রাজনীতি ও থিয়েটারের মধ্যে টানাপড়েন— বহু পুরনো ও অবধারিত। থিয়েটার তার জন্মলগ্ন থেকেই জড়িত সমাজ-রাজনীতির সঙ্গে। গোড়ায় ধর্মের উপলক্ষে শুরু হলেও অচিরেই থিয়েটার হয়ে ওঠে সামাজিক অনুষ্ঠান। তার মধ্যে ঢুকে পড়ে সমাজ ও রাষ্ট্রক্ষমতা বিষয়ক নানা প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ। এ যেমন ঘটেছে প্রাচীন গ্রিস বা রোমে, তেমনই ভারতবর্ষে, আবার রেনেসাঁসের ইউরোপে। বর্তমান প্রতিবেদনে আমাদের রাজ্যে এই সময়ের রাজনৈতিক থিয়েটারের গতিপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টাই আমার প্রধান লক্ষ্য।
গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের ক্রান্তিকারী প্রযোজনা নবান্ন থেকেই আধুনিক বাংলা থিয়েটারে রাজনীতির প্রশ্ন এক নতুন মাত্রা পায়। এই ঘটনার মাত্র বিশ-পঁচিশ বছর আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও নভেম্বর বিপ্লবের মতো দুই বিশাল ঘটনায় আলোড়িত হয় ইউরোপ তথা পৃথিবীর মানবসমাজ। থিয়েটারেও এর ঢেউ এসে পড়ে। রোম্যাঁ রোল্যাঁ-র পিপল’স থিয়েটার, পিসকার্টরের পলিটিক্যাল থিয়েটার ও ব্রেখটের এপিক থিয়েটার— এই বিবর্তনের পথ ধরে ইউরোপের রাজনৈতিক থিয়েটারে বিশ্লেষণ ও প্রতিবাদের পরিণত ঐতিহ্য গড়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে, ব্রেখট বলেছিলেন, পৃথিবীটাকে খালি বুঝলেই হবে না, একে বদলাতেও হবে।
এ রাজ্য তথা ভারতের আধুনিক থিয়েটারে রাজনৈতিক থিয়েটারের অন্যতম প্রবর্তক উৎপল দত্ত। ‘বহুরূপী’র জোরালো প্রযোজনায় রক্তকরবী-র মঞ্চরূপ এক রাজনৈতিক থিয়েটারের অভিঘাত নিয়ে আসে বটে, কিন্তু সরাসরি মার্ক্সবাদী বীক্ষার আলোকে শ্রেণিসংগ্রাম ও সামাজিক দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণকে থিয়েটারে প্রবল প্রতাপ ও স্পর্ধায় হাজির করেন উৎপল দত্ত। এর ফলে তাঁর থিয়েটারি জীবনের স্বাভাবিক বিকাশ বার বার ব্যাহত হয়েছে, কিন্তু বর্ণময় হয়েছে তাঁর নাট্য-অভিযাত্রা। মাত্র আটাশ বছর বয়সে ব্যক্তিগত লিজ়ে মিনার্ভা থিয়েটার অধিগ্রহণ করে সেখানে অঙ্গার থেকে তীর পর্যন্ত একের পর এক প্রযোজনায় এক দশক জুড়ে রাজনৈতিক থিয়েটারকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান উৎপল ও তাঁর দল এলটিজি।
বাধা এসেছে বার বার। ১৯৬৪-তে কল্লোল-বিরোধী হীন চক্রান্তের বিরুদ্ধে ‘কল্লোল চলছে চলবে’-র প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলে নতুন অধ্যায়। ১৯৬৭-তে নকশালবাড়ি অভ্যুত্থানের সমর্থনে তীর রচনা ও প্রযোজনার জন্য উৎপল হারান মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থন। রাজনৈতিক বিশ্বাসের মূল্য দিতে কারাবরণ করেন। বিদেশে গিয়ে মার্চেন্ট-আইভরি প্রযোজিত দ্য গুরু-র শুটিং শেষে দেশে ফিরে তৈরি করেন নতুন দল পিএলটি (পিপল’স লিটল থিয়েটার) এবং অচিরেই টিনের তলোয়ার ও ব্যারিকেড প্রযোজনা করে থিয়েটারে নিজের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। রচনা-সৌকর্যে, প্রযোজনার অনন্যতায় ও অসামান্য অভিনয়ের সুবাদে টিনের তলোয়ার এমন উচ্চতা স্পর্শ করে যে স্বয়ং সত্যজিৎ রায় বলেন, এই হচ্ছে ‘দি অ্যাকমে অব ইন্ডিয়ান থিয়েটার’, ভারতীয় থিয়েটারের তুঙ্গ বিন্দু। প্রতিবাদ এ বার হয়ে ওঠে নাট্যকাব্য। ১৯৭৪-এ স্টার থিয়েটারে দুঃস্বপ্নের নগরী-র অভিনয় বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু অনবদমিত উৎপল তাঁর প্রতিবাদের থিয়েটার জারি রাখেন।
রাজ্যে বড় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে ১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দু’-এক বছরের উচ্ছ্বাস উত্তেজনা কমে আসার পরই প্রশ্ন দানা বাঁধতে শুরু করে, রাজনৈতিক পালাবদল সত্ত্বেও সমাজের কাঠামোয় মৌলিক বদলের সম্ভাবনা কতটুকু, তা নিয়ে। এমনকি পার্লামেন্টারি প্রথায় অংশগ্রহণ কি শেষ পর্যন্ত শ্রেণিসংগ্রামের প্রশ্ন সরিয়ে রেখে আপসের রাজনীতির পথকেই অপরিহার্য করে তুলছে না, এ কথাও উঠতে থাকে। এই সময় থেকেই স্রষ্টা উৎপল দত্তের সঙ্কটও শুরু হতে থাকে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তির প্রত্যক্ষ বিরোধিতায় গড়ে ওঠা তাঁর প্রতিবাদের থিয়েটার যেন একটু থমকে দাঁড়ায়। এই সময়পর্বে আশির দশকেও তিনি আন্তর্জাতিক নানা বিপ্লবের আলেখ্য রচনা করেন, বঙ্গীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ ডিরোজ়িয়ো ও রামমোহনকে নিয়ে নাটক লেখেন, বহু স্মরণীয় একাঙ্ক নাটকও। কিন্তু সন্দেহ নেই, এই শেষ পর্বে তাঁর সৃজন-প্রতিভার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছিল আজকের শাজাহান নাটকের রচনা প্রযোজনা ও অভিনয়ে এবং সত্যজিৎ রায়ের আগন্তুক চলচ্চিত্রে প্রধান ভূমিকার অসামান্য রূপায়ণে।
চার দশকের এই উত্তেজক নাট্য সফরের পাশাপাশি উৎপল দত্ত রচনা ও প্রযোজনা করেছেন অনেক যাত্রাপালা, যা যাত্রার জগতে তৈরি করেছে নতুন ঘরানা। অসংখ্য বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, একাধিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, শেক্সপিয়র-গিরিশচন্দ্র’সহ থিয়েটারের নানা প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ নিয়ে লিখেছেন অসামান্য গ্রন্থরাজি, সত্যজিৎ রায়কে সভাপতি করে ‘এপিক সোসাইটি’ তৈরি করেছেন, এপিক থিয়েটার নামে নাট্যপত্রিকা সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘ দিন। তবু বলব, পরবর্তী সময়ের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসাবে রয়ে যাবে তাঁর রচিত নাটকের সম্ভার।
সে কথায় যাওয়ার আগে আবার ফিরে আসতে চাই প্রতিবাদের থিয়েটারের ঐতিহ্যের প্রশ্নে। সত্তর ও আশির দশক জুড়ে অনেক নাট্যকার, নাট্যদল ও নির্দেশক তাঁদের বহু প্রযোজনায় রাজনৈতিক থিয়েটারের ঐতিহ্যকে প্রসার ও বৈচিত্র দিয়েছিলেন। হয়তো উৎপলীয় অ্যাজিটপ্রপ ভঙ্গিতে প্রত্যক্ষ উত্তেজনা সৃষ্টির পথে এঁরা সবাই হাঁটেননি।কিন্তু কে অস্বীকার করবেন জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, শেখর চট্টোপাধ্যায়, জোছন দস্তিদার,অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণ মুখোপাধ্যায়, বিভাস চক্রবর্তী, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, মনোজ মিত্র, হরিমাধব মুখোপাধ্যায়, অসিত বসু, নীলকণ্ঠ সেনগুপ্ত, ঊষা গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত বহু শক্তিশালী নির্দেশকের অবদানের কথা! মোহিত চট্টোপাধ্যায়, চন্দন সেন বা দেবাশিস মজুমদারের শক্তিশালী নাট্যরচনাগুলিকেই বা ভুলি কী করে! নব্বই দশকের শেষে এসে বাংলার এই প্রতিবাদের থিয়েটারে এক নতুন দিগন্তের আভাস বয়ে আনে তরুণ নাটককার ব্রাত্য বসুর উইঙ্কল টুইঙ্কল নাটকের দেবেশ চট্টোপাধ্যায়-কৃত প্রযোজনা। লক্ষণীয়, বাম জমানার নানা অসম্পূর্ণতা ও ক্ষয়ের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদের ইচ্ছা কী ভাবে নাট্যরূপ পায় এই প্রযোজনায়। ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত-এও এই ধারা বজায় থাকে। রাজনৈতিক থিয়েটার যে বাম রাজনীতিকে নিশানা করেও সৃষ্টি হতে পারে, এই অভিজ্ঞতা ছিল নতুন ও অভিনব। খুব বেশি দিন এই ধারা স্থায়ী হয়নি: ২০১১ সালে আবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয় পশ্চিমবঙ্গে।
কিন্তু থিয়েটারে প্রতিবাদ তো থেমে থাকতে পারে না। গত প্রায় দেড় দশক জুড়ে এ রাজ্যে অনাচার, নৈরাজ্য, বঞ্চনা, প্রতারণার যে অসহ ঐতিহ্য গড়ে উঠছে, তার বিরুদ্ধে থিয়েটারে প্রতিবাদ কোথায়! এই ক্ষোভের সঙ্কটের মধ্যেই ২০১৯-এ কৌশিক সেনের আমন্ত্রণে একলা চলো রে নাট্যে অভিনেতা হিসাবে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে দেখলাম, কী বিপুল আগ্রহ নিয়ে দর্শকেরা বরণ করলেন এই রাজনৈতিক নাটক। কয়েক মাসের মধ্যেই তিতুমীর-এর (নির্দেশক: জয়রাজ ভট্টাচার্য) প্রযোজনা আলোড়ন সৃষ্টি করল। সম্প্রতি একের পর এক উৎপলীয় নাটকের মঞ্চপ্রযোজনা আদৃত হচ্ছে, যেন নাটককার উৎপল দত্তকে মঞ্চে পুনরাবিষ্কার চলছে। যেমন, অগ্নিশয্যা (অশোক মুখোপাধ্যায়), দিল্লী চল (চন্দন সেন), ব্যারিকেড (দেবেশ চট্টোপাধ্যায়), ঘুম নেই (সৌরভ পালোধী), ফেরারি ফৌজ (দেবাশিস রায়), আজকের শাজাহান ও টিনের তলোয়ার (সুমন মুখোপাধ্যায়) প্রমুখ। উৎপলের নিজের দল পিএলটি-র জনতার আফিম এবং এবার রাজার পালা-ও সমাদৃত হয়েছে।
বামফ্রন্ট আমলে ২০০৫-এ ‘উৎপল দত্ত নাট্যোৎসব’-এ দেখেছিলাম, কী বিপুল ও আন্তরিক দর্শক সমর্থন ও ভালবাসা। সেটা ছিল সরকারি মদতপুষ্ট উদ্যোগ। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, নাটকের কারিগরেরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উৎপলের নাট্যভান্ডারে খুঁজছেন নাট্যের রসদ। তাঁর নাটকে তো শুধু অভ্রান্ত ইতিহাসবোধ এবং সমাজচেতনাই ছিল না, ছিল মানবসম্পর্কের জটিল, মনোগ্রাহী আলোছায়ার খোঁজ, ছিল সারা পৃথিবীর বিপ্লবের রোজনামচা, উনিশ শতকীয় নবজাগরণের নায়কদের জীবনের নাট্যদলিল, এবং তার সঙ্গে ছিল বিচিত্র এক কৌতুকের বোধ। সম্প্রতি এক বর্ষীয়ান নাট্যনায়ক তাঁকে অকিঞ্চিৎকর নাট্যস্রষ্টা বলে অভিহিত করেছেন। দুর্ভাগ্যজনক এই সব মন্তব্যকে সরিয়ে রেখে উৎপল দত্ত ও প্রতিবাদী নাটকের পুনরাবিষ্কার চলুক। কেননা, থিয়েটারের প্রাণভোমরা লুকিয়ে থাকে তার প্রতিবাদের সহজাত প্রবণতায়। বাংলার থিয়েটার চর্চায় প্রতিবাদের সেই মৌলিক কণ্ঠস্বর শোনার অপেক্ষায় আমরা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)