সরব: প্রতিবাদে রাজপথে জুনিয়র ডাক্তাররা, ২ সেপ্টেম্বর। দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
এখনও কঙ্কাল বেরোনো বাকি। একটা-দুটো নয়, অজস্র। কেবল এক জন অধ্যক্ষ, চার-পাঁচ জন আরএমও, তিন-চার জন অধ্যাপক বা সহকারী অধ্যাপক নয়। স্বাস্থ্য দফতরে এমন অসংখ্য মানুষ ঘাপটি মেরে বসে আছেন, যাঁদের স্বরূপ সামনে আনার সময় এসেছে। অনেকেই এখন নেপথ্যে থেকে জল মাপছেন। যে কোনও মুহূর্তে এই হাওয়ামোরগেরা শিবির বদল করবেন। টাকা আমদানি আর ক্ষমতার দাপাদাপির মোহে এঁরা পারেন না এমন কাজ নেই। ক্ষমতায় যে দলই থাকুক না কেন, স্বাস্থ্য দফতরকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করবেন এঁরা। আর এঁদের জন্যই সৎ, নিষ্ঠাবান চিকিৎসক-আধিকারিক-আমলাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত।
দুই দশকেরও বেশি স্বাস্থ্য-সাংবাদিকতা করার সুবাদে বুঝেছি, গোপনীয়তার আব্রুর কোনও বালাই নেই এখানে। দফতরে সবাই সবটা দেখেন। সবাই সবটা জানেন।
সালটা ২০০৭। সামনে এসেছিল পাভলভ মানসিক হাসপাতালে রোগিণীদের সম্পূর্ণ নগ্ন করে রেখে দেওয়ার খবর। সেই খবরে দেশব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠল। ঝড় উঠল বিধানসভাতেও। ঘটনার নজরদারিতে বিশেষ কমিটি গড়ল কলকাতা হাই কোর্ট। আর স্বাস্থ্য দফতরের তৎকালীন এক কর্তা বললেন, “আপনারা তো গণশত্রু। রাজ্যের বদনাম করছেন।” অর্থাৎ নগ্ন করে রাখায় দোষ নেই, খবর প্রকাশ হলে দোষ। এখন ২০২৪। সরকারে থাকা দল বদলেছে। ক্ষমতায় থাকা মানুষের ভাষা বদলায়নি।
পাভলভের ঘটনার কিছু দিন পর স্বাস্থ্যের আর এক দুর্নীতির খবর পেয়ে স্বাস্থ্য ভবনে এক অফিসারের ঘরে কিছু তথ্য জানতে যেতেই প্রায় ছিটকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। তিনি আঁতকে উঠে বলেছিলেন, “প্লিজ়, আমার সঙ্গে কারও সামনে কথা বলবেন না। বিপদে পড়ে যাব।” সেই অফিসার ছিলেন তৎকালীন শাসক দলের ঘনিষ্ঠ। দক্ষ অফিসার হিসেবে তাঁর সুনামও ছিল। বহু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল তাঁর টেবিলে আসত। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পরে ফোনে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি এত ভয় পেলেন কেন? আপনি তো সরাসরি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন বলেই জানি। তাঁর উত্তর ছিল, “বুঝেশুনে চলতে হয়। অনেক কিছু দেখেও দেখতে নেই। শুনেও শুনতে নেই। চেনা লোককে রাতারাতি অস্বীকার করতে শিখতে হয়। এটাই দস্তুর।”
এর পর ২০১২ সাল। তরুণ অফিসারের আরও উন্নতি হয়েছে। নতুন সরকারেরও তিনি সমান আস্থাভাজন। প্রশ্ন করেছিলাম, দুই আমলেই এমন প্রিয় থাকার রহস্যটা কী? তাঁর উত্তর ছিল, “আমি তো নিজের থিয়োরিতেই চলছি। চোখকান বোজাই আছে। এই থিয়োরি কখনও মার খায় না।”
চোখকান বুজে থাকার এই অব্যর্থ বিদ্যাই স্বাস্থ্য দফতরে অধিকাংশ কর্তা অহরহ জপ করে চলেন। সব আমলেই। অভিজ্ঞরা বলেন, আগে জড়তা ছিল, খানিক লোকলজ্জা ছিল। এখন সে সব নেই। প্রবীণ চিকিৎসকদের রসিকতা করে বলতে শুনেছি, “এখন সাম্যবাদ। চতুর্থ শ্রেণির কর্মী থেকে বিভাগের প্রধান, যে যার মতো করে টাকা তুলছে।”
স্বাস্থ্য দফতরের প্রাক্তন আমলাদের মুখে শুনি, “শিক্ষা ক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে এত শোরগোল। স্বাস্থ্যের দুর্নীতি বাইরে এলে এমন চার-পাঁচটা নিয়োগ দুর্নীতি তার নীচে চাপা পড়ে যাবে।”
৯ অগস্ট আর জি করে ওই চিকিৎসক-পড়ুয়ার খুন ও ধর্ষণের ঘটনার পরে দফতরের ভিতরে থেকে যাঁরা দুর্নীতি নিয়ে গেল-গেল করছেন, তাঁদের অধিকাংশই কিন্তু সবটা জানেন। এক প্রবীণ চিকিৎসক কথায় কথায় বলছিলেন, “এই মেয়েটি ‘শহিদ’ হয়ে অসংখ্য অনিয়মকে মানুষের সামনে বেআব্রু করে দিয়েছেন। মানুষ এখন কৈফিয়ত চাইছেন। তাই এত আলোড়ন। না হলে এই দুর্নীতি দফতরের অন্দরে তো অজানা নয় কোনও দিনই।”
তৃণমূলের এক নেতার রমরমার সময়ে এমবিবিএস পরীক্ষার্থীদের বিভিন্ন সিমেস্টারের পরীক্ষায় পরীক্ষাকেন্দ্রের সিসি ক্যামেরা বন্ধ রাখার নির্দেশ থাকত। হল-এ কেউ গার্ড দিতে পারতেন না। বলা হত, সে সবের প্রয়োজন নেই। বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে এসেছে, বিস্তর হইচই হয়েছে। কিন্তু সেই নেতার বাড়বাড়ন্ত তাতে বিন্দুমাত্র টাল খায়নি।
সেই নেতা অবলীলায় প্রশ্ন ফাঁস করিয়েছেন, ওষুধ কেনায় কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি করেছেন, কেউ টুঁ শব্দটি করেননি। কারণ, শোনা যেত, তাঁর মাথায় উপরমহলের হাত ছিল। সেই ‘উপরমহল’ যত দিন মনে করেছে, তাঁকে স্বমহিমায় রেখেছে। তার পর যখন দরকার হয়েছে, তাঁকে সরিয়ে আর এক জনকে এনেছে। টাকা নিয়ে পাশ করানো, নম্বর বাড়ানো, টেন্ডার ছাড়াই ওষুধপত্র কেনা, বছরের পর বছর চলেছে বিনা বাধায়।
অধুনা যে উত্তরবঙ্গ লবি নিয়ে এত আলোচনা, ২০১১-র পর থেকে যে লবির বাড়বাড়ন্ত, সেই লবির মাথা নাকি বলে বেড়ান, “অমুক তো স্বাস্থ্যটা ঠিক বোঝে না। তাই আমি যা বলি, ও সেটাই শুনে চলে।”
স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরে কান পাতলে শোনা যায়, যে বদলির ফাইল স্বাস্থ্য ভবন ফিরিয়ে দেয়, সেই ফাইল নবান্ন থেকে সই হয়ে আসে সামান্য দিনের ব্যবধানে। অভিযোগ, পদোন্নতি, পছন্দের জায়গায় বদলি সব কিছুরই আলাদা রেট চার্ট! সেই মতো চাহিদা পূরণ করতে পারলে আর কোনও ভাবনা নেই। না পারলে এক জেলা থেকে আর এক জেলায় ঠোক্কর। পদোন্নতি বন্ধ। কিংবা এমন জায়গায় বদলি, যেখানে সেই বিভাগটারই অস্তিত্ব নেই!
কিন্তু এই দুর্নীতি তো অন্য দফতরেও রয়েছে। স্বাস্থ্যে সেটা আলাদা কিসে? আলাদা, কারণ এখানে মানুষের জীবন জড়িয়ে। বিনা যোগ্যতায় যখন একের পর এক নিয়োগ হতে থাকে, এবং সেই নিযুক্ত ব্যক্তিদের কাজ যখন সরাসরি মানুষের উপরে প্রয়োগ হয়, তখন তা তো মানুষের জীবন নিয়ে ছেলেখেলারই শামিল। ধরা যাক, অর্থের বিনিময়ে এমন কাউকে পাশ করানো হল, বা এমন কাউকে প্রযুক্তিগত কাজে নিয়োগ করা হল, যাঁরা যোগ্যতায় উতরোতেই পারেননি। তাঁদের কাজ পাওয়ার একটাই মাপকাঠি, টাকা! তাঁরা যখন চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে যুক্ত হচ্ছেন, তখন মানুষের বাঁচা-মরা তো সরু সুতোর উপরেই ঝুলছে।
স্বাস্থ্যক্ষেত্রের মতো এমন সমস্ত স্তরে দুর্নীতি অন্য বিভাগে বড় একটা চোখে পড়ে না। এখানে ছাত্রনেতাদের একাংশ তাঁদের শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা তোলেন, সেই শিক্ষককে তাঁর পছন্দের জায়গায় রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা করার লোভ দেখিয়ে। এখানে পদের বিচারে কোনও উচ্চ-নীচ নেই। এমনই সমানাধিকার যে, ঠিকাকর্মীও রোগী ভর্তি করে টাকা তোলেন। টাকার ভাগ যায় প্রতিষ্ঠান-প্রধানের কাছেও। সকলেই অসৎ? তা নয়। কেউ ভয়ে মুখ বন্ধ করে রাখেন। কেউ ভয়ে অপরাধে শামিল হন। যাঁরা প্রতিবাদ করেন তাঁদের ‘টাইট দিতে’ প্রত্যন্ত এলাকায় বদলি করা হয়, ভুয়ো অভিযোগে ফাঁসানো হয়, প্রকাশ্যে অপমান করা হয়। এ সবের পরেও অনেককে বাগ মানানো যায় না। তাঁরা ঘাড় সোজা করে থাকেন। তাই ‘সিস্টেম’ টিকে থাকে। গরিব মানুষ চিকিৎসা পান।
অভিযোগ, এই গোলমালের আগে পর্যন্ত অধুনা বহু আলোচিত উত্তরবঙ্গ লবির চার-পাঁচ জন চিকিৎসক ছিলেন লবির কর্ণধারের চোখের মণি। কর্ণধার নিজে কিছু করতেন না। তাঁর হয়ে ওই চিকিৎসকেরাই বিভিন্ন জায়গা থেকে কোথায় কী করা দরকার তার তালিকা প্রস্তুত করতেন। কে কোথায় কোন পদে বসবেন, কাকে কোথায় ‘গ্যারাজ পোস্টিং’ দেওয়া হবে, কোন সংস্থার থেকে জিনিস কেনা হবে, কর্ণধার সেই তালিকায় চোখ বুলিয়ে তা পাঠিয়ে দিতেন সর্বোচ্চ স্তরে। প্রস্তাব গৃহীত হত রাতারাতি। সবাই সব জানেন, জানতেন।
আর জি কর কাণ্ডের ধাক্কায় এখন গলগল করে দুর্নীতির কথা উঠে আসছে, রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল থেকেও পদত্যাগের খবর সামনে আসছে। কেন পদত্যাগ করছেন? অনেকেই জানিয়েছেন, দিনের পর দিন এত দুর্নীতি আর সহ্য করতে পারছিলেন না। তা হলে আগে সরেননি কেন? স্বীকার করেছেন, এত দিন সরে আসার সাহসটুকুও দেখাতে পারছিলেন না, বড় কোনও ক্ষতি হয়ে যাবে এই ভয়ে। রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলে সাধারণ মানুষ চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে পারেন। কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নেয়, চিকিৎসক দোষী কি না। কাউন্সিলের সদস্যদের একটা অংশ এখন প্রকাশ্যেই অভিযোগ করছেন, একাধিক বার অভিযোগকারীকে কাউন্সিল অফিসের বাইরে কোথাও ডেকে পাঠিয়ে টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ডাক্তারকেও আলাদা ডেকে জানতে চাওয়া হয়েছে, তিনি কত দিতে পারবেন। যাঁর তরফে টাকা বেশি, সিদ্ধান্তও তাঁরই দিকে।
রাজ্য জুড়ে এখন যে আন্দোলন, তার আরও অনেকটা পথ এগোনো বাকি। সিবিআই তদন্তের উপরেই কিন্তু সবটা নির্ভর করছে না। এখনও পর্যন্ত কোনও তদন্তকারী সংস্থার আওতায় আসেনি যে অসংখ্য দুর্নীতি, তাকে সাফ করার কাজটা অত্যন্ত দুরূহ। এবং সময়সাপেক্ষ।
কিন্তু সেই জঞ্জাল সাফাইয়ের কাজটা এ বার মাঝপথে থামিয়ে দিলে চলবে না। এক বার থামলে ফের যুগ যুগ ধরে এই দুর্নীতিই কিন্তু বংশবিস্তার করে চলবে, যেমন এত দিন করে এসেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy