ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে, দাদাভাই নওরোজি এবং রমেশচন্দ্র দত্তের মতো জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীরা যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে ঔপনিবেশিক শাসন কেবলমাত্র ভারতের শ্রীবৃদ্ধি করতেই ব্যর্থ হয়নি, প্রাকৃতিক সম্পদের বেপরোয়া বিত্তহরণের মাধ্যমে ভারতকে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে দিয়েছে। তাই স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, স্বাধীন সরকারের মূল লক্ষ্য হবে দেশকে অর্থনৈতিক ভাবে উন্নত করা। তবে কোন পন্থা অবলম্বন করে সেই বহুকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে দেশ উপনীত হবে তা নিয়ে জাতীয়তাবাদী নেতাদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। মহাত্মা গান্ধী মনে করতেন যে, কুটিরশিল্পের পুনরুজ্জীবনের উপর জোর দেওয়া উচিত। অন্য দিকে, জওহরলাল নেহরু এবং মেঘনাদ সাহার মতো অনেকের ধারণা ছিল যে, রাষ্ট্র-পরিচালিত শিল্পায়ন অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা নিয়ে আসবে। সুভাষচন্দ্র বসু জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়ে এই দুই মতের মানুষকে একত্র করে একটি মধ্যপন্থা স্থির করার জন্য জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি গঠন করেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন প্রদেশের কংগ্রেস সরকারগুলি পদত্যাগ করলে উদ্যোগটি ভেস্তে যায়।
স্বাধীনতার পর, সংবিধান সভায় দীর্ঘ আলোচনার মধ্যে দিয়ে জাতীয়তাবাদী নেতারা স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল্যবোধগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক সরকারের রূপরেখা নির্ণয় করেন। তাঁদের মনে হয়েছিল, ভারতের মতো বিবিধ ধর্ম, বর্ণ ও জাতি-সম্বলিত সমাজকে সুষ্ঠু ভাবে শাসন করার এটিই সর্বোত্তম রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা। এই রূপরেখা অনুযায়ী নির্বাচিত সরকারের প্রথম কাজ ছিল যত দ্রুত সম্ভব সবেমাত্র সাম্প্রদায়িক কারণে বিভক্ত হওয়া দেশটির মানুষগুলিকে— যাঁদের অধিকাংশই নিরক্ষর— দারিদ্র থেকে বার করে আনা। কিন্তু সরকারের কাছে তা করার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ ছিল না। তাই বিজ্ঞানীরা সোভিয়েট সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ইউনিয়নকে অনুসরণ করে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা তৈরি করেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল জাতীয় স্বার্থ এবং বিভিন্ন স্থানীয় বা গোষ্ঠীর দাবির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে এমন ভাবে উন্নয়নমূলক কাজ করা যাতে সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের দ্বারা সর্বোচ্চ কল্যাণ অর্জন করা যায়। এর জন্য দরকার ছিল সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য-সম্বলিত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, যেগুলির প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য যোজনা আয়োগ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
সেই সময়ে অনেক চিন্তাবিদ মনে করতেন যে, সোভিয়েট-অনুপ্রাণিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং পশ্চিমা ধাঁচের উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা এক সঙ্গে কাজ করতে পারে না। সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে স্বাধীন ভারতে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নির্মিত হয় তা উপনিবেশ-পরবর্তী বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী আর্থ-সামাজিক পরীক্ষাগুলির অন্যতম। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা কার্যকর করার জন্য গড়ে তোলা হয় এক বহুধাবিস্তৃত পরিকাঠামো। এই পরিকাঠামোর অন্তর্গত প্রধান দু’টি সংস্থা ছিল ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজ়েশন এবং সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অর্গানাইজ়েশন, যাদের দ্বারা সংগৃহীত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে নতুন প্রকল্প প্রণয়ন করা হত এবং চালু বা ইতিপূর্বে বাস্তবায়িত হওয়া প্রকল্পগুলির ফল নির্ধারণ করা হত। এই দু’টি সংস্থারই রূপকার হলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, যিনি দীর্ঘকাল কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান-বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন এবং একক ভাবে ভারতের পরিসংখ্যান ব্যবস্থা নির্মাণ করেছিলেন।
প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যায় অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এর পর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। যেখানে তিনি ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করেন। কিং’স কলেজ তাঁকে সিনিয়র ফেলোশিপ প্রদান করে। পরীক্ষা দিয়ে অল্প সময়ের জন্য তিনি ভারতে ফিরে আসেন। কিন্তু যুদ্ধের কারণে তাঁর কেমব্রিজে ফেরার পরিকল্পনা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে গেলে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে জগদীশচন্দ্র বসুর অবসরগ্রহণের ফলে সৃষ্ট শূন্য পদে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী জে জে টমসন ছিলেন তাঁর অন্যতম সুপারিশকারী। কিন্তু যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও, শিক্ষা দফতর তাঁকে স্থায়ী চাকরি দিতে রাজি ছিল না। তাঁর বিরুদ্ধে কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগও আনা হয়, কারণ তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ানোর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতেন।
অধ্যাপক জীবনের প্রথম দিন থেকেই প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ শিক্ষাদানের এমন একটি শৈলী তৈরি করতে ব্রতী হয়েছিলেন, যা ক্লাসে পড়ানোর সঙ্গে গবেষণার মিশ্রণ ঘটাবে। কিন্তু শিক্ষা দফতরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের এই শৈলী পছন্দ ছিল না। তাঁরা মনে করতেন, সরকারি কলেজের অধ্যাপকদের দায়িত্ব হল ক্লাসে পড়ানো আর কলেজ কর্তৃপক্ষ বা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত প্রশাসনিক কাজ করা। ফলে একাধিক বার প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ শিক্ষা দফতরের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু কোনও পরিস্থিতিতেই তিনি নিজের গবেষণার কাজ বন্ধ রাখেননি। প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রধান হিসেবে, নিয়ম অনুসারে তিনি আলিপুরের আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা ছিলেন। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি বৃষ্টিপাত এবং বন্যার উপর গবেষণা শুরু করেন। গবেষণার কাজকে সংগঠিত করার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজের বেকার বিল্ডিংয়ে নিজের অফিসের মধ্যে গড়ে তোলেন স্ট্যাটিস্টিক্যাল ল্যাবরেটরি। পরে তৈরি করেন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট। উচ্চমানের গবেষণাপত্র প্রকাশ করার জন্য সম্পাদনা করতে শুরু করেন সংখ্যা পত্রিকা।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে প্রাপ্ত অনুদান দিয়ে ফসল উৎপাদন এবং গ্রামীণ ঋণের মতো বিষয়ের উপর বেশ কিছু বৃহদাকার নমুনা জরিপ পরিচালনা করে এবং নিয়মিত ভাবে সরকারি কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকে। কিন্তু প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ এই ধরনের পরিসংখ্যান সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণের কাজ করে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি তাত্ত্বিক কাজে আগ্রহী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, তাঁর পক্ষে দেশের সবচেয়ে ভাল যে কাজটি করা সম্ভব তা হল পরিসংখ্যান নিয়ে তাত্ত্বিক গবেষণা করার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করা। তিনি বার বার ঔপনিবেশিক সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করেন এই ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা এবং সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তার গুরুত্ব। কিন্তু ঔপনিবেশিক সরকার এই বিষয়ে আগ্রহী ছিল না। বরং তাঁকে বলা হয়, যদি তিনি পরিসংখ্যান সংক্রান্ত তাঁর ব্যক্তিগত গবেষণাকাজ বন্ধ করে, সম্পূর্ণরূপে অধ্যাপনার কাজে মনোনিবেশ না করেন, তা হলে প্রশাসনিক কাজ করার জন্য তাঁকে কোনও সরকারি অফিসে বা মফস্সলের কোনও কলেজে বদলি করা হবে। তাই দেশ স্বাধীন না হওয়া অবধি তিনি ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটকে একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে সক্ষম হননি।
প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ মনে করতেন, বৈজ্ঞানিক গবেষণা হল দেশের উন্নয়নের অপরিহার্য অঙ্গ। অধ্যাপকদের তিনি বিবেচনা করতেন দেশ নির্মাণের কাজের সঙ্গে যুক্ত কর্মী রূপে। তাই তিনি কোনও বৈজ্ঞানিক গবেষণাকেই এক জন অধ্যাপকের পেশাগত কর্তব্যের বাইরে কাজ হিসেবে দেখতেন না। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে পরিসংখ্যানের ব্যবহার নিয়ে তাঁর ভাবনা ছিল তাঁর সময়ের বিজ্ঞান এবং সমাজের মধ্যেকার সম্পর্ক বিষয়ক বৃহত্তর ভাবনার অংশ। আগে বিশ্বাস করা হত, যে কোনও বৈজ্ঞানিক গবেষণার একমাত্র উদ্দেশ্য হল মানুষের জ্ঞানের দিগন্তকে প্রসারিত করা, এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা কোনও প্রকার সামাজিক বিবেচনা দ্বারা প্রভাবিত হওয়া উচিত নয়। কিন্তু দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে বিজ্ঞান এবং সমাজের মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। পুরনো ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে বলা হয় যে, বিজ্ঞানের দায়িত্ব হল সমাজের প্রয়োজন পূরণ করা। আমাদের মতো উপনিবেশিত জাতির জন্য এর অর্থ ছিল— বিজ্ঞানের দায়িত্ব হল দেশ নির্মাণের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা।
১৯৫০ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতির ভাষণে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ মন্তব্য করেছিলেন যে, যদি মানবসমাজের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া থেকে বৈজ্ঞানিক গবেষণা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তা হলে তা অপ্রাসঙ্গিক বৌদ্ধিক ক্রিয়ায় পরিণত হয়। এ কালে যখন কেন্দ্রীয় সরকার গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলিকে অর্থ বরাদ্দ করা বন্ধ করে দিচ্ছে, গবেষকদের ফেলোশিপের টাকা আটকে দিচ্ছে এবং নানা অবৈজ্ঞানিক বিষয় প্রচার করছে, তখন আমাদের বিজ্ঞানের বৃহত্তর দায়িত্ব ও দেশের উন্নয়নে তার ভূমিকা সম্পর্কে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ভাবনাকে বিশেষ ভাবে স্মরণ করা উচিত।
গবেষক, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)