E-Paper

গৃহহীনে গৃহ দিলে

সিন্ডি, আদনানরা সেই ৩৭ জন ক্রীড়াবিদ নিয়ে গড়া দলের সদস্য, যাঁরা প্যারিস অলিম্পিক্সে ১২টি বিভাগে যোগ দিলেন। ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন এঁদের নিয়ে গড়েছিল এ বারের ‘রিফিউজি অলিম্পিক দল’।

তাজুদ্দিন আহ্‌মেদ

শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০২৪ ০৮:৫৯
বার্তাবহ: প্যারিসে অলিম্পিক্সের উদ্বোধন-অনুষ্ঠানে শরণার্থী অলিম্পিক দল। ২৬ জুলাই, ২০২৪।

বার্তাবহ: প্যারিসে অলিম্পিক্সের উদ্বোধন-অনুষ্ঠানে শরণার্থী অলিম্পিক দল। ২৬ জুলাই, ২০২৪। ছবি: পিটিআই।

এগারো বছর বয়সে ক্যামেরুন ছেড়েছিলেন সিন্ডি এনগাম্বে। এসে পৌঁছেছিলেন ইংল্যান্ডে। ২০১৯ সালে গ্রেফতার হন সেখানে, ঠাঁই হয়েছিল ডিটেনশন সেন্টারে। পরে মুক্তি পান। এই ২০২৪-এ প্যারিস অলিম্পিক্সে রলঁ গারোস-এ তিনি যখন ৭৫ কেজি বিভাগে বক্সিং রিংয়ে লড়াই করছেন, সেমিফাইনালে উঠে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর হেরে যাচ্ছেন অভিজ্ঞতায় এগিয়ে থাকা পানামার প্রতিযোগীর কাছে, জিতছেন ব্রোঞ্জ পদক— তাঁর লড়াইটার জয়, তাঁর পরাজয়, সব কিছু এক স্বপ্নমাখা জীবন-আলেখ্যের দিকে নজর ঘোরায় আমাদের। সেই স্বপ্ন, যার টানে পথে নেমেছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার তরুণ আদনান খানকন-ও। ‘বলকান পথ’ পেরিয়ে বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া পেরিয়ে আসার পর হাঙ্গেরিতে গ্রেফতার হন তিনি। পরে আশ্রয় পান জার্মানির এক শরণার্থী ক্যাম্পে।

সিন্ডি, আদনানরা সেই ৩৭ জন ক্রীড়াবিদ নিয়ে গড়া দলের সদস্য, যাঁরা প্যারিস অলিম্পিক্সে ১২টি বিভাগে যোগ দিলেন। ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন এঁদের নিয়ে গড়েছিল এ বারের ‘রিফিউজি অলিম্পিক দল’। তাঁদের কেউ আদতে সিরিয়ার মানুষ, কেউ ইরান বা আফগানিস্তানের, কারও স্বদেশ কঙ্গো, কেউ জন্ম নিয়েছেন ক্যামেরুনে। কিন্তু প্যারিস অলিম্পিক্সে তাঁরা প্রতিনিধিত্ব করেছেন সেই দশ কোটিরও বেশি মানুষের যাঁরা ‘রিফিউজি’ বা উদ্বাস্তু, ছেড়ে এসেছেন নিজ ভূমি, শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় চেয়েছেন ইউরোপ ও পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশে। তাঁদের ফেলে আসা দেশ, ছেড়ে আসা জীবন, তাঁদের ধর্ম ও সংস্কৃতি, এই সব কিছুর মধ্যে হাজার পার্থক্য থাকলেও তাঁদের এক সূত্রে বেঁধেছে তাঁদের দেশহীনতা।

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বছর দুয়েকের আয়লান কুর্দির মৃতদেহ ভেসে উঠেছিল ভূমধ্যসাগরের সৈকতে। নিরাপদ এবং কিছুটা সচ্ছল জীবনের সন্ধানে নৌকায় ইউরোপের পথে পাড়ি দিয়েছিল কুর্দি পরিবার। তার পর নৌকাডুবি। বালুকাবেলায় উপুড় হয়ে থাকা শিশুর সেই ছবি হয়ে উঠেছিল বিশ্বজোড়া বিপুল উদ্বাস্তু সমস্যার প্রতীক। সেই বছরই অক্টোবর মাসে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট ‘রিফিউজি অলিম্পিক দল’ গড়ার কথা বলেন। ২০১৬ সালের রিয়ো অলিম্পিক্সে যোগ দেন ১০ জন উদ্বাস্তু, যাঁরা ছিলেন ইথিয়োপিয়া, দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া এবং কঙ্গোর মানুষ। ২০২০ সালের টোকিয়ো অলিম্পিক্সে উদ্বাস্তু অলিম্পিক দলের হয়ে যোগ দেন ২৯ জন প্রতিযোগী। আর এ বছর প্যারিস অলিম্পিক্সে যোগ দিলেন ৩৭ জন উদ্বাস্তু প্রতিযোগী। এই প্রথম প্যারিস অলিম্পিক্সে এক জন শরণার্থী ক্রীড়াবিদ পদক পেলেন। শরণার্থী সঙ্কটে দীর্ণ এই পৃথিবীতে অলিম্পিক্সের মতো ক্রীড়া-দরবারে এ যে কত বড় জয়, কী গুরুত্বপূর্ণ বার্তা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সুদান থেকে আসা অ্যাঞ্জেলিনা নাদাই লোহালিথ প্যারিসে ১০ কিলোমিটার ইভেন্টে দৌড়লেন, অথবা মতিন বলসিনি যখন প্যারিস লা ডিফেন্স আরেনা-তে সাঁতার কাটলেন, তাঁদের এই প্রয়াস আশার আলো জ্বেলে দিল নিরাপদ সুন্দর জীবনের সন্ধানে পথে বেরিয়ে পড়া উদ্বাস্তু মানুষদের মনে— যাঁদের কেউ রয়েছেন উদ্বাস্তু ক্যাম্পে, কেউ বা এখনও বিপদসঙ্কুল পথে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে লিখেছিলেন, মানুষ ধ্বংস হতে পারে কিন্তু সে পরাজিত হয় না। সমগ্র প্যারিস যে করতালি দিয়ে উদ্বাস্তু দলের এই ক্রীড়া-প্রচেষ্টাকে বাহবা জানাল, সে তো আসলে খেলার চেয়েও বেশি কিছু: সুস্থ নিরাপদ জীবনের সন্ধানে মানুষের মরণপণ লড়াইকেই বিশ্বের কুর্নিশ।

অলিম্পিক ক্রীড়াঙ্গনে উদ্বাস্তু দলের উপস্থিতি আমাদের মনে করায়, মানবসভ্যতা এখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে ভয়াবহ সঙ্কটের মুখোমুখি। মায়ানমার, পশ্চিম এশিয়া, সুদান, ইউক্রেন, আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অংশের যুদ্ধাঞ্চল বা কনফ্লিক্ট জ়োনে প্রাণ যাচ্ছে অজস্র মানুষের। যুদ্ধ, খাদ্যাভাব বা পরিবেশ-প্রকৃতির পরিবর্তনে বাস্তুচ্যুত বহু কোটি মানুষ দেশের মাটি ছেড়ে পথে নেমেছেন নিরাপদ জীবন-জীবিকার সন্ধানে। পাড়ি দিয়েছেন বহু হাজার মাইল। ২০২৩-এর পরিসংখ্যান অনুসারে যে কয়েকটি দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছেন সেগুলি হল সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইউক্রেন, ভেনেজ়ুয়েলা ও দক্ষিণ সুদান। প্যালেস্টাইনের উপর ইজ়রায়েলি হামলা উদ্বাস্তু সমস্যা তীব্রতর করেছে। শিশু ও নারীর বিপদ বেড়েছে শতগুণ।

এই অবস্থায় যখন আফগানিস্তান ছেড়ে আসা মনিঝা তলাশ অলিম্পিক্সে ‘ব্রেকিং’-এর মতো ইভেন্টে যোগ দিলেন, সিরিয়া থেকে এসে নেদারল্যান্ডসে আশ্রয় নেওয়া আরম মেহমুদ ব্যাডমিন্টন র‌্যাকেট হাতে কোর্টে নামলেন, উদ্বাস্তু সঙ্কটের ভয়াবহতাও আলোচনায় ফিরে এল আবার।

আলোচনায় ফিরল শরণার্থীদের আশ্রয়দানের জটিলতার প্রশ্নটিও। রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ থেকে ২০২২ পর্যন্ত শরণার্থীদের মধ্যে বড় একটি অংশ আশ্রয় পেয়েছেন ইরান, তুরস্ক, কলম্বিয়া ও জার্মানিতে। অথচ এ-ও উল্লেখের, আফ্রিকা ও এশিয়া থেকে আসা আশ্রয়প্রার্থীদের সিংহভাগ ইউরোপের দেশগুলিতেই থাকতে চান। কিন্তু উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়ার বিরোধিতা করে জনমত গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দেশে। দেশের সম্পদ কেবল দেশের মানুষের জীবনের মানোন্নয়নেই কাজা লাগা উচিত— এই ধারণা জনপ্রিয় হয়েছে আমজনতার মধ্যে। এর সঙ্গে জুড়েছে জাতিবৈরিতা। পরিস্থিতি কাজে লাগাতে সচেষ্ট রাজনীতির কারবারিরাও। ইউরোপ জুড়ে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থানের পিছনে রয়েছে শরণার্থীদের আশ্রয় না দেওয়ার ‘প্রতিশ্রুতি’। ইটালির নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, সে দেশে উদ্বাস্তুদের আসা আটকাতে জলপথ অবরোধ করা হবে। তাঁর এই নীতির সঙ্গে ইংল্যান্ডের সদ্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনকের ‘স্টপ দ্য বোট’ স্লোগানের তেমন কোনও পার্থক্য নেই। এমনকি অতি-উদারপন্থী বলে পরিচিত স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলিও কঠোর শরণার্থী নীতি গ্রহণ করছে।

অথচ ইউরোপীয় সভ্যতার মধ্যেই রয়েছে আশ্রয়দানের পবিত্র প্রথা। ওল্ড টেস্টামেন্ট-এ রয়েছে ছয়টি এমন শহরের কথা যেগুলি ‘সিটিজ় অব রিফিউজ’ বলে পরিচিত। মানবহত্যার দায়ে অভিযুক্তরাও আশ্রয় পেতে পারত সেই শহরগুলিতে। সেই শহরগুলির বাস্তব অস্তিত্ব, তাদের ধর্মীয় চরিত্র নিয়ে আলোচনা ও তর্কের অবকাশ থাকলেও, আশ্রয়দানের পবিত্র প্রথা যে প্রাচীন ইউরোপীয় চিন্তনের অংশ ছিল, সে কথা অস্বীকার করা যায় না। ফরাসি চিন্তাবিদ জাঁক দেরিদা বলেছেন, সেই আতিথেয়তাই প্রকৃত আতিথেয়তা যা কোনও শর্ত আরোপ করে না। সম্পূর্ণ অপরিচিত নামহীন ব্যক্তিকে তার পরিচয়, সামাজিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন না করে, কোনও প্রতিদানের প্রত্যাশা না রেখে নিজ বাসভূমিতে স্বাগত জানানোর মধ্যেই রয়েছে নিঃশর্ত আতিথেয়তার সার।

বিশ্বের বর্তমান রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে দেরিদা-কথিত এই শর্তহীন আশ্রয় হয়তো আশা করা যায় না। তবু, বহু ধর্ম, বর্ণ ও জাতিসত্তার চিহ্ন নিয়ে উদ্বাস্তু অলিম্পিক দল নতুন স্বপ্নের বীজ উড়িয়ে দিল প্যারিসের বাতাসে; পশ্চিমি দুনিয়া নিশ্চয়ই আশ্রয় দেওয়ার পবিত্র ঐতিহ্যকে ফিরে দেখবে— এটুকু আশা করা যায়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Paris Olympics 2024 Refugee crisis Refugee camp

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy