫ শতাংশ। ক্রমে জানা গেল, প্রতি বছর ১ থেকে ২.৫ শতাংশ হারে পতঙ্গ (মোট জৈবভর) কমছে। কেবল জার্মানি নয়, পৃথিবী জুড়ে। ২.৫ শতাংশ হারে মোট পরিমাণ অর্ধেক হতে মাত্র ২৬ বছর লাগে, ৫০ বছরে নামে ২৮ শতাংশে।
পতঙ্গ কেবল নয়, জীবজগতের বড় অংশেরই বিলুপ্তির আশঙ্কা নিয়ে কাগজে-টিভিতে আলোচনা কম হচ্ছে না। আগামী কয়েক দশকের ভিতর উদ্ভিদ-প্রাণী মিলিয়ে প্রায় ১০ লক্ষ প্রজাতি একেবারে মুছে যাবে। তাতে ইন্ধন জোগাবে পতঙ্গের বিলুপ্তি। পতঙ্গ কেবল পরাগমিলন ঘটিয়ে আমাদের আহার জোগায় তা-ই নয়, তারা নিজেরাই অজস্র প্রাণীর আহার। পাখি, সরীসৃপ, মাছ, স্তন্যপায়ী, কাদের নয়! কেবল প্রাণী কেন, অজস্র গাছের জীবন নির্ভর করে আছে পতঙ্গের উপর। আমাদের বোধে কখনও এ কথাটাকে ঠাঁই দিয়েছি কি যে, খোদ বোধিবৃক্ষ-সহ অশ্বত্থ-বট-পাকুড় ইত্যাদি সমস্ত ডুমুরজাতীয় গাছ নিষ্ফলা নির্বীজ হয়ে যাবে মাত্র কয়েকটা বিশেষ পতঙ্গ, ‘ওয়াস্প’, ধরা থেকে বিদায় নিলে!
পোকামাকড়ের মূল্য যে আছে, এ কথাটা বুঝতে এবং মানুষকে বোঝাতে লেগে গেছে অনেক দিন। শ্রীরামকৃষ্ণ বিজ্ঞানরহস্য-র লেখকের শ্লেষ ধরতে না পেরে ধমকে দিয়েছিলেন তাঁর প্রবল ‘পাটোয়ারি বুদ্ধি’র জন্য। কিন্তু আজকের জগতে পাটোয়ারি নিক্তিতেই সব কিছুর মূল্য কষা হয়। প্রতি বছর কেবল পরাগমিলনের পরিষেবা বাবদ গোটা পতঙ্গজগতের পাওনা হয় ২৫,০০০ কোটি ডলার! চাষের ক্ষতিকর পতঙ্গদের নাশ করে অপর কয়েক দল পতঙ্গ, সেই পরিষেবার মূল্য আরও বেশি: ৪১,৭০০ কোটি ডলার। এরা বিলুপ্ত হলে গায়ে কি কম ছ্যাঁকা লাগবে?
কমলাকান্তের প্রশ্ন, কেন এই বিলোপ? একটা মতে এ হল ‘ডেথ বাই থাউজ়্যান্ড কাটস’, অর্থাৎ একটা নয়, কারণ অজস্র। পৃথিবী উষ্ণ হচ্ছে, ঘটছে দূষণ, জল বাতাস মাটি সর্বত্র, প্রাকৃতিক স্বভাব ধরে রাখা জমি উবে যাচ্ছে হুহু করে, যথেচ্ছ কীটনাশক ব্যবহার উপকারের বদলে অপকার করছে বেশি, এমনকি সাধারণ গেরস্তের মধ্যেও পরিচ্ছন্নতার এমন একটা বিকৃত ধারণা জন্ম নিয়েছে যে আমাদের মানুষী পরিধির ভিতর এদের কাউকে আমরা আর বরদাস্ত করছি না।
আজ ঘুম ভেঙে জেগে ওঠার মতো, পতঙ্গদের নতুন চোখে দেখা হচ্ছে যেন। ঠিক এমনটা আগে ছিল না, এবং এ নিয়ে তর্ক তোলারও অবকাশ নেই যে, পতঙ্গদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটাকে ঢেলে সাজানোর মধ্যেই রয়ে গেছে আসন্ন দুঃসময়টাকে এড়ানো বা তার অভিঘাত কমিয়ে আনার উপায়।
কারও কারও হয়তো আজও মনে পড়ে, বর্ষার রাতে, গরমের সন্ধ্যায়, ঘরের ভিতর হাজির আলাপী পতঙ্গদের কথা। মথ, গুবরে পোকা, উচ্চিংড়ে, গঙ্গাফড়িং, জোনাকি...। জোনাকির ছোটবেলা কাটে মাটিতে ঈষৎ স্যাঁতসেঁতে কোণে, জলের কাছাকাছি কখনও। ব্লিচিং পাউডার আর হাজারো কীটনাশকের বাড়াবাড়ি কি তাদের আলো নিবিয়ে দিল?
এমন এক জলবায়ুর দেশে আমাদের বাস যে না চাইতেই পোকামাকড়ের সংখ্যা বিপুল। সেটাই কি এদের প্রতি আমাদের সহজাত বিরাগের কারণ? কিছু দিন আগেও ফড়িঙের স্বচ্ছ ডানায় লেখা থাকত শৈশব, কোথায় গেল সেই খোলা হাওয়ার সময়টা? নাগরিক শিশুদের সঙ্গে প্রকৃতির বিযুক্তি প্রায় সম্পূর্ণ, কিন্তু শহর ঘিরে রাখা গ্রামগুলোও যে আর আগের মতো নেই!
ছিল এক দিন, আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়েই ছিল বেশ কয়েক ধরনের পতঙ্গ। বাণিজ্যিক প্রয়োজনের সঙ্গে জোড়া রেশম মথ, মৌমাছি, লাক্ষাপোকা ইত্যাদির কথা বাদ দিয়েই বলছি। আজ সেই সম্পর্কটাকে হয়তো ঝালাই করে নেওয়া দরকার। উৎসবের যে হাওয়া এসে লেগেছে বঙ্গ জুড়ে, তার মধ্যে অনায়াসেই তো জায়গা পেতে পারে প্রজাপতি উৎসব, মথ উৎসব, জোনাকি উৎসব, ঝিঁঝি উৎসব, ফড়িং উৎসব! কিছু কিছু সংস্থা উৎসাহীদের জড়ো করে প্রজাপতি মথ ফড়িং চেনানোর শিবির আয়োজন করেন এখনই। এ বার সময় হয়েছে— সেই উদ্যোগটাকে সাধারণ স্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার।
সত্যি বলতে কি— জাপানে, নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর দেশটিতে, পতঙ্গেরা সোচ্ছ্বাসে উপস্থিত। বিনা অনুপ্রেরণায় বছরে কয়েকশো ছোট-বড় উৎসব হয় সেখানে পোকামাকড় নিয়ে— উচ্চিংড়ে, সিকাডা (বনঝিঁঝি), বিটল, জোনাকি, ফড়িং, প্রজাপতি, আরও নানা কিছু। জোনাকির উৎসবে এক দিনে ১৫,০০০ মানুষের জমায়েত হয়, ভাবা যায়! জাপানি সংস্কৃতিতে এর সহস্রাধিক বছরের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, সে কথা অনস্বীকার্য। শুধু উৎসবের জন্যই চাষ হয়, দোকানে দোকানে বিক্রি হয় পতঙ্গ, কিনে নিয়ে তাদের মুক্ত করে দেওয়ার জন্য। হয়তো এ দেশে আজকের সংরক্ষণবাদীদের সেটা তেমন পছন্দ হবে না। তবু, আশা করতে দোষ কী! মনে পড়ে, মেক্সিকোয় মনার্ক প্রজাপতি দেখার নামে পর্যটন থেকে রোজগার হয় কম করে সাড়ে চার কোটি ডলার, সঙ্গে স্যুভেনির-বাণিজ্য ৯০ কোটি ডলারেরও বেশি!
‘পাটোয়ারি বুদ্ধি’র কথা থাক। কেবল কাব্যের খাঁচায় আটকে না রেখে যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলেরও, তাকে ডানা মেলার পরিসর দেওয়ার কথা তুলতে পারি তো? তার জন্য দুয়ার খোলা থাক।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)