উনিশশো সাতচল্লিশ সালে ভারত যখন স্বাধীন হল, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের সময়ে তৈরি হয়ে ওঠা বেশ কিছু পরিশীলিত ও দূরদৃষ্টিপ্রসূত ভাবনা হারিয়ে গেল নতুন উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল— কেন্দ্র এবং প্রদেশগুলির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রীয় ভিত্তিতে ক্ষমতা ভাগাভাগির মৌলিক আদর্শটি। সম্ভবত ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে দেশভাগের কারণেই আগেকার প্রদেশকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কার্যক্রম যেন হঠাৎ করেই তাদের জোর ও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলল। অথচ তার আগে অনেক দিন ধরে অনেকে তাঁদের জাতীয়তাবাদী চিন্তায় ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের ধারণাটিকে ভবিষ্যৎকালের স্বাধীন দেশের আবশ্যিক চরিত্র হিসাবে লালন করে এসেছেন, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আজ আমাদের কাজ— আরও এক বার ইতিহাস থেকে এই হারিয়ে যাওয়া ভাবনাগুলিকে খুঁজে ফিরিয়ে আনা। অর্থপূর্ণ গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার যে সব জরুরি ভাবনা স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালীন শোনা গিয়েছিল— এবং ১৯৪৭-পরবর্তী উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশের পুনর্গঠনের সময়ে যেগুলি হারিয়ে গিয়েছিল— সেগুলিকে আবার নতুন করে ফিরে দেখা।
বাংলার বহু চিন্তাবিদ ও রাষ্ট্রতাত্ত্বিক ভেবেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়টি নিয়ে। এঁদের মধ্যে ব্রজেন শীল, রাধাকমল মুখোপাধ্যায় ও বিনয় সরকারের কথা প্রথমেই আসে। আর যে সব রাজনৈতিক নেতা এ নিয়ে ভেবেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শরৎচন্দ্র বসু, মানবেন্দ্রনাথ রায় ও সুভাষচন্দ্র বসু। বিখ্যাত সঙ্গীতকার অতুলপ্রসাদ সেনের ভাষায় এই হল সেই ‘বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’-এর ভাবনা।
চলতি বছরের ২৬ জুন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের নেতাদের মুখে প্রস্তাব শোনা গেল, ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দ দু’টি বাদ দিতে হবে। আমরা জানি, ১৯৭৬ সালে, জরুরি অবস্থার কর্তৃত্ববাদী শাসনাধীন ভারতের সংসদে যখন সংবিধানের ৪২তম সংশোধনী আনা হয়, সেই সময়ে এই দু’টি শব্দ সংযোজিত হয়েছিল। আজ যদি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি বাদ দেওযা হয়, তা হবে হিন্দু রাষ্ট্রের এক বিপুল প্রতীকী জয়। আর ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটি বাদ দেওয়া গেলে তা হবে এই বর্তমান শাসনকালের আর এক বড় কৃতিত্ব— বিশেষত যখন এ দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক অসাম্যের হার দ্রুতগতিতে বাড়ছে। সে সময় ইন্দিরা গান্ধীর অতিকেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার জন্যও এই দু’টি শব্দ গুরুত্বময় ছিল। দু’টি শব্দকেই আদর্শস্তম্ভ হিসাবে দেখিয়ে তিনি তাঁর কর্তৃত্ববাদ কায়েম করতে চেয়েছিলেন। পরবর্তী কালের ভারত দেখিয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র দু’টি আদর্শস্তম্ভই এ দেশে কতখানি নড়বড়ে। এও দেখিয়েছে, কী ভাবে কেন্দ্রীভূত কর্তৃত্ববাদের পথ ধরেই দৃঢ় ভাবে এ দেশে প্রোথিত হয়েছে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদ।
সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রতীকী গুরুত্বের কথা যদি ভাবতেই হয়, সে ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে— দু’টি শব্দ বাদ দেওয়ার বদলে বরং অন্য একটি শব্দ এখানে যোগ করা হোক। ১৯৪৮ সালের ১৫ নভেম্বর কে টি শাহ সংবিধানের এক নম্বর ধারার একটি সংশোধনী আনেন ও বলেন, ‘ভারত হবে তার প্রদেশগুলির ধর্মনিরপেক্ষ, যুক্তরাষ্ট্রীয়, সমাজতান্ত্রিক ইউনিয়ন’। সেই সময়ে সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’ নিয়ে কোনও বিতর্ক হচ্ছিল না, তাই কে টি শাহ চাইলেন সংবিধানের প্রথম ধারাটির সংশোধনীর মাধ্যমে পুরো বিষয়টি স্পষ্ট করে দিতে। তিনি বললেন, “যাতে কেউ না ভাবেন যে ‘ইউনিয়ন’ কথাটির অর্থ একটি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র, তাই আমি এটা পরিষ্কার করে দিতে চাই যে সংবিধানের প্রথম ধারার প্রথম বাক্যটিতেই বলা হয়েছে ভারত একটি ‘ফেডারাল (যুক্তরাষ্ট্রীয়) ইউনিয়ন’।”
বি আর আম্বেডকর দু’টি আপত্তি তুললেন। প্রথমত, তিনি বললেন যে ভারতীয় সংবিধান ‘কেবল রাষ্ট্রের বিবিধ বিভাগ পরিচালনা করার কথা ভেবেই তৈরি হয়েছে,’ এবং ‘সেই রাষ্ট্রের নীতি কী হবে, তার সমাজ কেমন ভাবে সংগঠিত হবে, এত কিছু কেবল একটি সংবিধানের দ্বারা স্থির করা যায় না।’ দ্বিতীয়ত, সমাজতান্ত্রিক শব্দটির ক্ষেত্রে শাহর সংশোধনীটিকে তাঁর মনে হয়েছিল ‘অতিরিক্ত’ বা ‘অপ্রয়োজনীয়’— কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ আর যুক্তরাষ্ট্রীয় বিষয়ে কোনও অভিমতই তিনি দিলেন না। বরং বিষয়টা খানিক উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ভারতীয় সংবিধানের ‘ডিরেক্টিভ প্রিন্সিপলস’ বা নীতিনির্ধারক সূত্র হিসাবে যে সব কথা বলা আছে, তার মধ্যেই যদি সমাজতান্ত্রিক অভিমুখ বা বক্তব্য না দেখতে পাওয়া যায়— ‘তবে সমাজতন্ত্র আর কী হতে পারে, সেটা আমার বোঝার ক্ষমতার বাইরে।’
কে টি শাহর ‘যুক্তরাষ্ট্রীয়’ শব্দটি যোগ করার সুচিন্তিত প্রস্তাব যখন বাতিল হল, মাহবুব আলি বেগ ভাবেন, সম্ভবত ‘সংবিধান-প্রণেতারা মনে মনে কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থাই চাইছিলেন, কেবল মুখেই বলছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কথা।’ ‘সত্যিই যদি যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনপদ্ধতি চাওয়া হত, সত্যিই যদি এমন ব্যবস্থার কথা ভাবা হত যাতে ভবিষ্যতে কোনও ক্ষমতালোভী দল দেশে পুরোদস্তুর কেন্দ্রীভূত শাসন চালু করতে না পারে, ফ্যাসিস্ট বা কর্তৃত্ববাদী (অথরিটারিয়ান) না হয়ে উঠতে পারে, তা হলে তো এখনই আমাদের ঠিক শব্দটা ব্যবহার করার উচিত: ফেডারেশন’।
কে টি শাহ অবশ্য হাল ছাড়েননি। আরও একটি সংশোধনী এনে তিনি সংবিধানে নাগরিকদের আশা আকাঙ্ক্ষা ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক ফেডারেশনের পক্ষে জোর সওয়াল করলেন। এইচ ভি কামাথ সেই সংশোধনীটি সমর্থন করলেন। তবে এর ভাগ্যেও জুটল আগের সংশোধনীগুলিরই পরিণতি— বাতিল! পরে অন্য প্রসঙ্গে, শাহ আবারও দাবি তুলেছিলেন যাতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কোনও প্রদেশের প্রাদেশিক আইনসভার স্পষ্টত প্রকাশিত ইচ্ছা না থাকলে সেই প্রদেশের নাম বা ভৌগোলিক সীমা, কিছুই পাল্টাতে পারবে না।
১৯৩৮ সালে সুভাষচন্দ্র বসু এই কে টি শাহকে জাতীয় প্ল্যানিং কমিটি-তে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। রাধাকমল মুখোপাধ্যায় ও মেঘনাদ সাহার সঙ্গে তিনিও থাকুন কমিটিতে, সুভাষ চেয়েছিলেন। এই তিন জনই ছিলেন স্পষ্টবক্তা যুক্তরাষ্ট্রপন্থী। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে সুভাষচন্দ্র বসু ও জওহরলাল নেহরু, এই দুই জনের সঙ্গেই কে টি শাহ ঘনিষ্ঠ-সংযোগে কাজ করেছেন। স্বাধীনতার পর উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে নেহরু যখন পুরো নতুন ভাবে শুরু করার বদলে সেই আগেকার ঔপনিবেশিক শাসনধারা বজায় রাখাই সাব্যস্ত করলেন, সেই সময়ে অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক নেতার সঙ্গে কে টি শাহও নেহরুর থেকে দূরে সরে গেলেন। পরে তিনি নির্দল প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে কংগ্রেসের এক অনুল্লেখযোগ্য নেতার কাছে হেরে গেলেন। প্রসঙ্গত, আম্বেডকরের গতিও হল একই রকম, কেবল সংবিধান-প্রণয়নের সময়ে কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর একটা সাময়িক বোঝাপড়া হয়েছিল।
১৯৫২ সালে প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কংগ্রেস মনোনীত প্রার্থী রাজেন্দ্র প্রসাদের বিপরীতে এই কে টি শাহ নির্দল প্রার্থী হলেন। তাঁকে ওই নির্বাচনে দাঁড়াতে অনুরোধ করেছিলেন স্বয়ং মেঘনাদ সাহা, যিনি সেই জাতীয় প্ল্যানিং কমিটির সময় থেকে শাহ-র বন্ধু ও সহকর্মী, এবং প্রথম লোকসভার এক জন উল্লেখযোগ্য সমাজতান্ত্রিক, যুক্তরাষ্ট্রপন্থী নেতা। কে টি শাহ হেরে গেলেন ঠিকই, তবে জয়ী প্রার্থীর তুলনায় তিনিই ছিলেন ভারতের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয় সংগ্রামের মূল আদর্শের প্রতি বেশি নিবেদিত। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় তাঁর বক্তব্য: ‘ভারতে আমরা সত্যিকারের গণতন্ত্রের কথা বলি ঠিকই, কিন্তু ভারী সুন্দর ভাবে প্রকৃত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সম্পদকে পুরোপুরি কেন্দ্রীভূত করে রাখি, যাতে প্রাদেশিক স্বাধীনতা, কিংবা স্থানীয় বা গ্রাম-স্তরের স্বশাসন, এ সমস্ত কিছুই একটা প্রকাণ্ড পরিহাসে পরিণত হয়।’
আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনার কথাগুলি সত্যিই খুব জরুরি, অনুপ্রেরণাদায়ক। তার মধ্যে ‘যুক্তরাষ্ট্র’ শব্দটির ব্যবহার হবে আলাদা ভাবে উজ্জ্বল। এ কোনও কথার কথা নয়। ‘যুক্তরাষ্ট্র’ বিষয়টাকে বড় মাপের গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এখন যখন ভারতের সামনে একটা নতুন জনগণনা আসতে চলেছে, নির্বাচনী অঞ্চলের ডিলিমিটেশন শুরু হওয়ার কথা হচ্ছে যা দক্ষিণী রাজ্যগুলিকে উত্তরের হিন্দিভাষী রাজ্যের তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ করে দিতে প্রস্তুত— এই সময়ে আবার ‘যুক্তরাষ্ট্র’ বিষয়ক ভাবনাচিন্তা নতুন করে ফিরিয়ে আনা দরকার। ইতিমধ্যেই কাশ্মীর কিংবা উত্তর-পূর্বের প্রদেশগুলি কেন্দ্রের দৃষ্টিতে প্রান্তিক হয়ে গিয়েছে, তামিল, কন্নড়, মরাঠি ও বাঙালি ‘অস্মিতা’ ক্রমশই বিরোধী রাজনীতির বাহন হয়ে উঠছে। এ দেশের সবচেয়ে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জাতীয়তাবাদী নেতারা, চিন্তকরা বিশ্বাস করতেন, স্বাধীন ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভূত শাসনের উত্তরাধিকারও কাম্য নয়, সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিকতাও কাম্য নয়। সযত্ননির্মিত, পারস্পরিক আদানপ্রদানে সক্ষম একটা ‘ফেডারাল ইউনিয়ন’, যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশই কাম্য। এই অতি মূল্যবান রাষ্ট্রদর্শন দেশ তৈরির সময়েই আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল, আজ তার পুনরাবিষ্কারই এই ভারতে কেন্দ্রীভূত কর্তৃত্ববাদের মোকাবিলা ও গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ।
গার্ডিনার প্রফেসর, ওশানিক হিস্ট্রি অ্যান্ড অ্যাফেয়ারস, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)